ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

থিও হত্যাকাণ্ড- (পর্ব -২) মূলঃ আয়ান হারসি আলি

থিও-র মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। এক দৌঁড়ে আইরিসের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। শ্বাস নেবার চেষ্টা করলাম বড় করে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছি আমি। নিজেকে অসহায় লাগছে, সাথে সাথে আতংকিতও। ইনগ্রিড দ্রুতগতিতে চলে এলো আমার এখানে। তার সাথে নিরাপত্তার লোকেরাও রয়েছে। তারা আমাকে বললো, “আমাদের এখুনি বের হতে হবে।

“আমাকে একা থাকতে দাও প্লিজ। কোথাও যাচ্ছি না আমি, এখানেই থাকছি।” আমি কান্নাভেজা কণ্ঠে বললাম।

“আমাদের বের হতেই হবে।” ব্রাম শক্ত গলায় বললো। আইরিসও আমার মতোই কাঁদছিলো। সে আমাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমার কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলছিলো। যেন কোনো বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এমনভাবে সে আমাকে বলছিলো, “আয়ান, চলো যাই।” আমি আর থিও সাবমিশন বানানোর শুরু থেকেই আইরিস থিওকে চিনতো। ফোনেও তারা প্রচুর কথা বলেছে এক সময়। ফোনে প্রচুর দুষ্টামি করতো দু’জনে। মজার মজার কথা বলে আইরিসকে হাসাতো থিও। ব্রাম আমার কোট নিয়ে এলো। আমার গায়ে পরিয়ে দিলো। তারপর বললো, “আমরা বের হচ্ছি।”

ব্রাম এবং অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে ঘিরে ধরলো। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে ইটবিছানো কোর্ট ইয়ার্ডে আসতেই আরো অসংখ্য নিরাপত্তাকর্মীরা ইনগ্রিড, আইরিস এবং আমার চারপাশে ব্যূহ তৈরি করে ফেললো। অন্যসময় যে রকম ঢিলেঢালাভাবে তারা আমাকে পাহারা দিতো, আজ সেরকম না। সবাই অত্যন্ত সতর্ক। প্রত্যেকের চেহারা কঠোর হয়ে উঠেছে, থমথম করছে সবার মুখমণ্ডল। প্রত্যেকের গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। সকলেই ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের অস্ত্রের খানিকটা অংশ প্রদর্শন করছে। সব মিলিয়ে ভীতিকর এক পরিবেশ।

আমরা হেঁটে হেঁটে আমার বাড়িতে চলে এলাম। যেদিকেই তাকাচ্ছি, চারিদিকে শুধু নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা লোক চোখে পড়ছে। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার, গাড়ি এবং অস্ত্র দিয়ে ভরে গেছে পুরো এলাকা।

থিও-র কী ঘটেছে? আমি টেলিভিশন খুললাম। ফোন কল বাজতে শুরু করেছেন। হতবিহবল অবস্থায় রয়েছি আমি। মনের উপর প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে। থিও মারা গেছে! এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এরকম কিছু ঘটতে পারে, সেই ধারণাটাই আমার মন মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। আমি মনে মনে খুব আশা করছি যে ঘটনা যেন সত্যি না হয়। টেলিভিশনে বার বারই এই সংবাদ দেখাচ্ছে। গোলাগুলি্র ফুটেজ, সাদা একটা কাপড়ের নিচে একটা লাশের ছবি। থিও ভ্যাগ গগ নিহত হয়েছে। আমি নিজেকে বলতে পারছি না যে, সাদা কাপড়ের নিচেই থিও শুয়ে আছে। আমার কাছে এটা কোনোভাবেই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

বেলা গড়িয়ে গেলো। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আসা শুরু করেছে। একজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের জন্য। হত্যাকাণ্ডের পঞ্চাশজন সাক্ষী পাওয়া গেছে। বিবিসিতে একজন মহিলা ইংরেজিতে বলছে, “ইসলামি পোশাক পরা দাড়িওয়ালা একজন লোক এই ঘটনা ঘটিয়েছে।” আমি চেয়ারে হেলান দিলাম। “এটা তাহলে একজন মুসলমানের কাজ। তাহলে নিশ্চয় সাবমিশনের জন্যই ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড। আমি সাবমিশন না বানালে থিও মারা যেতো না। এখনও বেঁচে থাকতো। তার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হলো আমার।

