ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

থিও হত্যাকাণ্ড –(পর্ব-৩) মূলঃ আয়ান হারসি আলি

পরের দিন সকালে নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে জানালো আমাকে আমার বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে সরিয়ে নেবার নির্দেশ এসেছে। ওরা আমাকে দ্রুত গাড়িতে তুলে নিলো। সামনে পিছনে গাড়ির বহর নিয়ে তারা আমাকে নিয়ে লুকিয়ে ফেললো এমন একটা জায়গায় যেটা আমি নিজেও চিনি না। দেখে মনে হলো কোনো এয়ার ফোর্স বেজ হবে সেটা। আমাকে তারা সতর্ক করে দিয়ে বললো, এখন থেকে আমি কোথায় আছি, সেটা পুরোপুরি গোপন রাখতে হবে। যদি কোনো কারণে আইরিসের আমাকে ফোন করা লাগে সেজন্য তারা তাকে দেবার জন্য আমাকে একটা ফোন নাম্বারও দিলো। আমার ফোন যাতে আমি ব্যবহার না করি সে ব্যাপারেও পরামর্শ দিলো তারা আমাকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে আমি কোথায় আছি, সেটাও জানানো হলো না আমাকে।

এয়ার ফোর্স বেজে যাবার পথে আমরা অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী জোহান রেমকেস এর অফিসে থেমেছিলাম। ইন্টিগ্রেশন মন্ত্রী রিটা ভারডংকও সেখানে ছিলো। দেখলাম তার চোখও ভেজা আমারই মতো। রিটা অত্যন্ত শক্ত নারী। কিন্তু, সে সব সময় আমার প্রতি সদয় আচরণ করেছে। রিটা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আবার কেঁদে ফেললাম। কিছুক্ষণ পরে জোহান বললো, “তোমাকে একটা জিনিস আমি দেখাতে চাই। কিন্তু তুমি কি এর জন্য প্রস্তুত আছো?”

“থিও-র মৃত্যুতে বিশাল ধাক্কা খেয়েছি আমি। আমি শোকে কাতর। আমি তোমাদের উপর ক্ষিপ্ত তাকে রক্ষা করতে না পারার জন্য। কিন্তু আমার মাথা পরিষ্কার।” জোহান আমাকে একটা চিঠির ফটোকপি আমার হাতে তুলে দিলো। সে অবশ্য বললো না যে এই চিঠিটা থিও-র বুকে ছুরি দিয়ে গেঁথে দিয়েছিলো তার হত্যাকারী। আরবি এবং ডাচ ভাষায় লেখা চিঠিটার কয়েক পৃষ্ঠা শুধু সে তুলে দিলো আমার হাতে।

আমি সবগুলো পৃষ্ঠাই পড়লাম মন দিয়ে। খুবই গুছিয়ে লেখা চিঠি। চিঠির বক্তব্য ফতোয়ার মতো একেবারেই পরিষ্কার। এর শুরু হয়েছে পরম করুণাময় এবং পরম ক্ষমাশীল আল্লাহ-র নামে। এর পরেই নবি মোহাম্মদের একটা বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। তারপরই রয়েছে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে আমার করা যাবতীয় ‘অপরাধের’ সারাংশ। এর পরে রয়েছে কোরানের একটা আয়াত এবং সেই আয়াতের ভিত্তিতে চিঠি লেখকের আমার প্রতি চ্যালেঞ্জ। আমি আমার কৃত অপরাধের জন্য মরতে প্রস্তুত কিনা, যেমনটা সে প্রস্তুত রয়েছে তার বিশ্বাসের জন্য। শুধু এগুলোই নয়, পত্র লেখক তার পত্রে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, হল্যান্ড এবং আমাকে শাপ-শাপান্ত করেছে চিঠিতে। চিঠির শেষে নিজের নাম হিসাবে লিখেছে ‘সোর্ড অব ফেইথ’ বা ‘বিশ্বাসের কৃপাণ’।

“কে লিখেছে এই চিঠি?” আমি জিজ্ঞেস করি। আমি তখন হাঁপাচ্ছিলাম। চিঠিটা মূর্তিমান এক শয়তান। এর কোনো চেহারা নেই অবশ্য। চিঠিটা যদি হল্যান্ডের বাইরের কোনো শক্তিশালী ব্যক্তির লেখা হয়, যার অসংখ্য অনুগত জেহাদি সৈন্য রয়েছে, তাহলে আমার জন্য অত্যন্ত আশংকার একটা বিষয়। রেমকেস বললো যে চিঠিটা থিও-র শরীরের উপর পাওয়া গেছে। সাথে শহিদ হওয়ার বিষয়ে একটা কবিতাও ছিলো।

