২রা নভেম্বর, ২০০৪ সাল।
স্নিগ্ধ সকালে এমস্টারডার্মের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে অলস ভঙ্গিতে সাইকেল চালিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছেন থিও ভ্যান গগ, মাঝবয়েসী হাসি-খুশি একজন মানুষ। হল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের প্রপৌত্র তিনি। প্র-পিতামহের মতো তিনি অবশ্য অঙ্কন শিল্পী হন নি। তাঁর বদলে সেলুলয়েডের শিল্পী হয়েছেন। তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। কয়েক মাস আগে মুক্তি পেয়েছে তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্র সাবমিশন। মুক্তির পরই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এই চলচ্চিত্র। হয়তো এই চলচ্চিত্র কিংবা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তায় মশগুল ছিলেন তিনি। এমন নির্মল পরিবেশে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে, সে চিন্তা তাঁর মাথাতেও আসে নি। সে কারণে মুহাম্মদ বোয়েরি নামের ছাব্বিশ বছরের এক মরোক্কান-ডাচ যুবক যে অস্ত্র হাতে ছুটে আসছে তাঁর দিকে ছুটে আসছে, সে খেয়ালই ছিলো না তাঁর।
থিও যখন আততায়ীকে দেখতে পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কাছে এসেই থিওকে গুলি করলো বোয়েরি। গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। হাচড়ে পাচড়ে উঠে রক্তাক্ত শরীরে পাশের বিল্ডিং এর দিকে ছুটতে থাকলেন থিও। আহত শরীরের শ্লথগতি কাল হলো তাঁর। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘাতক চলে এলো তাঁর খুব কাছে। আর কোনো উপায় না দেখে ঘাতকের কাছে করুণা ভিক্ষা করলেন তিনি, ‘প্লিজ, আমাকে মেরো না। এসো আমরা কথা বলি। ‘তাঁর এই করুণা ভিক্ষায় কোনো কাজ হলো না। কাজ হলো না আলোচনার আহবানেও। খুব কাছে থেকে থিওকে আবার গুলি করলো মরোক্কান ছেলেটা। মৃত্যু নিশ্চিত করেও কাজ শেষ হয় না তার অবশ্য। পকেট থেকে ছুরি বের করে প্রবল ঘৃণা আর নৃশংসতায় থিও-র গলা কেটে মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সে। তারপর একটা চিঠি থিও-র বুকের উপরে রেখে ছুরি দিয়ে বিদ্ধ করে।
থিও-র হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুরো একটা অধ্যায় লিখেছেন আয়ান হারসি আলি তাঁর বই “ইনফিডেল”-এ। সেটাই অনুবাদ করছি আমি। আজকে এর প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো। এ বিষয়ে পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা পেলে খুশি হবো।
………………………………..
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে পুলিশ একজন মরোক্কান তরুণকে গ্রেফতার করে। এই তরুণ আমার ঠিকানা অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। সে অদ্বিতীয় আল্লাহ-র অনুসারীদের হর্ষোৎফুল্ল হতে বলেছিলো, কারণ আমার চলাফেরাকে দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করে, আল্লাহর অসীম কৃপায় সে আমার ঠিকানা জোগাড় করতে পেরেছে। আমি তখন ইসরায়েলি দূতাবাসের পিছনের একটা ছোট্ট রাস্তায় থাকতাম। তার বার্তার সাথে আমার আর থিও-র ছবিও দিয়েছিলো এবং মূলত যা বলতে চেয়েছিলো সেটা হচ্ছে আমাকে এবং থিও, দুজনকেই মুরতে হবে।
আমি এই ঘটনা জানতে পারি সাংবাদিকদের কাছ থেকে। ঘটনা ঘটার পর থেকে তাঁরা আমাকে কল দেওয়া শুরু করেছিলো। কয়েকদিন পরে দু’জন পুলিশ আমার সাথে দেখা করতে আসে। তারা আমাকে গ্রেফতার করা ওই তরুণের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানাতে বলে। আমি সেটা করি। আমি শুধু পুলিশদেরই নয়, যাদেরকেই মনে হয়েছে বলা দরকার, সবাইকেই বলেছি যে থিও-র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সাবমিশন তৈরি করার পরে আমার সাথে থিও-র আর দেখা হয় নি। কিন্তু, আমরা মাঝে মাঝেই ফোনে কথা বলতাম। তার পুলিশি নিরাপত্তা নেওয়া উচিত আমার এই আবেদনে সে সাড়া দিতো না। আমি বললে বরং সে পরিহাস করতো। বলতো, “আয়ান, তোমার কোনো ধারণাই নেই আমার ব্যাপারে। গত পনেরো বছর ধরে হুমকি নিয়েই বেঁচে আছি আমি। ইহুদি, খৃস্টান, সোশ্যাল ডেমোক্রেট, মুসলমান, সকলেই আমাকে হুমকি দিয়েছে। সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমার কিছুই হয় নি। ভবিষ্যতেও আমার কিছু হবে না।”
গত দুই বছর ধরেই আমি সশস্ত্র দেহরক্ষীর মাধ্যমে নিরাপত্তা পাচ্ছিলাম। থিও আমার মতো নিরাপত্তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। আমি সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতাম এই ভেবে যে, বাড়ি ফেরার সময় কোনো এক রাতে কোনো এক গলিতে কেউ হয়তো তাকে আটকে ফেলবে, তারপর মারধোর করবে। কিংবা তার বাড়িতে জানালা দিয়ে পাথর ছুড়ে মারবে। এই ধরনের কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু, এটা আমার স্বপ্নেরও বাইরে ছিলো যে কেউ একজন প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে জবাই করবে, তাকে গুলি করবে এবং তার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে রাখবে।
