মাথায় উকুন! কি সর্বনাশ। মারিয়া মরালেসের মাথা ভর্তি উকুন। পাবলিক স্কুলের সেকেন্ড গ্রেড স্পেশাল এডুকেশন ক্লাসের টিচার মিসেস গ্রীন ক্লজেট খুলে প্লাস্টিক জিপলক ব্যাগ বের করে মারিয়ার হাতে দিলেন। সাত বছর বয়েসেই মারিয়া অনেকটা নাদুস নুদুস। তাকে দেখে মনে হবে দশ। যতটা সে মোটাসোটা ততটাই হাবাগোবা। চশমার ফাঁক দিয়ে টিচারের দিকে সে করুন চোখে চাইলো। উকুন ধরে ব্যাগে পুরে নিচের তলায় স্কুল নার্সের কাছে নেয়া হল। ঘন্টা খানেক পরে নার্স জানাল মারিয়া কে বাসায় চলে যেতে হবে। তার মাকে ইতোমধ্যেই খবর দেয়া হয়েছে। মারিয়ার ছোট বোন গ্লোরিয়া মরালেস কেও ফার্স্ট গ্রেড ক্লাস থেকে ডেকে পাঠানো হল চেক করার জন্য। স্কুল নার্সের রুমে এসে গ্লোরিয়া টুলু মুলু করে বোনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মারিয়া হাত বাড়িয়ে ছোট বোনকে একটি আলতো ছোঁয়া দিলো যেন সে চুরি করে ধরা পড়েছে। দুই বোন মুখ চুন করে বসে রইলো যতক্ষণ তাদের মা না আসে ।
স্টেলা হারনান্দেজ কাজ করছিলো ম্যানহাটানের ছোট খাটো একটি স্প্যানিশ রেস্তরাঁয়। ফোন পেয়ে সে তার বস ডেভিড গারসন কে অনেক মিনতি করে ছুটি নিয়ে ছুটলো সেভেন ট্রেনের শেষ মাথায় তার মেয়েদের স্কুলে।
মেক্সিকো থেকে মাত্র চার বছর হলো সে দুই মেয়ে নিয়ে আমেরিকায় এসেছে। নিউইয়র্কের করোনা এলাকায় তার মেয়েদের বাবা হোজে মরালেস থাকে তার নতুন গার্ল ফ্রেন্ড কে নিয়ে। হোজে তাকে ছেড়ে দুই বাচ্চা ফেলে অনেক আগেই চলে এসেছিল। স্টেলা অনেক কষ্ট করে এদেশে এসে তাকে খুঁজে বের করেছে বটে, বড় মেয়েটি অটিস্টিক হওয়াতে হোজে আর চায়নি তাদেরকে। কে চায় অকারনে ঝামেলা নিতে। আমেরিকা এত বড় দেশ চোখের আড়াল হলেই কে কাহার!
