বাবলী হক

লেখক অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পুরানো শহরে, সেই স্মৃতির পটভূমিতে লেখা উপন্যাস ‘আম্বিয়াদাদি ও তার বিড়ালেরা’।

নারী, উনমানুষ

‘উইমেন ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্কঃ প্ল্যানেট ফিফটি ফিফটি বাই ২০৩০’। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতিসংঘের আহ্বানে ‘বিশ্বের কর্ম পরিবেশে নারী-পুরুষের সমতায়ন’ বিষয়টিকে নির্ধারিত করেছে। এই শিরোনামটি চোখে পড়তেই আমার ভিতরের নারী খানিকটা নড়ে চড়ে বসল। নারী–পুরুষের সমতায়ন এই দেশে নারীদের ভাবতে সত্যি একটু  কষ্টই হবে।

জাতিসংঘের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাদের এই ধরনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ কতটুকু বাস্তবসম্মত। উন্নত দেশ নিয়ে সন্দেহ নাই কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য এই স্লোগান কতখানি প্রযোজ্য! ২০১৭-তেও কি নারী তার কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ? অন্তত বাংলাদেশে  তো নয়। কর্মক্ষেত্র পরে আসছে, শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত নিরাপদ নয়। এখনও এই দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রী ধর্ষণে শিক্ষক পরিমল জয়ধরের মামলা নিষ্পত্তি হতে চার বছর লাগে। পান্না মাস্টারেরা রেপ করে সেঞ্চুরি পালন করে। একজন  বিবাহিত ব্যাংক কর্মকর্তা সন্তানের পিতা হওয়া সত্তেও মেয়েদের ইমোশনালি ব্ল্যাইমেইল করে তাদেরকে সামাজিক ভাবে হেনস্থা করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। অনেকে বলতে পারেন এইগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এইসব বিছিন্ন ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে কারণ সব তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার পরও তাদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। উল্টা বাদীকেই কেস তুলে নিতে হয় চাপের মুখে। শুধু তাই নয়, দাপটের সঙ্গে নিজ কর্মস্থলে বহালও থাকে। পুরুষ মানুষ তার কোনো কিছুতেই তেমন দোষ নেই, ছোটোখাটো ভুল করে ক্ষমাও পেয়ে যায়। থানা পুলিশ করলেও তাদের গায়ে তেমন আঁচড় লাগে না। ২০৩০ সাল নাগাদ নারী কর্মক্ষেত্রে সমপর্যায়ের ক্ষমতা পেয়ে যাবে কীভাবে! হয়তো জাদুরকাঠির ছোঁয়ায়। ভাবতে দোষ কী!

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নারীদের অবস্থান খুব একটা বদলায় নাই। আট হাজার বছর আগে আদিম সাম্যবাদী মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে যাবার পর, যে  পরিবর্তন হয় সেখান থেকে নারী আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারে নাই। বরং ধীরে ধীরে ধর্মের অনুশাসন দেখিয়ে তাদেরকে  নিগৃহীত করা হয়েছে। পুরুষদের ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছিলো ‘শাসক আর্যরা যখন ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলো তখন তাদের মধ্যেও দাসপ্রথা, শ্রেণী বিভাজন, শোষণ ইত্যাদি দেখা দিলো। নারীরা পুরুষের অধীনে চলে গেলো। পুরুষের বহুবিবাহ আর নারীর সহমরণ। এই সবই তৈরি হয়েছিলো ব্যক্তি সম্পত্তির ও শ্রেণি শোষণের ফলশ্রুতিতে শোষক শ্রেণির স্বার্থে ও প্রয়োজনে।’ (তথ্য সূত্র রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’–হায়দার আকবর খান রনোর ভূমিকা)।                 

১৫ই অক্টোবার ছিলো আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। জরিপ বলে, বাংলাদেশে কৃষিকাজে পুরুষদের পাশাপাশি প্রায় ২০ ধরনের কাজে নারী জড়িত। অথচ মজুরির বেলায় একজন নারী পুরুষের অর্ধেক পাচ্ছে। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও কি নারীর কাজের মূল্যায়ন করা হয়? আসলে মূল্যায়নের পথটি আটকে রাখা হয়। নারী ঘরে রান্না করে। এ আর এমন কী কাজ! কিন্তু ঘরের বাইরে জীবিকারুপে এই কাজটি যখন করতে চায় তখনই বিপত্তি। কয়টি  ফাইভ-স্টার হোটেলের কিচেনে নারীরা কাজ করে? নারীদের জন্য একশো ভাগ সংরক্ষিত হয় না কেনো এই কাজটি? সেখানেও পুরুষ, যারা হয়তো বাড়ি ফিরে কোনোদিন চা করেও খায় নাই। পুরুষ তার নিজের সুবিধার জায়গাটি ঠিকঠাক বাছাই করে নিয়েছে। এখন দু-একজন নারী শেফ আসছে কিন্তু পুরুষের তুলনায় খুবই  নগণ্য।

