তসলিমা নাসরিন পুরুষ বিদ্বেষী। পুরুষ সে মোটেও পছন্দ করে না। আবার দরকার হলে এই পুরুষ, সেই পুরুষ, অনেক পুরুষের সাথেই শুতে যায়। ও একজন নষ্ট মহিলা, পথভ্রষ্ট মহিলা। একটা খানকি, ছিনাল-মাগি না হলে কী বাবার কথা, মায়ের কথা, চাচার কথা, মামার কথা এভাবে কেউ লিখতে পারে?
তসলিমা সম্পর্কিত কোনো লেখা লিখলে ওপরের কথাগুলো প্রায় সময় শুনতে হয়। এমন কথা যে শুধু পুরুষরা বলে তা-ও নয়, অনেক নারীও অবলীলায় বলে থাকেন। সে-ও আবার গণ্ডমূর্খ পাশ্চাৎপদের কোনো নারী নয়, একেবারে একবিংশ শতাব্দীর উত্তরাধুনিক নারীরাও বলেন এমন। পুরুষ আর পাশ্চাৎপদের নারীদের বলাটা আমি স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি। কিন্তু উত্তরাধুনিক নারীরা! তারা কিভাবে এসব বলে?
তারা কেনো বলেন, কোন যুক্তিতে বলেন? আমার জানা নেই। তবে আমার বিস্ময়ের ঘোর তখন আর কাটতে চায় না, যখন দেখি মুক্তমতে বিশ্বাসীরাও (মুক্তমনা দাবীদার, এই শ্রেণিটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষ) উপরোক্ত বাক্যগুলো ব্যবহার করেন! আবার দেখি তাদের সাথে যোগ দেন অতি ভদ্রবেশী কিছু মানুষ। যারা সত্যিকার অর্থে অনেক বেশি মানবতার কথা বলেন! এ ক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ স্যারের ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কবিতাটাই মনে পড়ে।
হুমায়ূন আজাদ সেই ১৯৮৫ সালে এই কবিতায় সুন্দর করে ভবিষ্যৎ লিখেছিলেন, আজ ৩২ বছর পর এর সত্যতা দেখতে পাচ্ছি। সত্যি, আজ সব কিছুই নষ্টদের দখলে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, সংবাদ মাধ্যম, নেতৃত্ব, সমাজ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, এমনকি আজকের এই ফেসবুকের বিরাট একটা অংশও নষ্টদের দখলে চলে গেছে। এই যদি হয় বর্তমান, তবে আগামী দিনগুলোর অবস্থা কেমন হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এবার আসি মূল কথায়, তসলিমা নাসরিন পুরুষ বিদ্বেষী (!) সত্যি কী তাই? আমি কখনোই তার কোনো লেখাতে পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব দেখিনি, পাইনি। যা পেয়েছি তা হচ্ছে, তিনি কট্টর পুরুষতন্ত্র বিরোধী একজন মানুষ। এখন কেউ দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ কী ভিন্ন জিনিস? হ্যাঁ, সম্পূর্ণই ভিন্ন জিনিস। পুরুষতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা থাকে মানুষের মস্তিষ্কে। এই ধারণা যারা পোষণ করেন, তারা কখনোই লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা হোক, তা চান না। এই শ্রেণিটা যেমন পুরুষ হয়, তেমন নারীও হয়। বহু নারী আছেন, যারা কট্টরভাবে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক।
যৌনতা জৈবিক চাহিদা। এই চাহিদা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মানুষ হিসেবে আমার-আপনার যেমন এই চাহিদা আছে, তসলিমারও আছে। এটাই স্বাভাবিক। যার ফলে তারও পুরুষ দরকার হয়। তবে তিনি যাদের সাথে বিছানায় গিয়েছেন, তারা বিছানায় যাওয়ার পূর্বে মানুষই ছিলেন। অন্তত তসলিমার শরীরটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যতার লেশমাত্র ছিলো না। আর তাই তাদের সাথে বিছানায় গিয়েছেন। কিন্তু একজন পুরুষ যে কাঙ্ক্ষিত নারীর শরীর পাওয়ার পর কেমন করে বদলে যেতে পারেন, কেমন করে যে মানুষ থেকে না-মানুষ হতে পারেন, তা বোধহয় তসলিমার থেকে ভালো অন্য কেউ বলতে পারবেন না।
