ঝর্ণা আক্তার

প্রকৃতি, মানুষের সরলতা আর ভালবাসেন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। মানুষের, যেখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন বৈষম্য, এমন দিনের স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত।

তুমি ছাড়া

-মিতু প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকাল, রাতে তোমার অবস্থা আমাকে জানাবে। আমি সবসময় চিন্তায় থাকবো, কখনো তো একা থাকো নি। আমাকে ছাড়া কোথাও যাও নি।  সাবধান হুটহাট করে দরজা খুলবে না। ভালো করে দেখে নিবে। অপরিচিত হলে দরজা খোলার দরকারও নাই। একটা মাত্র সপ্তাহ, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। বাজার তো করাই আছে, তবুও কিছু দরকার হলে দারোয়ানকে ফোন করবে। তোমার রেগুলার ঔষধ সব আছে তো? ভালো করে চেক করো, যদি কিছু দরকার হয় কিনে দিয়ে যাই।

-‎সব আছে, কেনো অতো চিন্তা করছো? তোমার সাথে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নেবে না?  প্লিজ।

-‎পাগল! রুমাটা এতো দেরি কেনো করছে? আসবে তো! তুমি কি আসতে বারণ করেছো? আমার রওনা হবার আগেই তো আসার কথা ছিল! আচ্ছা যাও, রুমা এরই মধ্যে এসে গেলে তোমাদেরকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নেবো।

-‎কেনো? শুধু আমি গেলে কি সমস্যা?

-‎তুমি একা ফিরবে? আমি চিন্তায় থাকবো না? না না, তা হবে না, এমনিতেই এই এক সপ্তাহ আমি ঘুমাইতে পারবো না। 

অভিমানে মিতুর গলা ভারি হয়ে আসে, আমাকে নিয়ে এতো কেনো ভাবো, আমি শিশু বা প্রতিবন্ধী?

-ওভাবে কেনো ভাবছো লক্ষ্মী। আমার ভালোবাসাটা দেখছো না!

- আমি তোমাকে ভালবাসি না? তুমি বাইরে থাকলে আমার চিন্তা হয় না? আর এখন তো হাজার হাজার মাইল দূরে যাচ্ছো। তবে কেনো আমাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিবে না।

-‎আরও কিছুটা সময় হাতে আছে, রুমা এসে গেলে, তোমাদেরকে নিয়ে যাবো কথা দিলাম। ওরা আসার আগে একটু আদর দিয়ে দেই, কাছে এসো।

মিতু সরে যায়, আকণ্ঠ অভিমানে ডুবে থাকে। মাসুদ মিতুকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ফেলে। মিতুর গাল বেয়ে অভিমান ঝড়ে পড়ে, মাসুদ সযত্নে মুছে দেয়। তক্ষুনি বেল বেজে উঠে, মিতু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। রুমা কি চলে এসেছে, মিতু তো ওকে আসতে নিষেধ করেছিলো। দরজা খুলেই দেখে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে।  

-ম্যাডাম গাড়ি নিয়ে আসছি, নিচে অপেক্ষা করছে।

-‎তুমি যাও, আসছি আমরা।

-‎মিতু রুমা এখনো কেনো আসছে না? তোমাকে একা বাসায় রেখে যাই কি করে? ওদেরকে আর একবার ফোন দিবে?

-কিছুক্ষণ আগেই দিলাম, ফোন ধরছে না দেখলেই তো? আর আমি এতোটা ছেলেমানুষ নই যে, একটা সপ্তাহ একা থাকতে পারবো না। মিছেমিছি ভেবো না।

-আসি তবে, ভালো করে দরজা আটকে দাও।

-আমি নিচ পর্যন্ত আসি।

-জেদ করো না, তোমাকে বাসায় রেখে গেলে যতোটা শান্তি পাবো, নিচে রেখে গেলে পাবো না।

মিতু আর কথা বাড়ায় না। মাসুদকে সে ভাল করে চেনে, যেই কথা সেই কাজ। ছলছল চোখে মাসুদকে বিদায় দেয়। মফস্বল শহরের মেয়ে মিতু, পড়াশোনা ও ওখানেই। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সাথে ঢাকায় আছে। বছর দুয়েক হবে, একবার, একটি বারের জন্যও একা কোথাও যায় নি। বাইরে তেমন যাওয়ার দরকার ও হয় না। আর যাওয়ার দরকার হলে মাসুদের বগলদাবা হয়ে যেতে হয়। দরজা বন্ধ করার পর অদ্ভুত এক আনন্দ তাকে আন্দোলিত করে। সে এখন স্বাধীন, কয়েকটা দিন সে নিজের মতো করে থাকবে, কারো অপেক্ষায় খাবার ঢাকা দিয়ে বসে থাকতে হবে না। সদ্য গোসল করা মিতুকে ভেজা চুলে দেখতে মাসুদ খুব পছন্দ করে। তাইতো ও ফেরার ঠিক আগে আগে তাকে আর একবার গোসল করতে হয়, গরম ভাপ উঠা ভাত খেতে মাসুদ পছন্দ করে, তাই মাসুদ খাবার টেবিলে বসার আগে আগেই তাকে ভাত রাঁধতে হয়। এসব কয়েকদিন করতে হবে না,  তাজা ফুলে সাজাবার জন্য ফুলদানিটা ও রেডি রাখতে হবে না কয়েকদিন। মাঝারি আওয়াজে গান ছেড়ে দেয় মিতু, গানের তালে, তালে, শরীর দোলাতে থাকে। তক্ষুনি বেল বেজে উঠে, বুকটা ধক করে উঠে….মামুন কি কিছু ফেলে গেছে? গান বন্ধ করে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। লুকিং গ্লাসে না দেখেই দরজা খোলে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না, হলো না, তার একা থাকা হলো না। রুমাকে এতো করে না করার পরও চলে এসেছে।

