মনে আছে কলকাতা!
কলকাতা কলকাতা শোনো -
কোলাহলের রাস্তাঘাট, হুগলী সেতুর ধারে কারখানা আর -
হাওড়া সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা,
ধোঁয়াকার আকাশ আর শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশনে গিজগিজ করা ভিড়,
এই কি তোমার পরিচয়?
কলকাতা মানে কি রবীন্দ্রসদন বা ময়দানে বসে প্রেম প্রেম আমেজ আর -
প্রেমিক প্রেমিকাদের ফুচকার দোকানে জমিয়ে পাতা সেজে টক, ঝাল, নোনতা স্বাদের -
মুচমুচে ফুচকা খাওয়া,
বা স্টারে বসে জমিয়ে আর্টফিল্ম দেখা, নন্দনে বসে ছেলে মেয়েদের চুমু খাওয়া!
কলকাতা মানে কি শুধু শ্যামবাজার গোলবাড়ির বিখ্যাত মটন কষা,
বিবেকানন্দ রোডের ফুটপাতে শুয়ে থাকা বাচ্চারা!
কলকাতা মানে কলেজস্ট্রিটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেকে -
এ দোকান, ও দোকান ঘুরে ঘুরে বইয়ের দাম কষা,
বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখা,
আবার বইয়ের নেশায় বই বাছাই করে দাম চোকাতে গিয়ে হঠাৎ -
পকেটে হাত পড়তেই খালি পকেট দেখে সম্বিত ফিরে থমকে যাওয়া।
কলকাতা মানে ফেব্রুয়ারির বইমেলা, আর লেখক লেখিকাদের ঘিরে ধরে অটোগ্রাফ নেওয়া,
কলকাতা মানে ট্রামে চড়ে পুরোনো ঐতিহ্যকে ছোঁয়ার আনন্দ উপভোগ করা।
কলকাতা তোমার মনে আছে রওডনস্ট্রিটের সেই বাড়িটাকে যেখানে -
একসময় একজন মানুষ ঘুরে বেড়াতো ঘরময় বা দালানজুড়ে,
ছোট্ট মিনুটাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতো, খাইয়ে দিতো, চুমু খেতো,
ছবি এঁকে দেওয়ালজুড়ে গোটা ঘরে টাঙাতো,
দিনরাত বই পড়তো, লেখালেখি করতো!
মনে আছে কলকাতা তোমার, সেদিন-
যেদিন সেই লেখককে নিয়ে তোমার শহরজুড়ে
উত্তাল নাটক সাজানো হয়েছিলো!
শিয়ালদহ, মৌলালি, পার্কসার্কাসজুড়ে সার্কাসের মঞ্চ তৈরি করে কার্ফু লাগান হয়েছিলো!
মনে আছে কলকাতা সেদিন তোমার শহরে কিছু মুসলিমের বুকে পুলিশ, মিলিটারি এসে -
রাবারের গুলি ছুঁড়ে গোটা মুসলিম জাতিকে খেপিয়ে দিয়েছিলো,
কিছু ভাড়াটে লোককে রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে নামিয়ে দিয়েছিলো সেই লেখকের অপসারন চেয়ে!
মনে আছে কলকাতা তোমারই শহরে থাকা সেই রওডনস্ট্রিটের বাড়িটাতে -
সেদিনের পুলিশের গুণ্ডামি,
লেখকের গায়ে হাত দিয়ে তাকে টানতে টানতে বার করে দিলো তোমার শহর থেকেই।
মনে আছে কলকাতা?
মনে আছে তোমার,
কলকাতা! ..
মনে আছে সেদিন কিভাবে রাজনীতি করে,
ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলা আদর্শের লড়াইকে থামিয়ে দিয়েছিলো তোমার শাসক!
মনে আছে তোমার -
সেদিনের বইমেলাতে যখন ছাত্র ছাত্রীরা একটাও বই কিনবে না বলে,
বইমেলা হতে দেবে না বলে সংগঠন গড়েছিলো -
সেই মানববাদী লেখককে ফিরিয়ে আনার দাবিতে,
মনে আছে সেদিন কিভাবে লেখকের মোমের পুতুল গড়ে
ছাত্রছাত্রীদের সাথে ছল করে-
তাদের লড়াইকে ছোট করে দিয়েছিলো ছলনাময়ী রাজনীতি!