আমি সাবমিশন বানানো বন্ধ করতাম না অবশ্য। তবে এটা পুরোপুরি আমি তৈরি করতাম, সম্পূর্ণ একার নামে করতাম আমি।

সেপ্টেম্বর মাসে অন্তর্জালে আমাদের দু’জনের প্রতি দেওয়া হুমকির কথা আমার মনে পড়লো। থিও এই হুমকি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারতো, নিরাপত্তা নিতে পারতো সে। কী যে বোকামি হয়েছে তার। এই হত্যাকাণ্ডকে কতো সহজেই না প্রতিরোধ করা যেতো। একরাশ আক্রোশ, আর্তি এবং আতংক ছড়িয়ে পড়লো আমার সারা গা জুড়ে।

ইনগ্রিড একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে জানতে পারলো, থিওকে শুধু গুলিই করা হয় নি, তার গায়ে ছুরিও চালানো হয়েছে। “থিও-র গলা কেটে ফেলা হয়েছে।” সে বললো। “হত্যাকারী একটা চিঠিও রেখে গেছে।” “ইনগ্রিড, ঘটনা এমনিতেই খুব খারাপ। এখন লোকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো আচরণ করছে। নানা গল্প ছড়াচ্ছে।” ইনগ্রিডকে থামানোর জন্য আমি বললাম।

আমার হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছে। থিও-র মৃত্যু সংবাদের ধাক্কা আমার মস্তিষ্কের চিন্তা করার অংশটাকে অকেজো করে দিয়েছে। তীব্র কষ্ট নিয়ে আমি শুধু সংবাদ দেখে চলেছি। ইনগ্রিড, আইরিস এবং নিরাপত্তাকর্মীরা সারাদিন আমার বাসায় রইলো। জব কোহেন কল করে খোঁজ নিলো আমি কেমন আছি। এমস্টারডামের মেয়র হিসাবে সে সন্ধ্যায় রাজপ্রাসাদের সামনে অবস্থিত বিশাল এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশের জন্য জনগণকে ডাক দিলো। থিও যেমন বিক্ষোভ করতে পছন্দ করতো, তেমনি বিক্ষোভ সমাবেশের জন্যই সে সবাইকে আহবান জানালো। থিও-র জন্য মৌন সমাবেশ ডাকাটা মূর্খতার সামিল, বব কোহেন সবাইকে বললো।

সন্ধ্যার বিক্ষোভ সমাবেশ আমরা টেলিভিশনে দেখছিলাম। এমস্টারডামের হাজার হাজার লোক সেই সমাবেশে যোগ দিয়েছে। ঠিক এই সময় ব্রাম বললো যে আমাদের আমার বাসা ছেড়ে বের হয়ে যেতে হবে। তার উপর নির্দেশ এসেছে আমার জন্য রাতে ভিন্ন কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা। ইনগ্রিড আমাকে বললো তার ওখানে যাবার জন্য। আমরা তার বাসার লিভিং রুমে বসে হত্যাকাণ্ডের উপর মধ্য রাতের আলোচনা অনুষ্ঠান দেখছিলাম। ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে আমি কোট আর বেশ কয়েকটা স্কার্ফ পরে বসে আছি। টেলিভিশনে যারা আলোচনা করছে তারা সকলেই উত্তেজিত। একটা চলচ্চিত্র বানানোর জন্য হল্যান্ডে কেউ এভাবে মারা যেতে পারে, এটা ভেবে সারা দেশের মানুষই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।

ব্রামের কাছে এই সময় আরেকটা ফোন কল এলো তার ডিকেডিবি-র সুপারভাইজারদের কাছ থেকে। বলা হলো, ইনগ্রিডের বাড়িতে থাকাটাও খুবই বিপদজনক হবে। হিসাব করে দেখা হলো, ইসরায়েলি দূতাবাসের পিছনে অবস্থিত আমার নিজের বাড়িতেই গভীর রাতে আমাকে নিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি।

আমার বাড়ির ভিতরে নিরাপত্তাকর্মীরা সারারাত অবস্থান করলো। সবাই সতর্কভাবে পাহারারত। এই সময় থেকেই আমার শোয়ার ঘরের দরজায় প্রতিরাতে বডিগার্ড রাখার ব্যবস্থা করা হলো। ভোর চারটার দিকে আমার দরজার কলিংবেল ক্রমাগত বাজতে থাকলো। আমি তখনও ঘুমাই নি। বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। নিচে যে নারী নিরাপত্তাকর্মীটি কাজ করছিলো, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ঘটনা?”

