ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

তোমারে বধিবে যে, সন্তর্পণে বাড়িছে সে

১৯৬৫ সালে রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব নেন নিকোলা চসেস্কু। এখান থেকেই তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের সূত্রপাত। আড়াই দশক ধরে তিনি নিজেকে নির্মম কম্যুনিস্ট ডিক্টেটর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ক্ষমতায় আসার পরের বছরেই রোমানিয়াতে গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করেন তিনি। রোমানিয়ার নিম্ন জন্মহারকে দ্রুত বৃদ্ধি করার জন্য এই পদক্ষেপ নেন তিনি। পাঁচ সন্তানের মায়ের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। দশ সন্তানের মা হলে তাকে হিরোইন মা হিসাবে ভূষিত করারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রোমানিয়ার জনসংখ্যাকে দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে একে একটা শিল্পোন্নত এবং শক্তিশালী দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হিসাবে এইসব কাজ করা হয়।

চসেস্কু বলেন, 'ভ্রুণ হচ্ছে সমাজের সম্পদ। যে লোক সন্তানের পিতা-মাতা হতে চাইবে না সে দেশের আইন অমান্য করবে এবং অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হবে।'

১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার গর্ভপাত আইন সারা বিশ্বের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উদার ছিলো। রোমানিয়ার জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের এই উদারতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। চসেস্কু শুধুমাত্র গর্ভপাতকেই অবৈধ ঘোষণা করলেন না, একই সাথে জন্ম নিয়ন্ত্রণের সব উপাদান এবং যৌন শিক্ষাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সরকারী এজেন্টরা অফিসে প্রায়ই নারী কর্মচারীদের এক জায়গায় জড়ো করে তাদের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতো। এই এজেন্টদের লোকজন মজা করে মিনস্ট্রুয়াল পুলিশ হিসাবে নাম দিয়েছিলো। এই এজেন্টদের প্রেগন্যান্সি টেস্টে কোনো নারী যদি একাধিকবার নেগেটিভ প্রমাণিত হতো, তবে তার উপর কৌমার্য ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া হতো।

চসেস্কুর এই সব কর্মকাণ্ড দ্রুত তাঁর আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনলো। গর্ভপাত নিষিদ্ধ হবার মাত্র এক বছরের মধ্যেই রোমানিয়ার জন্মহার দ্বিগুণ হয়ে গেলো। অসংখ্য শিশু জন্ম নিতে থাকলো অকাতরে। অনেক বাবা-মাই সন্তান জন্মের পরে তাদের ভরণ-পোষণে অক্ষম হয়ে পরিত্যাগ করা শুরু করলো। অনাথ শিশুর সংখ্যাধিক্যে অসংখ্য অনাথ আশ্রম গড়ে উঠলো রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। যে সব শিশুরা বাবা-মায়ের সাথে ছিলো, তাদের অবস্থাও যে খুব ভালো ছিলো, তা নয়। ভয়াবহ দারিদ্রের কারণে করুণ এক জীবন যাপন করতে হচ্ছিলো তাদের। গর্ভপাত নিষিদ্ধের পরে যে শিশুরা জন্মালো, তারা স্কুলে খারাপ ফলাফল করতে থাকলো। চাকরির ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না তারা, শিক্ষাদীক্ষার অভাবে। এরকম একটা দুর্বিষহ জীবনের অধিকারী হবার কারণে এদের অনেকেই পরবর্তীতে অপরাধ জগতে পা বাড়ালো।

১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ষোলো তারিখে টিমিসোয়ারার রাস্তায় নেমে আসে লক্ষ লক্ষ মানুষ। উদ্দেশ্য একটাই। স্বৈরাচারী চসেস্কুর পতন চায় তারা। এই আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো, তাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। সতেরো তারিখে তিমিসোয়ারাতে চসেস্কুর বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের উপরে। এতে করে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। এই অবস্থাতে আঠারো তারিখে চসেস্কু তাঁর অনুগত জেনারেল এবং স্ত্রী এলেনাকে আন্দোলন থামানোর নির্দেশনা দিয়ে ইরান ভ্রমণে যান।

ইরান থেকে ফিরে এসে ডিসেম্বরের একুশ তারিখে বুখারেস্টে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে আসেন চসেস্কু। কিন্তু, জনতা তিমিসোয়ারার গণহত্যার কথা ভোলে নি। তারা তিমিসোয়ারার নাম উচ্চারণ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দলবদ্ধভাবে আক্রমণে আসে তারা। জনতাকে নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হয়ে ভয়ে ভীত চসেস্কু আশ্রয় নেন কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে। পরের দিন এক বিলিয়ন টাকা আর স্ত্রী এলেনাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান চসেস্কু। এর কয়েকদিন পরে অবশ্য ধরা পড়েন তিনি স্ত্রীসহ। ডিসেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখে চসেস্কু এবং এলেনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়।

চসেস্কুর পতনের পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলো রোমানিয়ার হতাশ এক তরুণ জনগোষ্ঠী। এদের অধিকাংশেরই জন্ম হতো না, যদি না চসেস্কু গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করতেন ১৯৬৬ সালে। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে! যাদের জন্মের পিছনে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তাদের কারণেই তার বিনাশ ঘটেছিলো এই ধরা থেকে।

তাইতো বলি, ওহে স্বৈরশাসন, শোনো দিয়া মন। তোমারে বধিবে যে, সন্তর্পণে বাড়িছে সে।

1799 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।