ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

থিও হত্যাকাণ্ড –(শেষ পর্ব) মূলঃ আয়ান হারসি আলি

নিহত হবার এক সপ্তাহ পরে থিও-র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবার কথা। নিরাপত্তা কর্মীরা আমাকে জানালো, আমি যদি খুব চাপাচাপি করি, সেক্ষেত্রে তারা হয়তো আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাবার ব্যবস্থা করে দেবে। তবে, এটাও বললো যে আমার উপস্থিতি অন্যদের জন্য বিপদের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে। আমি সেখানে না যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাবমিশন তৈরি করার জন্য থিও নিহত হয়েছে, এই অপরাধবোধ নিয়ে আমাকে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে। এখন, অন্যদের জীবনকে আমি ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।

কিন্তু, আমি থিও-কে শেষবারের মতো খুব দেখতে চাচ্ছিলাম। চাচ্ছিলাম তাকে শেষ বিদায় জানাতে। নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে এমস্টারডামের মর্গে নিয়ে যেতে রাজি হলো। অনেকগুলো গাড়িতে অসংখ্য অস্ত্রধারী নিরাপত্তাকর্মী বেষ্টিত হয়ে আমি মর্গে গেলাম। আমি যখন মর্গে গেলাম, তখন সেখানে থিও-র সবচেয়ে ঘণিষ্ঠ বন্ধু থিওডর হলম্যান এবং সাবমিশনের প্রযোজক গিজস ভ্যান ওয়েস্টারল্যাকেনও ছিলো। থিও-র শরীরে সন্ত্রাসের কোনো চিহ্নই নেই। সে সবসময় যেমন পোশাক পরে, সেরকম পোশাকেই শুয়ে রয়েছে। কলারওয়ালা সোয়েটার আর ঢিলেঢালা প্যান্ট পরনে তার। আমি তার শরীরে আক্রমণের চিহ্ন খুঁজলাম। কিছু নেই। তার মুখমণ্ডল মসৃণ। কোনো আঘাতের চিহ্নতো দূরের কথা, কোনো ব্রণের দাগও নেই সেখানে। তার বন্ধ ঠোঁটের কোণে সামান্য একটু বিদ্রূপের হাসি ফুটে আছে শুধু। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড প্রশান্তিতে রয়েছে সে। এই একবারই তাকে আমি শান্ত আচরণ করতে দেখলাম, নিশ্চুপ থাকতে দেখলাম। আমি তার কাঁধ স্পর্শ করলাম। তারপর কপালে চুমু খেলাম। ফিসফিস করে বললাম, “আমি যে অন্যায় করেছি, তার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত আমি।”

“না, আয়ান। থিও যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে তুমি যা বলছো সেটা শুনলে সে আঘাত পেতো।” থিওডর হলম্যান বললো। “সে বিছানায় শুয়ে মরতে চাইতো না। সাবমিশন তৈরি করার সময় সে নিজেকে ঘোড়ার পিঠে চড়া নাইট ভেবেছে। যে বাক স্বাধীনতার জন্য সে বেঁচে ছিলো, সেই বাকস্বাধীনতা আদায়ের যুদ্ধেই সে মারা গেছে। ক্যান্সারে কিংবা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যাবার চেয়ে এটা অনেক ভালো মৃত্যু। অনেক অর্থপূর্ণ এই মৃত্যু। সে আমার বন্ধু। আমি চাই না তার এরকম মৃত্যু নিয়ে তুমি দুঃখিত হও।”

আমি জানি, আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য থিওডরের এটা সদয় আচরণ। আমি থিওকে বিদায় জানালাম। থিও পরকালে বিশ্বাস করতো না। আমিও পরকালে বিশ্বাস করি না। এটাই থিও-র জীবনের শেষ, ভাবলাম আমি।

মর্গ থেকে বের হবার পরে, হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে থিওডর এবং গিজস এর সাথে কফি খেলাম আমি। তারা দুজনে ঠাট্টা-তামাশা করে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করতে লাগলো। পাগলাটে স্বভাবের প্রিয় বন্ধুর বিয়োগ ব্যথাকে সামাল দেবার জন্য এটাই ছিলো তাদের নিজস্ব কৌশল। তারা এবং থিও-র অন্যান্য বন্ধুরা আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলো, এটাও বললো তারা আমাকে। কিন্তু, আইরিস খুব সম্ভবত তাদেরকে ভুল নাম্বার দিয়েছিলো। কারণ ওই নাম্বারে কল করলেই বলছিলো সেটা নাকি ওয়েন্সড্রেক্টের এয়ারফোর্স বেজ।

“ও, ওইখানেই তাহলে আমাকে রাখা হয়েছে।” আমি ভাবলাম। ওয়েন্সড্রেক্ট এয়ারফোর্স বেজটা বেলজিয়াম সীমান্তের কাছে। আমরা ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতেই আমি সিনিয়র নিরাপত্তাকর্মীকে বললাম, “আমি জানি আমরা কোথায় যাচ্ছি। এটা ওয়েন্সড্রেক্ট।” সিনিয়র নিরাপত্তাকর্মী আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “ওখানে আর যাচ্ছি না আমরা।” থিওডরের কাছে আমার নাম্বার আছে এটা জানতে পেরে প্রচণ্ড রকমের ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো সে। আমাকে কড়া গলায় বললো “তোমাকে কে অনুমতি দিয়েছে তথ্য ফাঁস করার?” এর পর থেকে আমার ফোন নাম্বার পাবার অধিকার আর কারো রইলো না।