-কিরে, ভূত দেখলি নাকি, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো, ঢুকতে দিবি তো?  

রুমার বিচ্ছু দুইটা এরই মধ্যে মিতুকে ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকে গেছে। রুমার হাতে দুইটা ভারী ব্যাগ….বুঝলি তোকে যাতে কষ্ট করতে না হয়, তাই ব্যাগ  শুকনো খাবার, রান্না করা খাবার সব নিয়ে এসেছি। আর অরু, তরু তো সারাক্ষণ ছুটাছুটি আর খাওয়া নিয়েই আছে। আচ্ছা তোর মুখ শুকনা কেনো? মাসুদের বিরহে এখনি কাতর! 

একটু হেলদী রুমা, কথা বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে। মিতু স্বর্গ থেকে বাস্তবে আসে। এই শহরে রুমাই একমাত্র আপনজন, স্কুল ফ্রেন্ড, কাজিন ও। রুমাকে মন খারাপের কারণ বুঝতে দেয় না। অরু তরু এরই মধ্যে ঘর তছনছ করে ফেলেছে। করুক, এই এক সপ্তাহ এমনি থাকবে। মাসুদের জন্য সবসময় নিজেকে ও ঘরকে পরিপাটি রাখতে হয়, এই কয়দিন সেই দায় নেই। রুমা খাবারদাবার জায়গা মতো সাজিয়ে রাখে।বাচ্চাদেরকে থামানোর চেষ্টা করে না, করে লাভও নেই হয়তো।

বিষণ্ণ মিতু টিভি ছেড়ে বসে, অরু তরু রিমোট কেড়ে নিয়ে কার্টুন ছেড়ে দেয়। বাচ্চাদের খুব পছন্দের কার্টুন ডরিমন দেখছে। মিতু ডরিমন আর জাপানী বাচ্চাগুলার অদ্ভুত কাজে মনোনিবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যায়। কার্টুনটা এখন এশিয়ান টিভিতে দেখাচ্ছে। আর ঠিক তক্ষুনি একটা ব্রেকিং নিউজ --- এয়ারপোর্ট রোডে গাড়ি দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন ডাক্তার মাসুদুর রহমান আর ড্রাইভার মজনু। মিতু চোখ কচলে নিউজটা আবার দেখে, আবার দেখে, আবার দেখে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। মাসুদের দাফন হয়, কুলখানি হয়, লোকজনে বাড়ি গিজগিজ করে, আবার হালকা হয়, আবার কোথা থেকে একদল আসে, আবার কিছুটা হালকা হয়।

এইভাবেই চলছিলো কিছু দিন। তারপর শুধু মা থেকে গিয়েছিলো, আজ সেও চলে গেলো। কিছুতেই মিতুকে একা রেখে যেতে চায় নি, সাথে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মিতু কিছুতেই যাবে না। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাসুদের স্মৃতি। ফুলদানিতে বাসি ফুলগুলা শুকিয়ে গেছে, ওটার দিকে তাকালেও মাসুদকে দেখতে পায়। মা চলে যাবার পর আবার একবার স্বাধীনতার সুখ পায় সে, ঠিক মাসুদ যাওয়ার দিন যেমনটি পেয়েছিলো। এতো এতো মানুষের আসা যাওয়ায়, সে মাসুদকে হারানোর কষ্টটা যেন ঠিকমতো অনুভব করতে পারে নি, সে মাসুদের জন্য কাঁদার ও সময় পায় নি। কেনো এমন হলো, সে খুব লজ্জিত হলো। যেন মাসুদ সব দেখতে পাচ্ছে! কেনো সে কাঁদে নি, তার অবচেতন মন কি বুঝেছিলো- মাসুদের চলে যাওয়ার সাথে সাথে পরাধীনতার শিকল ও কেটে গেছে। মাসুদ কি সব বুঝতে পারছে! লজ্জা ও গ্লানিতে প্রথমবারের মতো তার চোখ জলে ভরে গেলো।  

2799 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।