সিকিউরিটি ক্যামেরায় একজন আরব চেহারার লোককে দেখা গেলো। সে আমার রাস্তার সব বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজাচ্ছে। কয়েকদিন পরে এই লোককে পুলিশ গ্রেফতার করে। সে পুলিশকে বলে, সে আসলে একজন বেশ্যাকে খুঁজছিলো। এই বেশ্যার কাছে কয়েকদিন আগে সে একবার এসেছিলো। কিন্তু, এই ঘটনা আমাকে বেশ ভালোভাবে মনে করিয়ে দিলো যে অন্তর্জালে আমার ঠিকানা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ একজন জেনে গেছে এই রাস্তাতেই থাকি আমি।

এই ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেলো, আমার বাড়িতে আমার পক্ষে দ্বিতীয় রাত থাকাটা সম্ভব নয়। ডিকেডিবি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমি হোটেলেও থাকতে পারবো না। আমার চেহারা এবং নাম সারাক্ষণই টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে এবং উচ্চারিত হচ্ছে। হোটেলে কেউ না কেউ ঠিকই চিনে ফেলবে আমাকে। হল্যান্ডের কোনো হোটেলেই আমি নিরাপদ না।

“আমি কি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে থাকতে পারি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “গ্রামের দিকে আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা সেই বাড়ি।” এটাও খুব বিপদজনক হবে, এটাই ভাবলো ডিকেডিবি-র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। “হল্যান্ডে কোনো কিছুই গোপন থাকে না।” আমাকে বলা হলো। “লোকজন কথা বলবে। লুকোনো বাড়ি তোমাকে এক ধরনের মিথ্যা নিরাপত্তার বোধ দেবে।” শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো না। বুধবার রাতটাও আমি আমার নিজের বিছানাতেই কাটালাম।

রাতের বেলা, একাকী শুয়ে থেকে, মাথার মাঝে নানা ধরনের চিন্তা আসাকে ঠেকাতে পারলাম না আমি। যতবারই আমি চোখ বন্ধ করি, ততবারই আমি থিও-র হত্যাকাণ্ডকে চোখের সামনে দেখি। থিও-র জীবন ভিক্ষা চাওয়ার আওয়াজ শুনি। “আমরা কি এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি না?” থিও তার হত্যাকারীকে জিজ্ঞেস করেছিলো। থিও নিশ্চয়ই ভেবেছিলো কোথাও কোনো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে সেটাকে সমাধান করা যাবে। সে বুঝতে পারে নাই যে তার হত্যাকারী বিশ্বকে দেখে পুরোপুরি ভিন্ন এক চোখে। থিও এমন কিছুই তাকে বলতে পারতো না, যেটা ঘটনাকে পাল্টাতে পারতো।

থিও-র বারো বছরের বালক ছেলের কথা মনে হলো আমার। এই ছেলেটাকে আমি একবার মাত্র দেখেছি। আমার কারণে সে এখন পিতৃহারা। যতক্ষণ আমি জেগে ছিলাম, এটাই ভাবছিলাম। ঘুমিয়ে পড়তেই দুঃস্বপ্ন এসে তাড়া করলো আমাকে। ইসলামি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা দাড়িওয়ালা একজন লোক বাঁকা তলোয়ার হাতে আমার সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। আমাকে আক্রমণ করতে চাইছে। আমি তার ভয়ে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলাম। নিচেও অসংখ্য মানুষকে দেখতে পেলাম। সবাই চিৎকার করছে। তীব্র ভয়ে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। সারারাত আর ঘুমোতে পারলাম না আমি। এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন আমি এখনো দেখি।


2144 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।