মর্গে থিও-র লাশ দেখার পরের দিন, আমাকে হুগারহাইডের পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রশিক্ষণার্থী পুলিশদের একটা কিউবিকলে আমার শোয়ার ব্যবস্থা হলো। এখানেও উলের কম্বল দেওয়া হলো আমাকে। উলের কম্বল এবং দুঃস্বপ্নের অত্যাচারে আমার মাথা এবং চোখ ফুলে উঠলো। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে অবিরত। সোমরার সকালে আমাকে ওখান থেকেও বের হয়ে আসতে হলো। প্রশিক্ষণার্থী পুলিশেরা সকালে প্রশিক্ষণের জন্য এসে হাজির হবে। এরা আমাকে দেখে ফেলতে পারে। নাটাইয়ের মতো এখানে সেখানে ঘুরছি আমি। ঘুমোতে পারছি না ঠিকমতো। এখানে আমাকে থাকতে দেবার জন্য অনুরোধ জানালাম আমি। সিনিয়র নিরাপত্তাকর্মী বললো, “আমরা এই প্রশিক্ষণার্থীদের সবাইকে বিশ্বাস করতে পারি না। এরা এখনো পুরোদস্তর পুলিশ হয়নি।”

সোমবার খুব সকালে নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে এলো। লিবারাল ককাসের নেতা জোজিয়াস ভ্যান আর্টসেন হচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি একটা রুমে আমার বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। এটা নিরাপদ এবং গোপন জায়গা। সংবাদপত্রের লোকদের কোনো চাপ এখানে নেই। আমার সংসদীয় সহকারী আইরিসকে এখানে এসে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হলো। এর বাইরে আমাকে শুধু একটা ফোন আর টেলিভিশন দেওয়া হলো।

তারা আমাকে কোনো ইমেইল পাঠাতে নিষেধ করলো। এটা নাকি ট্রেস করা যায় (কয়েকদিন পরে তারা আমার সেলফোনটাও নিয়ে গেলো এই বলে যে এটাও নাকি ট্রেস করা সম্ভব)। আমি কৌতুহল বশে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা নিশ্চিত যে এই লোকগুলোর এই সব করার মতো সক্ষমতা আছে?” হল্যান্ডের ইসলামী মৌলবাদীদের লো টেক বিচ্ছিন্ন একটা অভিবাসী গ্রুপ ছাড়া আমার কাছে আর কিছু মনে হয় নি কখনো। সেলফোন ট্রেস করার মতো যন্ত্রপাতি থাকতে গেলে সংগঠনকে অনেক বেশি সংগঠিত হতে হয়। নিরাপত্তাকর্মীরা বললো, “আমরা কোনো সম্ভাবনাকেই বাতিল করে দিতে পারি না।” এটাই এদের জপমন্ত্র। কিছু বললেই বলে, “আমরা কোনো সম্ভাবনাকেই বাতিল করে দিচ্ছি না।”

আমি ওই অফিসে বসে থাকলাম। প্রতিটা পত্রিকায় ছাপা হওয়া সব চিঠি পড়লাম, টিভি দেখলাম এবং আমার ইমেইল একাউন্টে গেলাম ইমেল পড়ার জন্য। উত্তর আফ্রিকার দশজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে এমস্টারডামে। এখানে টেরোরিস্ট সেল রয়েছে, এই আলোচনাও হচ্ছে সবখানে। সপ্তাহান্তে চারটে মসজিদ এবং দুটো চার্চকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রবিবার রাতে আইন্ডহোভেনের কাছে অবস্থিত উডেনের একটা মুসলিম প্রাথমিক স্কুলে আগুন ধরিয়ে তা ছারখার করে দেওয়া হয়েছে।

পরেরদিন থিও-কে দাফন করা হবে, এটাই শুধু মাথায় ঘুরছিলো আমার।

মঙ্গলবার থিও-র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি দেখলাম আমি। খুবই আবেগময় হলো তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রাম পেপার চমৎকার বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন যে কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বেশি শোকাবহ এবং ধাক্কা খাবার মতো ঘটনা হচ্ছে থিও-র হত্যাকাণ্ড। কারণ, রাজনৈতিক কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই, যে কোনো দিন কোনো পদের আকাঙ্ক্ষা করে নি, এমন একজনকে হত্যা করা হয়েছে। থিও-র বাবা বিনয় দেখালেন, তবে একই সাথে তিনি শির উঁচু করেও থাকলেন। থিও-র মা যুদ্ধংদেহী আচরণ করলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, থিও-র মৃত্যুতে আমার অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই। কেননা সে গত পনেরো বছর ধরেই হুমকি পেয়ে আসছিলো। তিনি আমার নাম ধরে ডেকে সরাসরিই কথাগুলো বললেন। তিনি বললেন, আমাকে অবশ্যই আমার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এরকম একটা বিপর্যয়ের সময়েও তিনি আমাকে স্মরণ করেছেন, এটা ভেবে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম। তাঁর জন্য আমার খুব খারাপ লাগতে লাগলো। থিও-র বাবার জন্যেও। বেচারা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তবে, সবচেয়ে বেশি আমার খারাপ লাগতে লাগলো থিও বারো বছর বয়েসী ছেলেটার জন্য। বাবা ছাড়াই বড় হতে হবে তাকে।

কয়েকদিন পরে আমি থিও-র পরিবারকে একটা চিঠি লিখলাম। এটা পাঠানোর আগে নিরাপত্তাকর্মীরা খুব ভালোভাবে তা পড়ে দেখলো। আমি কোথায় আছি, সেটা এই চিঠি পড়ে বোঝা যাবে কিনা, সেটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো তারা।

 

1495 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।