কলকাতা –
তুমি যেমন আমার, তুমি যেমন সবার,
তেমন তুমি আমার লেখকের হতে পারো নি,
কলকাতা তুমি আজও
একটা রোবটের শহর হয়ে আছো মাত্র,
কখনো তোমাকে ইংরেজ শুষে খেয়েছে,
তোমার ওপর কর্তৃত্ব করেছে,
তোমার পিঠে চাবুক মেরে তোমাকে মজদুরি খাটিয়েছে,
তেমনই তুমি আজও -
রাজনীতির মজদুর হয়েই বেঁচে আছো।
মনে রেখো কলকাতা -
এই বাঁচা তোমার সম্মান নয়,
এই বাঁচা
শুধু ধর্ষিত হয়ে বেঁচে থাকা।
দেশের প্রতি টান
আজ তোমার দেশের প্রতি টান আমি অনুভব করতে পারি,
অনুভব করতে পারি কি বিপুল টান আর ভালোবাসা
আমাদের সকল হৃদয়েই বয়ে চলেছে দেশের প্রতি, মাটির প্রতি, চেনা অলিগলিতেও।
যেন আজও সেই টাটকা স্মৃতিতে তুমি হেঁটে চলেছো ময়মনসিংহের ছোট, বড় রাস্তাগুলোতে,
পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে নৌকা পাড়ি দিচ্ছো যমুনার উদ্দেশ্যে,
পড়ন্ত বেলাতে মিইয়ে যাওয়া সূর্য'কে-
পশ্চিম আকাশে একটু একটু করে ঢলে পড়তে দেখছো আর হাসছো আলতো করে,
ভাবছো আপন মনে জীবনের নানান চিন্তাগুলো একটু অন্যমনস্ক হয়ে,
চারিদিকের কোলাহল, কেচরমেচর শব্দগুলো কানে ঢুকছে, শুধু ওই ঢোকাটুকুই,
তুমি মেতে আছো আপন মনে।
দেশে থাকার সময় আমরা দেশ নিয়ে কই ভাবি!
দেশে থাকার সময় তো শুধু বিভিন্নমহলের চর্চা, সমালোচনা নিয়েই পড়ে থাকি।
দেশ থেকে দূরে এলেই,
দেশকে সেই আপন করে ফিরে পেতে না পারলেই
পুরোনো স্মৃতিগুলোকে হাতড়াতে থাকি -
স্বর্গ খোঁজার মতো করে।
খারাপ স্মৃতি, সমালোচনাগুলো নিমেষেই বিলীন হতে থাকে, আর
বড়দের ভয় দেখানো শাসনগুলোতেও সুখের ছায়া দেখা যায়।
যখন তুমি পরীক্ষার পড়া পড়তে, যখন
মাস্টারমশাইদের পড়া তৈরি করতে ভয় পেয়ে,
তখন তুমি সেই ভয় থেকে বাঁচতে চাইতে,
আজ হয়তো ভাবো "আহা! সেই ভয়ের দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল!"
পড়া পড়া খেলা করে কাটিয়ে দিতে পারতে,
বাবার ধমকের আওয়াজ কতই না মধুর ছিলো, ঠিক যতটা হয়তো তখন কর্কশ শোনাতো, -
তার অধিক মধুর এখন হয়তো মনে হয়!
মায়ের আদর মাখা আঁচল!
সেই যে মা জড়িয়ে রাখতো আঁচলের ভাঁজে,
আগলে রাখতো সব বিপদ থেকে!
সেই যে একটু বিপদের আশঙ্কার পর মা বুকে জড়িয়ে ধরতো!
গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু চিৎকার করে বা
ফুঁপিয়ে কাঁদতো তুমি কত খারাপ আছ সেই ভয়ে!
কত মিষ্টি সেই হাত বোলানো ছোঁয়াগুলো!
কত মিষ্টি সেই কান্নার স্বর!
সেই চোখের জল কত শীতল যখন তোমাকে স্পর্শ করতো!
এটাই তো দেশ! এটাই দেশ।
সেই কান্না, সেই শাসন, সেই ভয়,
সেই নদী, সেই কোলাহল,
সেই পড়ন্ত সূর্যকে ঢলে পড়তে দেখা,
সেই বাতাসের গন্ধ,
সেই অন্যমনস্ক চিন্তা, সেই পড়া পড়া খেলা ..
এটাই দেশ।
আজ তুমি পরবাসে,
আজ তুমি মানিয়ে নিয়েছো এই পরবাসেই নিজের দেশ ভেবে।
আজ আমি আমার দেশেই, তবু
তোমার সেই জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি,
তোমার এখনকার এই অনুভূতি
সেই পুরোনো স্মৃতিতে হাতড়ে বেড়ানকে -
আমি উপলব্ধি করতে পারি,
যেন সেই একইরকম সবকিছু,
যেন এ তো আমাদের সবার জীবনেই ঘটে,
যেন আমরা সবাই এই জীবনেই বাঁচি!