মেক্সিকোতে এক গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম স্টেলার। অভাবের ভেতরে বড় হয়েছে সে। হাইস্কুলে পাঠাবার মতো অবস্থা ছিলো না তার বাবার। তাই কোনো মতে প্রাথমিক স্কুল শেষে একটু বড় হতে না হতেই তার বাবা তাকে শহরে পাঠায় তাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের দোকানে কাজের জন্য। সেখানেই হোজের সাথে দেখা আর প্রথম দেখাতেই সে হোজের প্রেমে পড়ে যায়। বাবা মা'র অমতেই সংসার শুরু করে স্টেলা। প্রাচীন মেক্সিকোর সমাজ ব্যাবস্থা যদিও বিয়ের ব্যাপারে পরিবর্তন বিরোধী কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার ঘনিষ্ঠতায় সে বিষয় অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে তাই বিয়ের ক্ষেত্রে খুব তেমন কড়াকড়ি নেই। স্টেলা হোজে বিয়ে করেনি কোনোদিন তবু জন্ম হয় মারিয়ার। দুবছর পর গ্লোরিয়ার। হোজের সাথে জীবন বেঁধে তার খুব যে তেমন লাভ হলো তা নয়। হোজে অলস অবিশ্বস্ত আর দায়িত্বহীন। গ্লোরিয়ার জন্মের কিছুদিন পরেই সে উধাও। না বলে না কয়ে এক দল শ্রমিকের সাথে চলে এলো আমেরিকায়। আমেরিকা মেক্সিকো বর্ডারে এসে গালফ অফ মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে সে এসে ঢুকলো অস্টিন টেক্সাসে। অনেক অনেক পথ ঘুরে টুরে শেষমেশ নিউইয়র্কে। ওদিকে মেক্সিকোতে যারপর নাই কষ্ট করেও স্টেলা যখন আর পারছিলো না তখন সে তার দুই মেয়েকে নিয়ে ফলের ট্রাকের ভেতরে বসে বর্ডার পাড়ি দিয়ে চলে আসে। স্প্যানিশ ছাড়া একটি শব্দ ইংরেজিতে বলতে পারেনা স্টেলা। সেই জিরো ইংলিশ নিয়ে সে যাত্রা শুরু করে এই নিষ্ঠুর পরবাসে। তারপরের ইতিহাস অপরিসীম কষ্টের ।
এখন সে থাকে তার এক বান্ধবীর সাথে একটি রুম শেয়ার করে। করোনার কাছাকাছি ৮২ রুজভেল্ট এভিনিউতে সেভেন ট্রেনের কাছে। বাবার সাথে মেয়েদের প্রথম প্রথম দেখাই হতো না কিন্তু এই চার বছরে ধীরে ধীরে হোজে অনেক চেঞ্জ হয়েছে এখন ওদের সাথে দেখা হয় সপ্তায় দু’দিন। বাকি সময়টা ওরা মার কাছে থাকে। স্টেলা সাত সকালে উঠে মেয়েদের স্কুল ব্যাগে বই ভরে, জুস আর সামান্য কিছু স্নাক্স ভরে দেয়। ফিতে দিয়ে ফুল বানিয়ে কষে চুল বেঁধে স্কুল গেঁটে পৌঁছে দেয় সাড়ে সাত টার আগেই। মারিয়া গ্লোরিয়া দুই বোন পাশাপাশি বসে স্কুলের ব্রেকফাস্ট খায়। দুধ, সিরিয়াল, মাফিন, টোস্ট আপেল জুস বা ফ্রুটপাঞ্চ, কলা বা আপেল। স্কুলের ব্রেকফাস্ট খেতে মারিয়ার খুব ভালো লাগে। সে মাঝে মাঝে মাফিনের ছোট প্যাকেট টা বই ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। গ্লোরিয়াকেও বলে কিছু খাবার ব্যাগে রাখতে। মাঝে মাঝে স্কুল এইড মহিলাদের ভয়ে ইচ্ছে থাকলেও দু’বার খাবার নিতে পারে না কিন্তু তখনও তার খিদে থেকে যায়। ব্রেকফাস্ট সময় শেষ হলে টিচার এসে দাঁড়ায় সবাই মিলে লাইন করে উপরতলায় ক্লাসে চলে যায়।
