শায়লা হক তানজু

প্রবাসী লেখক, এক্টিভিস্ট।

সিংগেল মায়েরা মাদার ম্যারি না

অনেকদিন ধরে আমি একজনকে অনুরোধ করেছিলাম সুফির পাসপোর্টটা বানিয়ে দিতে, এক কথাতেই রাজি। ছেলের জন্যে সব করবে, কিন্তু বরাবরের মতো সে কথা রাখে না, আমার সাথে কথা বলার সময়ও হয় না। আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় সুফি ওর বাবার কথা জিগ্যেস করে না? হা করে, একটা সময় আমি আমার ব্যক্তিগত রাগ ক্ষোভের উর্দ্ধে গিয়ে ঠিকঠাক মা হতে পারতাম না। কিন্তু চেষ্টা করতাম, মানে যতোটা ভালোবাসা দিয়ে রাগ-ঘৃণা পাশে রেখে উত্তর করা যায় আরকি! বাসায়ও বললাম ওর বাবা এসে পাসপোর্ট বানাবে।

ছেলে গত পাঁচ বছরে বাবাকে দেখেছে মাত্র একবার, তবু সে জানে বাবার নাম শামীম ইফতেখার। সে আরো জানে তার বাবা আর মা'র বন্ধুত্ব শেষ, তাই তাঁরা আলাদা থাকে, আর বাবা আর একটা বিয়ে করেছে, সেই মা তাঁকে সিন্ডারেলার সৎ মা'র মতো ঘরের কাজ করাবে। এমন না আমরা ঘরের লোকজন থাকে এসব শিখিয়েছি। আমি ছেলেকে বলেছি, না বাবা এসব গল্পের জিনিস, সত্য না।

ছেলে যখন থেকে শুনেছে তাঁর বাবা আসবে, থাকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেবে আমাকে জিজ্ঞেস করে বাবা কখন আসবে? না দেখা বাবার জন্যে ও ওটুকুন প্রাণে এতো ভালোবাসা! আমি জিজ্ঞেস করেছি, বাবা আসলে কী বলবে? সে বললো, বলবে, তুমি আমাদের ফেলে চলে গেছো কেনো? ফেলে চলে যাওয়া ব্যপারটায় আমার চরম আপত্তি আছে তবুও একসাথে কেনো থাকি না সেটা ওর বোধের জায়গায় পৌঁছে বোঝানো বেশ কঠিন। ওকে বলেছি বাবা আদর করবে, আমাদের বন্ধুত্ব নেই, আমাদের আড়ি, তাই আমরা আলাদা থাকি, ছেলে বলে আমি বলবো আমার সাথে থাকতে আর তোমরা আবার বিয়ে করো। এই মুহূর্ত গুলো কি কঠিন, কি বেদনার সেটা একা মা ছাড়া বোঝা সম্ভব না। আমি চাই, চাইতাম ওর বাবার সাথে ওর একটা ভালো সম্পর্ক হোক। ওর মনস্তত্ত্ব ওর মঙ্গল সব কিছুর জন্যে। আমার রাগ, অতীত সব এক পাশে সরিয়ে রেখেই চাইতাম। এই চাওয়াটা চাইতে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।

কিন্তু পুরুষ হওয়ার সুবাদে, ধর্ম আর সমাজের চোখে প্রথম লিঙ্গ হওয়ার সৌভাগ্যে নিজের ক্ষমতাবান এক্স, অন্য কারো স্বামী বা বাবাকে বারবার নক করতে আমার ইচ্ছে করে না, তবু করতে হয়, মা বা নারীজন্মের অভিশাপে আমি পারিনি সাত বছরে সাত পয়সা ব্যয় না করতে ছেলের পিছনে। আমি পারিনি আর একখান বিয়ে করে সুখী হয়ে সব দায় শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে।

দু শিফটে, দুটা তিনটা চাকরি করতে করতে, ১০/১২/১৪ ঘন্টার কাজের পর যখন শরীর আর চলতে চায় না, নিজেরে বুঝাই ছেলে যখন আসবে তখন তো এতো কাজ করতে পারবো না, ছেলেকে সময় দিতে হবে, ছেলের জন্যে, আমাদের ভবিষ্যতের জন্যে আর কিছুদিন তানজু, আর কিছুদিন। নিজের জন্যে ২০ ডলারের জামা কিনতে ২০ বার ভাবি, ছেলের জন্যে একবারো না। আমি চাই না আমার ছেলে কোনোদিন ভাবুক বাবা নেই বলে ওর এই স্বপ্নটা পূরণ হবে না। শরীর খারাপ হলে কাজ করতে পারবো না, চাকরি না থাকলে বাসা ভাড়া কে দিবে, বাজারের ব্যাগটা টানা, হাজার কাজের ভিড়ে নিজের ঔষধটা কিনতেই ভুলে যাই।

হাউমাউ করে কাঁদার জন্যে ও একটা বুক লাগে, প্রচন্ড শক্ত মানুষটারও ভয় লাগে, হেরে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার। দুঃস্বপ্নে এ হাতটা মাঝে মাঝে আর একটা হাত খুঁজে বেড়ায়, নিঃশ্বাসের শব্দও মাঝে মাঝে একলা ঘরে মাঝরাতে বড্ড হাতুড়ি পেটায় বুকের মাঝে, বেদনার গভীরে, ভয় হয়, বিশ্বাস হয় না, জন্মদাতা বাবাই যেখানে দায়িত্ব নেয়নি, অন্য কেউ, না তৃতীয় কাউকে বিভেদকারী ছায়াই মনে হয়। আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারি না, বিশ্বাস করতে পারি না, সামনের দিনগুলো ভালো থাকবো বলে আমার ছেলের শৈশবে আমি থাকিনি, আমি থাকবো না ওর শৈশবের স্মৃতিতে। প্রচন্ড স্বার্থপর আমি আর একটু স্বার্থপর হতে চাই।

সুফির বাবার মতো ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট বানাতেও যদি টাকা চাইতে পারতাম! আমার সাড়ে তিন/ চার লাখ টাকা, যেটা আসলে সুফিরই ভবিষ্যৎ সেটা যদি মেরে দিতে পারতাম! ভাগ্নির বিয়েতে তাঁর বোনের মতো ধার নিয়ে আমার দুধের বাচ্চার মুখ দেখে পাওয়া উপহারের টাকাটা যদি মেরে দিতে পারতাম! যদি আর একটা বিয়ে করে চার আনা পয়সা খরচা না করে কোনো চিন্তা না করে ভুলে যেতে পারতাম আমি কারো মা!

মানে আমি তো মাতা ম্যারি না! একা একা তো মা হইনি, তবে যীশুর মতো সকল পাপের দায় নিয়ে আমি একাই কেন ক্রুশবিদ্ধ হবো? তবে সত্যি হলে বেঁচে থাকতে ওতোটা অমানুষ আমি হতে পারবো না। মৃত্যুর সাথেই হয়তো আত্মার মুক্তি সম্ভব। এতো অনিশ্চয়তা, এতো দায়িত্ব, এতো দায়, এতো ভার আমি আর নিতে পারছি না। বিয়ের পরে ও ডির্ভোস ফাইনাল করতে বিয়ের কথা লুকিয়ে যদি টাকা নিতে পারতাম তাহলে হয়তো এতো ছোটলোক, নীচ, কর্দয হয়েও সুখী হতে পারতাম। কাউরে ছোট করা বা সিম্প্যথী পাওয়া কোনটাই এ লেখার অভিপ্রায় না, কষ্টকে নির্বাণ করার প্রচেষ্টা মাত্র।

2558 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।