আমাদের মানচিত্র আলাদা,
আমাদের পতাকার রং আলাদা, চিহ্ন আলাদা, তবু -
দেশের প্রতি সেই টান, সেই ভালোবাসার গভীরতা একই।
এটাই আমার দেশ,
এটাই আমার মাটি,
এটাই ভালবাসা।
বাংলা সেদিন লজ্জা নয়,
বাংলা হবে অহঙ্কার
সাদা পাতায় তোমাকে লিখে যেতে চাই,
সাদা পাতায় তোমাকে স্বাধীন করে যেতে চাই,
তোমাকে স্বাধীন দেখে আমি অমর হতে পারি,
সাদা পাতায় কোনো দাঙ্গা, বিবাদ নাই।
যতদিন, যতযুগ ওঠে তোমার নাম -
মানুষ হৃদয়ে হৃদয়ে,
যতবার তুমি গর্জে ওঠো মানুষ হৃদয়ে -
প্রতিবাদের সুর তুলে,
ততদিন,
ততযুগ,-
ততবার যেন আমিও পাই স্থান
তোমার নামের পরে,
কোথাও একটু ভালোবাসা নিয়ে হৃদয়জুড়ে।
অমরত্বে বড় সাধ জাগে আজ -
খোলা আকাশতলে।
প্রতিটা প্রকোষ্ঠে আজ শ্বাস নিই আমি তোমার নামের সাথে,
জেগে ওঠে চেতনা কাঠপুতুলের জীবন ছাপিয়ে,
প্রতিটা রোম, প্রতিটা স্নায়ু, হৃদয় পার হতে চায়
সাহসের শেষ সীমা।
এ জীবন ভাঙতে চায় গড়পড়তা হিসাব,
সাধারন হয়েও চিন্তাতে উপলব্ধি করি অসাধারনত্বের ছাপ,
দেখি বিজয়ের স্বপ্ন আজ তোমাকে ঘিরে।
বাংলা আমার অপূর্ণ লাগে তুমি ছাড়া,
বাংলা আমার নিষ্প্রাণ লাগে বঙ্গকন্যাকে ছাড়া।
তুমি ফিরবেই, -
এ দৃঢ় বিশ্বাস আমি ধারণ করি বুকে,
বাংলা কখনো পূর্ণ হবেই আমাদের চেতনাজুড়ে।
আমি স্বপ্নে দেখি আমার বঙ্গকন্যাকে -
মাথায় করে রাখছে মানুষ,
পিছনে দাঁড়িয়ে আমি -
আমার ভিতর ও বাহিরে জয়ের হাসি হাসছি,
আমি দেখি গোটা কলকাতাজুড়ে মাতোয়ারা মানুষের দল -
হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে জয়ের উল্লাসে -
গাইছে তসলিমা গান।
দিগ্বিদিক যায় না চেনা,
শ্যামবাজার - রবীন্দ্রসদন লাগছে এক,
ঘর ছেড়েছে ছেলে, বুড়ো,
ডাকাবুকো মেয়েদের দল।
স্বপ্নজুড়ে আমি দেখি আমার বঙ্গকন্যা -
ব্রিগেডের খোলা মাঠে মাইক হাতে, -
ভাঙছে পুরুষতন্ত্র।
গোঁড়া পুরুষেরা লজ্জা পাচ্ছে তাদের কৃতকর্মে,
গ্রহণ করছে মানবধর্ম।
আমি দেখি বুদ্ধ, বিমান, মমতা -
এক সারিতে বসে সেদিন
চেয়ে আছে তোমার দিকে,
প্রতিটা ভাষণে চেতনা জাগছে ওদের,
পড়ছে হাততালি।
কোথাও সেদিন মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আমি -
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি, দেখছি তোমাকে,
বুকটা যেন গর্বে ভেসে যাচ্ছে
আমাদের জয়ের আনন্দে
কোথাও আমি থাকতে চাই এই জয়ের পিছনে,
আমি দেখতে চাই আমাদের আদর্শ -
বয়ে যাচ্ছে জনজোয়ারে।
সেদিন বাংলা লজ্জা নয়,
সেদিন বাংলা হবে অহঙ্কার,
সেদিন বাংলায় সেজে উঠবে ভালোবাসার মানুষেরা -
নিয়ে ভালোবাসার অধিকার।
সকল সমক্ষে প্রেমিক প্রেমিকারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে,
লজ্জার বাধ পিছনে ফেলে চুমু খাবে পরস্পরে,
প্রেমকে তারা করবে জয় -