বাচ্চাদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে স্টেলা ছোটে ম্যানহাটানে তার নিজের কাজের উদ্দেশে। সারাদিন সে ব্ল্যাকবিন, টমেটো রাইস বানায়, এভকাডো লাল পেয়াজ বেলপেপার লেবু আর অলিভয়েল মিশিয়ে দিয়ে গুয়াকামোলে বানায়। পোয়ও (চিকেন) রান্না করে সেই সাথে বানায় কর্ণ টরটিয়া (রুটি) কিন্তু এসবের মধ্যেও তার মনটা পড়ে থাকে মেয়ে দুটোর কাছে। জীবনের টানাপড়েন আর তার সইছে না। কত দিন সে মনে মনে ভেবেছে দুই মেয়েকে তার বাবার কাছে দিয়ে চলে যাবে কোথাও! কিম্বা এতদিন ধরে কার্লোস তার পিছে পিছে ঘুরছে তাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধবে। দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে হোজে কে যে সে ভাল কাউকে বিয়ে করে সুখে আছে। কিন্তু পারে না কেবল অটিস্টিক মেয়েটার কথা ভেবে। তার পা আটকে যায় মারিয়ার হাবাগোবা মুখের দিকে চেয়ে। সে জানে ওই কোমল মুখের আড়ালে যে শানিত হৃদয় মায়ের অভাবে তা থেকে রক্ত ঝরবে নিরবে।
স্কুল থেকে আবার ফোন। আরো দুই স্টেশন যেতে হবে। স্টেলা অস্থির চোখে সেভেন ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আজকাল এই এক জ্বালা হয়েছে! কোথা থেকে দুই মেয়ের মাথা ভরে গেছে উকুনে। আর দু’দিন পর পরই স্কুল থেকে তার ডাক পড়ছে। স্কুল নার্স মিসেস ফকনার খুবই কড়া মেজাজের মহিলা। কিছুতেই ডাক্তারের নোট ছাড়া আর মেয়েদের স্কুলে আনা যায় না। বাসায় নিয়ে দুই মেয়ের মাথা আঁচড়ে, এলমর্হাস্ট হাসপাতাল থেকে আনা উকুন মারা ওষুধ দিয়ে, সাবান শ্যাম্পু দিয়ে, মাথা পরিস্কার করে। পরদিন একই ভাবে আবারো তাই করে! তারপর ছোটে ডাক্তারের কাছে লিখিত ছাড়পত্র আনতে। তারপর দিন সেই কাগজ সাথে নিয়ে স্কুলে যায়। আগে নার্সের কাছে। তারপরে ঢুকতে হয় ক্লাসে।
দুটি ছোট শিশু! মা, বাবা, দেশ, ভিনদেশ, স্কুল, টিচার, নার্স, খেলার সাথী, এবাসা সেবাসা, বাবার গার্লফ্রেন্ড, মা'র বয়ফ্রেন্ড, এই সব কিছু চেয়ে চেয়ে দেখে। শুধু দেখে তাইই নয় ওরা এর ভিতর দিয়ে যায়। কিছু মানে কিছু মানে না, কিন্তু ওরা কথা বলে না। অভিযোগ করতে হয় কিভাবে তা জানে না। বিশেষ করে অটিস্টিক মেয়েটি। চুপ করে চেয়ে থাকে। যেন ওর চাওয়া নেই পাওয়া নেই। ইচ্ছে নেই অনিচ্ছেও নেই। কিন্তু হাতে যদি সে সাদা কাগজ পায় তাতে কি যে সুন্দর ছবি আঁকে ওই অত্তটুকুন মেয়ে অবাক হতে হয়। নাম্বার টু পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজে সে এঁকে দেয়, তার মাথায় উকুন বলে সে কত লজ্জিত। কিম্বা সবাই তার দিকে কেমন ঘৃণাভরে তাকায় যেন সে কি ভীষণ নোংরা আর ভয়ংকর কোনো অপরাধ করেছে। অথচ একদিন সে স্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ করে কিচেনের পাশে গার্লস বাথরুমে যাবার সময় ইঁদুর দৌড়ে যেতে দেখেছে। সেই ছবিটা এঁকেছে মারিয়া। সাদা কাগজের একপাশে ক্যাফেটেরিয়াতে বসা লজ্জিত অপমানিত মারিয়ার স্যাডফেস। অন্য পাশে বড় এক টুকরো চীজ মুখে নৃত্যরত ইঁদুরের হ্যাপীফেস!
