মিলু শামস

সাংবাদিক

ওলস্টোন ক্রাফট ও রোকেয়ার পথ ধরে

ব্রিটেনে নারীবাদীদের বাইবেল বলে পরিচিত জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘সাবজেকশন অব উইমেন’ প্রকাশিত হওয়ার বহু আগে হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে ভারতীয় বাঙালি সমাজে ক্ষণস্থায়ী এক ঝড় উঠেছিল। যার বিদ্যুৎ চমকে কিছু জরুরি বিষয়ের দিগন্তরেখা স্পষ্ট হয়। ধর্মকে সমাজ সংস্কার আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করার আধুনিক মনস্ক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন এঁরাই। এঁদের দর্পণে ধরা পড়েছিলো সেকালের নারীদের দৈন্যদশা। বিধবা-বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আন্দোলনের এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন যদিও নিজেদের সীমাবদ্ধতায় আটকে নিজেরাই ছিটকে পড়েছিলেন খুব অল্প সময়ে। তবু কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বদ্ধ জলাশয়ে ঢিল ছোড়ার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন, যা পরে এগিয়ে নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

উনিশ শতকের তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁসে নারীর দুরবস্থা মোচন একটি বড় ইস্যু হলেও এ নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার নেতৃত্বে ছিলেন রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পুরুষরা। সত্যি বলতে যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার পুরুষদের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া নারী আন্দোলন কোনো দেশেই তেমন গতি পায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পশ্চাৎপদ নারীদের এগিয়ে যেতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাঁরা। তবে ভারতে যেভাবে পুরুষরা প্রায় এককভাবে আন্দোলনের সূচনা করেছেন ইউরোপের কোনো দেশে সম্ভবত তেমন হয়নি।

নারীবাদের ইশতেহার বলে পরিচিত ‘দ্য ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান’-এর লেখক মেরি ওলস্টোন ক্রাফটকে এ বই লেখার জন্য সামাজিকভাবে হেনস্থা হতে হয়েছিলো। ভিন্ডিকেশন অব ওম্যান লেখার আগে তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব মেন। সেখানে তিনি মানবাধিকারের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তখনও পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়নি। ওই বইয়ে রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদবিরোধী মেরির মূল বক্তব্য ছিলো নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।

প্রথম ভিন্ডিকেশন প্রকাশিত হয় সতেরো’শ নব্বই সালে। দ্বিতীয়টি সতেরো’শ বিরানব্বই সালে। নারীর মানবাধিকার নিয়ে এ বই প্রকাশিত হলে মেরির জন্মভূমি ইংল্যান্ড তা সমর্থন তো করেইনি, উল্টো নানারকম অপবাদ দিয়ে তাঁকে নিরাশ করার চেষ্টা করেছে। বইটি পড়ার আগ্রহ পর্যন্ত দেখায়নি কেউ। সে সময়ের ইংল্যান্ড এ ধরনের বইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। অথচ ফ্রান্সে বইটির প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো অন্যরকম। ফ্রান্সে ততদিনে সতেরো’শ ঊননব্বই সালের বিপ্লব হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে উত্ত্যক্ত হয়ে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি জমালে অন্যরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। তিনি পৌঁছানোর আগেই বইটি ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়ে সাহিত্য ও রাজনৈতিক মহলে পরিচিতি পায়। ‘দ্য ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান প্রকাশিত হওয়ার সাতাত্তর বছর পর আঠারো’শ ঊনসত্তর সালে প্রকাশিত হয় জন স্টুয়ার্ট মিলের দ্য সাবজেকশন অব ওম্যান। 

উনিশ শতকে তথাকথিত বাঙ্গালী রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণে নারী-ইস্যু গুরুত্ব পেলেও ভারতে সেভাবে কোনো নারী আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকেন নি বা নিজেদের দুরাবস্থা নিয়ে সেভাবে লেখালেখি করেন নি। যদিও তখন কিছু হলেও নারীশিক্ষা শুরু হয়েছে। নারীরা জ্ঞানের চর্চায় এগিয়ে আসছেন। কিন্তু নিজেদের অধস্তন অবস্থা নিয়ে কেউ মুখ খোলেন নি। নিজেদের বিষয় নিয়ে বাঙালি নারীর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও কিছুকাল।

আঠারো’শ আশি সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মান যে নারী, পরিণত বয়সে তাঁকেই প্রথম স্পষ্ট করে বলতে শুনি, ‘পুরুষ জাতি বলেন যে, তাঁহারা আমাদিগকে বুকের ভিতর বুক পাতিয়া বুক দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছেন এবং এরূপ সোহাগ আমরা সংসারে পাইবো না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সোহাগে গলিয়া ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি। ফলত তাঁহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন তাহাতেই আমাদের সর্বনাশ হইতেছে। আমাদিগকে তাঁহারা হৃদয় পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান সূর্যালোক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিত রাখিয়াছেন, তাহাতেই আমরা ক্রমশ মরিতেছি। তাঁহারা আরও বলেন, ‘‘তাহাদের সুখের সামগ্রী আমরা মাথায় বহিয়া আনিয়া দিবো, আমরা থাকিতে তাঁহারা দুঃখ সহ্য করিবে কেনো? আমরা ঐ শ্রেণীর বক্তাকে তাঁহাদের অনুগ্রহপূর্ণ উক্তির জন্য ধন্যবাদ দেই, কিন্তু ভ্রাতঃ পোড়া সংসারটা কেবল কবির সুখময়ী কল্পনা নহে। ইহা জটিল কুটিল কঠোর সংসার’। (স্ত্রী জাতির অবনতি)