আমি সেই রাত এবং পরের রাত এয়ারফোর্স বেজেই কাটালাম। ব্যারাকের অব্যবহৃত একটা কক্ষে আমার শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ধূলিধূসরিত কক্ষ। দুটো পাতলা লোহার খাট ছিলো রুমে। সাথে উলের কম্বল। উলের কম্বলে আমার এলার্জি রয়েছে। করিডোরের দিকে ছোট্ট জানালা রয়েছে। সেখানে সারারাত নিরাপত্তাকর্মীর অবস্থান নিয়েছে। পুরো এলাকা জুড়ে সৈন্য দিয়ে বোঝাই। জানালার পর্দা নামিয়ে রাখতে বলা হয়েছিলো আমাকে। আমি কোথায় আছি, সেটা কারোরই জানার কথা না। এমনকি এয়ার বেজের লোকরাও যেন আমার উপস্থিতি জানতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে।

সেই রাতেই উট্রেক্টে নির্মাণাধীন একটা মসজিদকে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। পুরো দেশটাই উন্মাদনায় ভুগছে। থিও-র মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ঘটছে সব কিছু। আবেগীয় অবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে পুরো দেশ। কিন্তু আমি অসাড় হয়ে পড়ে আছি। থিও-র মৃত্যুর পর থেকে হতবিহবল অবস্থা যাচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে শর্ট সার্কিট হয়েছে আমার। আমার মস্তিষ্কের চিন্তা করার জায়গার কিছুটা অংশ অকার্যকর হয়ে গেছে তাতে।

আমাকে যা করতে বলা হয়েছিলো তাই করলাম। স্বাভাবিক সময়ে আমি যা করি না, সেগুলোও করলাম আমি। আমি পরের আড়াইটা মাস একা একা নিরাপত্তাকর্মীদের আশ্রয়েই থাকলাম। কোনো বন্ধু-বান্ধব বা সংসদের কোনো সহকর্মী, কারো সাথেই আমার কোনো যোগাযোগ রইলো না। ধীর-স্থির এবং শান্ত হয়ে গিয়েছি আমি, মেনে নিচ্ছি সবকিছুকেই। যেন আমার নিজস্ব ইচ্ছা কী, সেগুলোকে ভুলে গেছি আমি।

থিও-র সাথে আমিও মারা যেতে পারতাম। এটাই ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে আমাকে। মরার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। যারা আমাকে রক্ষা করছে, তাদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আমি। আমাকে রক্ষা করাটা খুব সহজ কোনো কাজ না। অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করছে তারা। যদিও থিও-কে রক্ষা করা হয়নি বলে আমি ক্ষিপ্ত, তারপরেও এরা আমাকে যা করতে বলছে, সেটা করতে আপত্তি করছি না আমি। কী কারণে কী করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে তারা সেটা জানে। সেটার মাধ্যমেই আমার জীবন বাঁচাচ্ছে তারা।

তবে, আমার চিন্তাশক্তি যদি পূর্ণভাবে কাজ করতো, সেক্ষেত্রে আমি দেখতে পেতাম, থিও-র মৃত্যুর পর নিরাপত্তার লোকেরা একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়িই করছে। তারা দেখেছে অন্তর্জালে থিও-র বিরুদ্ধে হুমকি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারা থিও-কে যথাযথভাবে বুঝিয়ে নিরাপত্তা গ্রহণ করাতে সক্ষম হয় নি। এটা তারা করে নি এই ভেবে যে, যদি তারা থিও-কে নিরাপত্তা দেয়, তবে তাদেরকে “সবাই”-কেই নিরাপত্তা দিতে হবে। ডিকেডিবি-র কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্য, বিদেশি কূটনৈতিক, এবং সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। জাস্টিস মিনিস্টার পিয়েট হেইন ডোনার বলেছে, “আমাদের অর্ধেক সংখ্যক লোক, আরেক অর্ধেক সংখ্যক লোকের নিরাপত্তা দিতে পারে না।”

এখন থিও মারা গেছে। পুরো দেশ গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত। নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো এখন চারপাশে শুধু হুমকিই দেখছে। তখনও কেউ জানে না, থিওকে হত্যা করার জন্য ঠিক কতখানি মাত্রার ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি যদি নিজেও এর পরপরই মারা যেতাম, তবে হল্যান্ডে আগুন জ্বলে উঠতো। তীব্র অবিশ্বাসে লোকজন একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতো বলেই সরকার আশংকা করেছিলো। সে কারণেই আমার ধারণা উপর থেকে নির্দেশ এসেছিলো, “যে কোনো উপায়ই হোক আয়ানকে নিরাপদে রাখো।”

1783 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।