আবার বলতেও পারবেন অন্যান্য নারীরাও। তারাও জানেন, শরীর পাওয়ার জন্য একজন পুরুষ কতরকম ছলচাতুরী, নেকামি, ভালো মানুষী দেখিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে শরীর পাওয়া শেষে এই পুরুষরাই আবার কতটা কুৎসিত ভয়ঙ্কর দানব হয়ে উঠে। কিন্তু এসব ভ- পুরুষগুলোর মুখোশ ধরে টান দিতে অন্য মেয়েরা পারে না। কারণ সমাজ তাকে নষ্টা, কুলট, বেশ্যা বলবে, তাই তারা ভণ্ডদের দেয়া ক্ষতগুলো গোপনেই বহন করে ফিরেন। সেদিক দিয়ে তসলিমা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি প্রচলিত নষ্ট সমাজের তোয়াক্কা করেন নি। অকপটে বলেছেন সেসব ভণ্ডদের কথা। যারা ভদ্রতার মুখোশ পরে আছেন আমার, আপনার পাশেই। আর এ জন্যই তসলিমা অনেকের কাছে নষ্ট মহিলা, পথভ্রষ্ট মহিলা।
একজন নারী ঘর আর বাহির, কোথায় নিরাপদ? কোথাও না। এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেই তসলিমা তার লেখাতে তুলে ধরেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি ঘরের মানুষদের কথাও বলতে দ্বিধা করেন নি। আপনি অস্বীকার করতে পারবেন, প্রতিদিন ঘরের ভেতরে নিজ আত্মীয় দ্বারা কোনো মেয়ে কী যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছে না? বিভিন্ন পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, একজন মেয়ে সেক্স সম্পর্কে বুঝে উঠার আগেই ঘরের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। এ সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
তসলিমা নাসরিনও হয়েছেন তার আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার। তসলিমা তা লিখেছেন বলেই আমরা জেনেছি। আপনি কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, শিশু, কিশোর বয়সে আপনি (নারী) ঘর কিংবা ঘরের বাইরে পরিচিত, আত্মীয় স্বজন দ্বারা যৌন-হয়রানির শিকার হন নি? পার্থক্য শুধু এ কথাগুলো আপনি লিখতে পারেন নি, কাউকে বলতে পারেন নি লজ্জা আর ভয়ে। কিন্তু তসলিমা লিখেছেন সংকোচহীন। তাকে লিখতে শিখিয়েছে বকুলি নামের সেই মেয়েটি। যার অনুপ্রেরণায় তিনি ‘ক’ লিখেছিলেন। যেখান থেকে আমরা অতিভদ্র কিছু নোংরা মুখ চিনতে পেরেছি। আর এতেই গাত্রদাহ হয়েছে সেসব ভণ্ডদের।
একজন নারী, সে কেবল ‘যোনী’ আর ‘স্তন’ থাকার কারণে কোথাও নিরাপদ বোধ করে না। সে যেখানেই যায়, প্রকাশ্যে বা কৌশলে তার দেহ ছুঁতে চায় বহু পুরুষ। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্কুল, কলেজ, মার্কেট, লাইব্রেরী, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস, এমনকি উপাসনালয়েও নারী নিরাপদ নয়। আমরা জানি, একজন বাবার কাছে তার মেয়ে সব থেকে বেশি নিরাপদ। কিন্তু সে ধারণাও আমাদের ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অসংখ্য ঘটনাই তার উদাহরণ যে, বাবার কাছেও মেয়ে নিরাপদ নয়। বাবারাও ধর্ষণ করে। বাবাদের লালসার শিকার হয়ে অনেক মেয়েই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। অনেক মেয়ে বাবা-ভাই-মামা-চাচা এমন সম্পর্কের কিছু কিছু মানুষ দ্বারা ধর্ষিত হয়ে আজন্ম ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। এর কোনোটা প্রকাশ হয়, কোনোটা গোপনই থেকে যায়।
শুধু এমন ধর্ষণের কথাই বলি কেনো, বিয়ের নামে প্রতিদিন কী পরিমাণ নারী দাম্পত্য ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তা কী কেউ ভেবে দেখেছি? এবার একটু ভেবে বলুন তো, তসলিমা নাসরিনের দোষটা কোথায়? যা সত্যি তা তুলে ধরাটাই কী তার দোষ? সে যদি এসব সত্যি কথা কখনোই না লিখত, না বলতো, তাহলে আপনাদের কাছে নিশ্চয় সে খুব ভালো একজন নারী হতো, তাই না? তাহলে কি আমরা চেপে যাও, চাপিয়ে রাখ, মেনে নাও, মানিযে চলার ধারাতে এখনও রয়ে গেছি?
পরিশেষে এটুকুই বলব, নারী তুমি যে হও, যেমনই হও এই সমাজ তোমাকে কোনো না কোনভাবে নষ্টা উপাধি দিবেই দিবে। যদি সমাজ ও সংসারের কাছে ভদ্র হতে চাও, বদনামহীন থাকতে চাও, তবে পুরুষের সব অন্যায় মুখ বুজে মেন নাও, মানিয়ে চল।