বৈদিক যুগে শিকার, পশুপালন এসব পুরুষরাই করতো। চাষ বাস শেখার পর মেয়েদের দায়িত্ব দেয়া হলো খেত পাহারা দেয়া, কাপড় বোনা, রান্না, শিশু ও বৃদ্ধদের সেবা করা। সেই সময় থেকেই  শুরু হয়েছিলো নারীর স্বাধীন চলাফেরা এমন কী পোশাকেও হস্তক্ষেপ করা।                                             

‘ধাতু, মাটির, কাঠের, চামড়ার, পুতির কাজ, চালু হলো। পেশার সংখ্যা  বাড়তে লাগলো, বেশবাসে পরিবর্তন এলো, ক্রমে নারীর স্বাধীনতা কমতে লাগল’।(প্রবন্ধ সংগ্রহ১,সুকুমারী ভট্রাচার্য।পৃ-১৮)।

বেশবাসের  পরিবর্তনে এক পর্যায়ে পর্দা প্রথা চালু হলো। নারীরা পর-পুরুষ থেকে পর্দা করবে কিন্তু পুরুষরা পর-নারী থেকে পর্দা করবে না। লম্বা ঘোমটা থেকে শুরু করে এক পর্যায়ে এই সময়ে ও নারীরা হাতে পায়ে মোজা পরে আপাদমস্তক ঢেকে পুরুষদের পিছনে হাঁটতে থাকে। সবাই নয় যারা ভালো মেয়ে তাঁরাই এসব মেনে চলেন।

৮ই মার্চ ঘটা করে বিশ্বজুড়ে নারীদিবস পালন করা হয়। বছরে একদিন একটা প্রতিবাদ সভায় স্লোগান কিংবা একদিনের বাদশা হবার মতো(ভারতে)সবচেয়ে বড়ো পদে কাজ করার সুযোগ পাওয়া, চীন ও জাপানে নারীদের কর্মস্থলে এই দিনটিতে ছুটি দেয়া হয়। যাও নারী এই নিয়েই খুশি থাকো।            

‘সমাজে নারীর স্থান উনমানবীর, তাকে শুধু ভোগের সামগ্রীরুপে দেখা  হতো। তার দেহ, তার শ্রম তার প্রভুর জন্য। তাই তাকে বন্ধক রাখা যেতো, কেনা যেতো, বিক্রি করা যেতো; যজ্ঞের দক্ষিণা হিসাবে, যৌতুক হিসাবে বা অতিথির উপহার হিসাবে দানও করা যেতো। শাস্ত্রে স্পষ্টই  বলা হয়েছে, ‘নারী সম্ভোগ আনে’ (প্রবন্ধ সংগ্রহ ১, সুকুমারী ভট্রাচার্য।পৃ-৮৯)।

একজন উনমানবীর শিক্ষা, চলা-ফেরা, জীবিকা, বেশভূষা সব নির্ভর  করে পুরুষের অনুমতির উপর। যারা সমাজের চোখে পূর্ণ মানুষ। নারী থাকবে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে। খিড়কীর  রাস্তা ধরে চলাফেরা করবে। জন্মের পর বাবার আশ্রয়ে, এরপর স্বামীর সংসারে বৃদ্ধ বয়সে ছেলের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া। এই নিয়মের বাঁধন যারা ভাঙতে চায় তারাই অশান্তি সৃষ্টি করে। এখানে সমাজের কী দায়! সমাজ তো বলেছে তোমরা ঘরে থাকো। পুরুষকে প্রভুরুপে মেনে নিলেই তো সমস্ত ঝামেলা মিটে যায়! ভৃত্য ও ভার্যা শব্দ দুটোই ‘ভরণ করা’ মানে যাকে ভরণ করতে হবে। যেখানে প্রভু বা মালিক সেজে নারীকে নিজের আয়ত্তে রাখা যায়, সেখানে নারীকে কাজের সুযোগ করে দিয়ে সমপর্যায়ে কেনো আনবে!                               

বহু যুগ আগে থেকেই পুরুষদের প্রভুত্ব শুরু হয়েছিলো ঘরেও নারীকে কী ভবে উৎপাদনমূলক কাজ থেকে সরিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায়। ক্রীতদাস প্রথা থাকাকালীন সময়ে ঘরের কাজে অনেকটা তাদের উপর চলে যাওয়ায় নারীদের সেখানেও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।                                 

‘পুরুষ সমাজ শাসন করতো, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের ভুমিকা নির্ধারণ করতো। নারীর প্রধান কাজ যখন হয়ে দাঁড়াল সন্তানধারণ, তখন তারা যন্ত্রণারই ভাজন হলো এবং পরিবর্তে সম্মান বা ক্ষতিপূরণ সামান্যই পেলো’ (প্রবন্ধ সংগ্রহ১, সুকুমারী ভট্রাচার্য।পৃ-১১১)।

পুরুষ নিজ গুনে নয় জন্মসূত্রে নিজ অধিকারে অতি সহজে যা কিছু অর্জন করে, নারীকে সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। কাজেই সমতায়নের পথ নারীর জন্য খুব একটা মসৃণ তো নয় বরং দুঃসাধ্যই বটে এই বাংলাদেশে।    

2868 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।