এ মেয়ে কি ফ্রিডা কাহলো! মেক্সিকোর ভুবন খ্যাত চিত্রশিল্পী! জীবনের সকল বেদনাকে যে তার ছবিতে প্রকাশ করেছে! যার ছবি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে সারা বিশ্ব কে নাড়া দিয়েছিলো। মারিয়া কি তার চোখের দেখার ওপর হৃদয়ের দেখাকে সুনিপুণ ভাবে আঁকলো সুররিয়েলিস্টিক ফ্রিডা কাহলোর মতোই!
ঝড়ের মতো মা এসে স্কুলের অফিসে সাইন আউট খাতায় সই করে নার্সের রুমে এসে দাঁড়ালো। মা কে দেখে দুই বোন অসহায় অপরাধী চোখে চেয়ে রইলো। মা নার্সের কাছ থেকে নোট নিয়ে মেয়েদের সাথে মাথা নিচু করে চলে গেলো।
স্কুল প্রায় শেষ হতে চলেছে। অফিস থেকে হঠাৎ এনাউন্সমেন্ট। মাইক্রোফোনে প্রিন্সিপালের গলা শোনা গেলো। নীচ তলায় অফিসে গিয়ে নোটিস নিয়ে আসার জন্য। মিসেস গ্রীন এর ক্লাসের অন্যান্য স্টুডেন্টদের অভিভাবকদের কাছে আজকের হোমওয়ার্ক ফোল্ডারে এই মর্মে চিঠি যাবে যে তাদের বাচ্চার ক্লাসে একজন স্টুডেন্ট এর মাথায় উকুন পাওয়া গেছে এবং যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে। এটা বোর্ড অফ এডুকেশনের রুল। আইনত স্কুলকে এর জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারেন অভিভাবকেরা।
বেশ কতদিন হয়ে গেলো। মারিয়ার আর খোঁজ নেই। হোম ওয়ার্ক জমা হতে থাকলো তার স্কুল ফোল্ডারে। সপ্তাহর বেশী কেটে গেলো তাও খবর নেই। পরের সোমবারে ডাক্তারের নোট নিয়ে আবার আসতে শুরু করেছে মারিয়া। বেশ আনমনা। চোখের চশমাতে ঝাপসা দেখছে বলায় চশমা ধুয়ে দেয়া হোলো। ক্লাসে মন দিতে পারছে না। আগের চেয়েও চুপচাপ। রিডিং রাইটিং ম্যাথ কোনোটাই ঠিক মতো করতে পারছে না। মাথা নিচু করে চেষ্টা করছে বইয়ের দিকে ঝুঁকে থাকতে। কেমন নিশ্চুপ একা একা! স্কুলের প্লে গ্রাউন্ডে গিয়ে অন্য বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে কিন্তু মারিয়া দেওয়ালের কাছে বসে গাছ থেকে খসে পড়া ডাল দিয়ে এক মনে ছবি আঁকছে পীচ ঢালা মেঝেতে।
মিসেস গ্রীনের ফোন পেয়ে স্কুল সাইকায়াট্রিস্ট মিস ফেল্ডম্যান এসে হাত ধরে আদর করে মারিয়াকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। বহুবার জানতে চাইলেন কি হয়েছে? কিন্তু মারিয়া বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে দুই হাত তুলে আস্তে করে বলে "আই দোন নো" যতবার জানতে চায় ওই একই জবাব। তারপর আবারো একথা সেকথা করে এক সময় জিজ্ঞেস করলেন 'মারিয়া ইউ লুক গ্রেট! হু ডিড ইওর হেয়ার? ইওর মাম?' অনেক বার জিজ্ঞেস করার পর মারিয়া জবাব দিলো 'সি ইজ গন!
মিস ফেল্ডম্যান তাকিয়ে আছে মারিয়ার দিকে। ওর চুলের উপর দিয়ে শিথি বরাবর বিড় বিড় করে হাঁটছে উকুন।