বুক ফুলিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে।
সেদিন বাংলায় থাকবে না হিন্দু,
থাকবে না মুসলমান,
সকল মানুষ এক হবে সেদিন বঙ্গবাসী হয়ে।
ছোট খোকারা শিখবে সেদিন মূল্যবোধের শিক্ষা,
তুমি ফিরলেই বাংলা হবে –
বাংলাতেই জগত সেরা।
সবাই সেদিন একসুরে বলে উঠবে -
"আমরা নই হিন্দু,
আমরা নই মুসলমান,
জাতিভেদের কলঙ্ক চায় না মাখতে আর,
আমরা বাংলাবাসী।
আমরা উঠি সকালবেলাতে এক সূর্য দেখে,
একই টাকা ছুঁই আমরা -
রুজি-রুটি-কারবারে।
আমরা চলি বাংলার পথে,
একই পথের পথিক,
শ্বাস নিই একই বাতাসে প্রাণ ভরে,
কোথাও নাই ভেদ।
আমরা বাংলাবাসী।"
কিছু চিন্তা, আলাদা করে দেখা ও ভাবা
তোমার মগজ কত দামী! ওরা সেটা বোঝে নি,
লাখ টাকার হিসেব কষে চেয়েছে প্রাণহানী।
সস্তা করে দিয়েছে দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা।
শিক্ষা কি শুধু পাঠ্য পুস্তকে, ধর্মে,
প্রাচীন ইতিহাসে?
শিক্ষা তো বুদ্ধিতেও আসে।
বুদ্ধি মানে নতুন কিছু করার চিন্তা,
শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকা বা
অন্যকে ঠকিয়ে নিজের আখের গোছানোতে নয়,
ধূর্তামির আর বুদ্ধির খেলা সম্পূর্ণ আলাদা।
বুদ্ধি আসে নতুন নতুন চিন্তায়, নতুন কিছু করাতে,
ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষের সাথে আলোচনাতে,-
যুক্তিতে।
ধূর্তামির খেলা শুধু ওই আখের গোছানোতেই,
স্বার্থপরতায়।
ধূর্তামি দিয়ে দেশের উন্নতি, প্রগতি হয় না,
শুধু গোঁড়ামিই হতে পারে।
কোনো প্রগতিশীল দেশ কখনই লেখক বা
বুদ্ধিজীবিকে হারাতে চায় না,
তার ওপর সেই লেখক যদি হয় দূর বাস্তবের চিন্তাবিদ, সে'তো দেশের সম্পদ!
ওরা সেই সম্পদকেই চায় না, ওরা তোমাকে বঞ্চিত করতে চায়,
তোমার মাথার দাম কষে তোমাকে সরিয়ে দিতে চায়।
সেই দেশ শুধুই পিছিয়ে পড়া তালিকায় থাকতে পারে,
এগিয়ে আসতে পারে না,
আসলে এরা এগোতেই চায় না।
ওরা সত্যিই বোঝে নি তোমার মূল্য,
লাখ টাকার কিছু কাগজের হিসেব কষেছে মাত্র।
ওরা বোঝে নি তোমাকে সমাদর করে,
স্বাধীনতা দিয়ে যদি কাজ করানো যেত,
তবেই –
দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞানের সঠিক মূল্যায়ন হত।
ওরা বড্ড বোকা!
বড্ড ধূর্ত।
হারিয়ে যাই গল্পকথায়
আপন লাগে সময়টা ভীষণ, যেন আমি তখনও ছিলাম,
দূর পাহাড়ে নিঝুম বিকেল, হাঁটতে হাঁটতে তুমি আমি,
লজ্জাগুলো হারিয়ে যাক, ফুরিয়ে যাক সময় গোনা।
ওই যে দেখো ঘনবন, সারি বেঁধে চলছে সাথে,
খোলা হাওয়ায় উড়ছে পাখি, উড়ছে তারা আকাশ মেঘে,
কালোছায়া ঘিরছে বাতাস, স্নিগ্ধ শীতল রাস্তাগুলো,
হারিয়ে যেতাম আমি সেখানে, যদি হতাম সহচর!
যখন শুনি গল্পকথা, ছবিগুলো ভেসে ওঠে,
পরিচিত লাগে না দেখা শহর,
না পাওয়া সেই ছোঁয়াগুলোও।
হারিয়ে যাই গল্পকথায়,
যেন আমি তখনও ছিলাম!