সরকারের রঙ বদলেছে, নাম বদলেছে, মুখ বদলেছে। কিন্তু সরকারের চরিত্র কতটা বদলেছে সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আগের বাম সরকার যদি হার্মাদ, খুনি নিয়ে রাজত্ব করতো, তবে এখনকার তৃনমুল সরকারও নানান বিশৃঙ্খলতা নিয়ে, খুনোখুনি নিয়ে, রক্তারক্তি নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে একইরকম আগুন জ্বালানো পরিবেশ বজায় রেখেছে। যোগ্য উত্তরসূরি যাকে বলে। আমি আবেগে ভেসে তৃনমুল সরকারকে ভোট দিই, জানি কিচ্ছু পাল্টাবে না, একইরকমভাবে বাংলার পরিবেশ জ্বলবে। তবু অন্তত একটু আশায় ভোট দিই, ভাবি যে একেবারে সব খারাপ হওয়ার থেকে অন্তত যদি কিছুটা কম খারাপ হয়, তাতেও কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে। সে আশা আশাই থেকে যায়। পরিস্থিতি ভালো হওয়ার থেকে সময়ের সাথে জিলিপির মতো প্যাঁচালো হয়ে ওঠে। প্রগতি কিস্যু হয় না।
প্রসঙ্গ টানি সেই বিতর্কিত লেখকের, যার লেখা বইগুলির মূল্যায়ন হয় শুধুমাত্র লেখকের বিতর্কিত নামে। তাঁর বিতর্কিত লেখাগুলি কে কতটা আত্মস্থ করেছে এতদিনে, সেই নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই তো সেদিনের কথা, বাম আমলেই লেখকের "দ্বিখণ্ডিত"কে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলো। কারণ কিছু প্রগতিশীল লেখক সরকারের কাছে নিজেদের স্বাক্ষর ঘোষণা দিয়ে বলে দিলো "দ্বিখণ্ডিত"তে তাদের আপত্তি আছে। দ্বিখণ্ডিততে নাকি অশ্লীলতা আছে, মিথ্যে আছে, সাম্প্রদায়িক হিংসা আছে। সরকারও তালে তাল মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসার বাহানা দিয়ে বইটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলো পশ্চিমবঙ্গে।
কোর্টে কেস হলো, লড়াই চললো, অবশেষে দু’বছরের মাথায় কোর্ট কর্তৃক "দ্বিখণ্ডিত" মুক্ত ঘোষণা হলো। আদর্শ জিতলো, সত্য জিতলো, জিতলো লেখক তসলিমা নাসরিন। পরাজিত হলো সেইসব প্রগতিশীল লেখক, পরাজিত হলো সরকার, পরাজিত হলো সংখ্যালঘু কিছু মানুষের গুণ্ডামি। এই দু'বছরের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখকের চরিত্রকে ফালাফালা করা হয়েছে প্রগতিশীল সেইসব লেখকের কথাতে, লেখাতে। লেখককে যৌনপল্লীর এক নারীর সাথেও তুলনা টানা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নৈতিক জয়টা কিন্তু এই বিতর্কিত লেখকই পেয়েছেন।
এক বিতর্কিত লেখক, তার ওপর আবার সে একজন নারী যে ডানেরও খায় না, বামেরও খায় না, নিজের খায়, নিজের পরে। একজন শরণার্থী হয়ে এত দেমাগ! সরকারের বিষ নজরে সে পড়বে না তো কি খুনি, চোর, ডাকাত, গুণ্ডারা পড়বে? সিঙ্গুর কাণ্ডে ধামাচাপা দিতে হলে, ন্যানো কাণ্ড থেকে মানুষের মন ঘোরাতে হলে একজনকে জবাই করতেই হতো।
রিজওয়ান খুন নিয়ে তখন পার্কসার্কাস এলাকায় আগুন জ্বলছে। সরকারের নির্দেশে কিছু গুণ্ডাও নেমে পড়লো রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে, সংখ্যালঘু মানুষকে উস্কানি দিতে, খবর ঘোরাতে, তসলিমা নাসরিনের নিপাত চেয়ে। নতুন খবর হয়ে গেলো সংখ্যালঘু মানুষরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে লেখকের বিরুদ্ধে, শহর জ্বলছে। প্রথম অভিসন্ধিতে জিতলো সরকার। লেখককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে গোটা দেশের গায়েই সেদিন কলঙ্কের কালি লেপে দিয়েছিলো। শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তো নয়, এরপর গোটা ভারতেই লেখক নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সত্য থমকে যেতে পারে, সাময়িক হেরে যেতে পারে। সত্য কখনো চাপা থাকতে পারে না। লেখক কিন্তু হাল ছেড়ে দেয় নি। লড়াই করেছে, আবার ফিরে এসেছে তাঁর প্রিয় ভারত দেশে।