সপ্তাহ গড়িয়ে যায়। আমার বা থিও-র ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে না। আমরা সাবমিশনের কথা ভুলি নাই। বিদেশি সংবাদমাধ্যম, যারাই সাবমিশন চলচ্চিত্রটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতো, তাদের সাথেই কথা বলতাম আমি। কিন্তু, এগুলো বাদ দিলে সেই শরতে জীবন ছিলো শান্তিময় এবং স্বস্তিপূর্ণ। আমি সংসদে আমার দ্বিতীয় অধিবেশনে মনোযোগ দিয়েছি। আমার একটা বাড়ি ছিলো, একটা চাকরি ছিলো, কিছু বন্ধুবান্ধব ছিলো এবং এগুলো আমাকে পরিতৃপ্ত করে রেখেছিলো। রাজনীতিতেও ধীরে ধীরে আমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছিলো। ডাচ রাজনীতিতে নামার পর থেকে এই প্রথম আমি এক ধরনের সন্তুষ্টি অনুভব করছিলাম আমার মনের মাঝে।
নতুন পাওয়া এই প্রশান্তি থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার সময়গুলোকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। সবকিছুতেই আমি দেরি করে ফেলছিলাম। এটা থামানো দরকার। লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার আমার এবং শুধুমাত্র সেই প্রকল্পগুলোই করা উচিত যা সেই লক্ষ্য পূরণে কাজে লাগবে। নভেম্বরের এক তারিখ সোমবারে আমি রিক নামের একজন প্রশিক্ষককে নিয়োগ দিলাম। রিক, আমার সংসদীয় সেক্রেটারি আইরিস এবং আমি মিলে নতুন একটা ওয়ার্কিং প্লান তৈরি করলাম। এই ওয়ার্কিং প্লান অনুযায়ী সবকিছু সঠিক সময়ে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কোনটা কোনটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটা তালিকা করা হলো। প্রতি সপ্তাহে আমাদের আনুষ্ঠানিক মিটিং হবে এবং সেখানে কেউ সেলফোন ব্যবহার করবে না, এটাও সিদ্ধান্ত হলো।
পরের দিন, নভেম্বরের ২ তারিখ মঙ্গলবারে, আমি আমার অফিসে ছিলাম। আমাদের ওয়ার্কিং প্লানের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি সকাল সকালই অফিসে এসে হাজির হয়েছি। কফি হাতে নিয়ে অসংখ্য জিনিস নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত। আমি এবং আইরিস লিবারেল পার্টির প্রেস সেক্রেটারি ইনগ্রিডের আসার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার ফোনের আলো জ্বলতে শুরু করলো। একটা নাম্বার ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। হুগোর নাম্বার। হুগো একটা তরুণ ছেলে। এক সময় আমার সংসদীয় সেক্রেটারি ছিলো। এখন এমস্টারডামের লিবারেল মিউনিসিপাল কাউন্সিলরদের হয়ে কাজ করে। আমি আমাদের ওয়ার্কিং প্লান মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফোনটা না ধরে কেটে দিলাম আমি।
ফোনের আলো আবার জ্বলতে নিভতে শুরু করলো। আবারও হুগো। কী ঘটছে? আবারও ফোন বেজে উঠলো। আমি বারবার তার ফোন কেটে দিচ্ছি। আমি আমাদের নতুন পরিকল্পনায় কতোখানি স্থির সংকল্প সেটাই দেখাতে চাচ্ছিলাম আমি। এর মাঝেই ইনগ্রিডের ফোন এলো। আমি ভাবলাম মিটিং এ দেরিতে আসার জন্য ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফোন করেছে সে নিশ্চয়। তার পরিবর্তে সে বললো, “হুগো তোমাকে ফোনে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে বলেছে থিও ভ্যান গগের খারাপ কিছু ঘটেছে। তার উপর আক্রমণ হয়েছে।”
আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। করিডোর দিয়ে ছুটে লিবারেল ককাসের সেক্রেটারি আর্থার অফিসের দিকে ছুট লাগালাম। আর্থা-র অফিস আমার অফিসের চেয়ে অনেক বড়। তার অফিসে একটা টেলিভিশন আছে। এটা সারাদিনই চালু থাকে, টেলিটেক্সট দেখায়। আমি হুড়মুড় করে তার অফিসে ঢুকে বললাম, “থিও ভ্যান গগের কিছু একটা ঘটেছে। সে বোধহয় ভালো নেই - “আমি জানি না আমি কী বলছিলাম। সে খবর দেখার জন্য টেলিভিশনের দিকে ঘুরলো। টেলিভিশনের টেক্সট শুধু বলছে, এমস্টারডামে একটা গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আমি বললাম, “তাহলে মনে হয় তেমন কিছু হয় নি থিও-র।” কিন্তু আমার শরীর কাঁপছিলো। আর্থা বললো, “তোমার নিরাপত্তার লোকদের কল দাও। কিছু ঘটে থাকলে তাদের জানার কথা।” আমার নিরাপত্তার লোকেরা আমাকে সংসদ অফিসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েই চলে যেতো। আমার অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা তাদের ছিলো না। আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র গার্ড ব্রামকে আমি কল দেবার জন্য ফোন তুলতেই ব্রাম আমার পাশে এসে হাজির হলো। সে কোথা থেকে এলো কে জানে?
“থিও ভ্যান গগের কিছু ঘটেছে বলে আমি শুনেছি।” আমি বললাম।
“”আমি নিশ্চিত করতে পারি।” ব্রাম বললো।
“সে কি ঠিক আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না, থিও ভ্যান গগ মারা গেছে।” ব্রাম বললো।
(চলবে)