সত্যি কথা এত স্পষ্ট উচ্চারণে শোনার জন্য এতকাল অপেক্ষা করতে হলো কেনো? সেই রেনেসাঁর সময় থেকেই তো নারীরা একটু একটু করে পড়ালেখার চর্চা শুরু করেছেন। তাহলে? শোনা যাক সাহিত্যিক ও সমাজতাত্ত্বিক কেতকী কুশারি ডাইসনের কাছ থেকে।

‘রোকেয়াই কি আধুনিক অর্থে বাংলার প্রথম প্রকৃত ফেমিনিস্ট নারী? তা যদি হয়, তবে জিজ্ঞাসা : স্ত্রী শিক্ষায় এবং রেনেসাঁসের অন্যান্য দিকে হিন্দু সমাজের অগ্রবর্তিতা সত্ত্বেও প্রথম প্রকৃত ফেমিনিস্ট মেয়ে মুসলমান ঘর থেকে এলেন কেনো? একি একেবারেই আপতিক, না এর পেছনে কোনো নিগূঢ় কারণ আছে? সামাজিক বাধা তো মুসলমান মেয়েরও কম ছিলো না, পর্দার বাধা প্রবলতরই ছিলো। মুসলমান মেয়ের অন্তত কোরান পড়ার জন্যও সাক্ষরতার অধিকারটুকু স্বীকৃত ছিলো। মুসলমান বিধবার অন্তত পুনর্বিবাহের অধিকারটুকু ছিলো। এগুলো কম কথা নয়। কিন্তু আমার মনে হয় সব থেকে প্রাসঙ্গিক, কেন্দ্রিক বিন্দুটি এই: মুসলমান মেয়ের মনের ওপরে হিন্দু পুরাণের দাবি ততটা জোরদার ছিলো না, তাকে ক্ষণে ক্ষণে সতী-সীতা-সাবিত্রী রাধা-দুর্গা লক্ষ্মীর সঙ্গে একাত্মা হয়ে যেতে হয় নি। তাই অনুকূল লগ্নে তার চৈতন্যের ত্বরিত র‌্যাডিক্যালাইজেশন সম্ভব হয়েছিলো।... এই দেবী বিলাস বাঙালি হিন্দু মেয়েদের সর্বনাশ করেছে; সিঁথির সিঁদুর আর কব্জির শাঁখা থেকে পায়ের আলতা পর্যন্ত মাঙ্গলিক চিহ্ন ধারণ করে গৃহের অধিষ্ঠাত্রীদেবী তথা পুরুষের গৃহলক্ষ্মী হয়ে, নিজেরা সাক্ষাত মা লক্ষ্মী সেজে, লক্ষ্মীপ্রতিমার সামনে গড় হয়ে পেন্নাম করে নিজেদের মনুষ্যত্বকে তারা জলাঞ্জলি দিয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার দাবি করতে গেলে একটা বৌদ্ধিক স্বনির্ভরতা, একটা অপৌরাণিক বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, একটা Hard headed realism লাগে। রোকেয়ার মধ্যে তা ছিলো, কিন্তু রেনেসাঁসের মধ্যাহ্নেও হিন্দু মেয়েদের মধ্যে তাকে লালন করা হয়নি, প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। রোকেয়া বুঝতে পেরেছেন যে, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক’ (রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে)।

বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকলে দেখতেন আজ নারীরা শিক্ষায় কর্মে দুর্দান্ত গতিতে এগুচ্ছে। সমাজে শিক্ষিত নারীদের নিজস্ব অবস্থান তৈরি হয়েছে। তিনি আনন্দিত হতেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু তিনি যে বলেছিলেন তাহারা আমাদের বুকের ভেতর বুক পাতিয়া বুক দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছেন। ‘তাহাদের’ ওই ‘অতিভালবাসা’ সুলভ মানসিকতায় কতটা পরিবর্তন এসেছে? শতকরা নব্বই ভাগ পুরুষই এখনও নারীদের ‘বুক দিয়ে আগলে’ রাখতে চান। যদিও মুখে তাঁরা সে কথা স্বীকার করেন না, হয়তো সেজন্যই দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া হাজার হাজার নারী গৃহের চৌহদ্দিতে আটকে থেকেই নিজেদের শিক্ষা ও প্রতিভা ক্ষয় করছেন। স্বামী চাচ্ছেন না তাই তাঁরা বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন না।

এখনও তাঁদের কাছে স্বামীর চাওয়াটা মুখ্য। নিজের চাওয়ার কণ্ঠস্বর অর্জন করতে পারেন নি। পরিবারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অবস্থানে যেতে পারেন নি। 

3734 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।