সরকার পাল্টে গেলো পশ্চিমবঙ্গে। নেতৃত্ব বদল হলো। একজন অসীম সাহসী নারী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসলো। লেখক তসলিমা নাসরিনও ভেবেছিলেন সময় পাল্টাচ্ছে, একজন মহিলা পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসছেন মানে নিশ্চয়ই অনেক ভালো কিছু হতে চলেছে। আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু যে কি সেই। হাত বদল হলেও চিন্তাভাবনা, আদর্শের কোনও বদল হলো না। বরং বাম সরকারের নীতিকেই বহন করে চললো "মা, মাটি, মানুষ"-এর সরকার।
সেই নীতিকে আরও একটা ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলো তসলিমা নাসরিনের "নির্বাসন" কে নির্বাসিত করে দিয়ে। সেদিন যখন আত্মজীবনীর সপ্তম খণ্ড নির্বাসনের প্রকাশ হতে চলেছে বইমেলার এ.সি. হলে, দুপুর তিনটের সময়, হঠাৎ করেই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার গিল্ডের সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এসে ঘোষণা করেন "একটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনের তরফ থেকে তার কাছে ফোন যায় যে তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ হলে বইমেলাতে তীব্র ঝামেলা সৃষ্টি করবে তারা, তাই লেখক তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ সম্ভব নয়।" ওই সংগঠন সেদিন প্রথমে লালবাজার পুলিশকে হুমকি দেয় ঝামেলা করবে বলে, তারপর গিল্ডের সাথে ফোনে কথা বলে। লালবাজার কর্তৃকও গিল্ডের কাছে ফোন করে "নির্বাসন" প্রকাশ বন্ধ করতে বলা হয়। এরপর "নির্বাসন"কে আর এ.সি. হলে প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। যদিও "পিপলস বুক সোসাইটি"র উদ্যোগে সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য বইটার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন বইমেলায় খোলা আকাশের নিচে। আবারও নৈতিক জয় পায় সত্য, নৈতিক জয় হয় বইমেলার, নৈতিক জয় হয় বইপ্রেমীদের। নৈতিক জয় পান লেখক তসলিমা নাসরিন। কিন্তু কিছু সংখ্যালঘু গুণ্ডার ভয়ে সেদিন কলকাতা পুলিশের মতো এত বড় বাহিনী চুপ হয়ে গেছিলো, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আসলে সংখ্যালঘুদের ভয়ে শুধু পুলিশ কেনো, সরকারও তটস্থ থাকে। যত যাই হোক, তসলিমা নাসরিন তো আর সরকারকে ভোট এনে দিতে পারতেন না। আর সংখ্যালঘুদের ভোট হারানোর মতো ভুল মুখ্যমন্ত্রী কখনো করতেন না। আদর্শ, সত্য চুলোয় যাক, মানুষ রাজনীতিকদের কাছে একটা ভোট গননার সংখ্যা, যেটা ওদের জিততে হবে।
তসলিমা নাসরিন বরাবর মানুষের মনে নৈতিক জয় পেয়েছেন। মানুষের ভালোবাসায় রাজত্ব করেছেন। আমি বিশ্বাস করি তসলিমা নাসরিন ফিরবেনই এই বাংলায়। নৈতিকতাতেই উনি জিতে ফিরবেন এই দৃঢ় বিশ্বাস মনের মধ্যে পোষণ করি।
"বাংলা সেদিন রাজনীতির মঞ্চ নয়, বাংলা সেদিন মানুষ হবেই"।