তানবীরা তালুকদার

জন্ম ২৯শে আষাঢ়, ঢাকা। আপাতত নেদারল্যান্ডস প্রবাসিনী। কিন্তু দেশের সাথে নাড়ির যোগাযোগ কাটেনি। পেশায় একাউনটেন্ট। বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছেন। অবসর সময়ে আবৃত্তি, নাচ ও নাটকের পাশাপাশি লেখালেখি করার চেষ্টা করেন। তাঁর লেখায় নিছক গল্প নেই; রয়েছে সত্যের ওপর দাঁড়ানো এবং জীবন দিয়ে উপলব্ধি করা অনুভূতির কথা। লিখছেন ছোটবেলা থেকেই। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ “পাহাড় আর নদীর গল্প” (২০১৩) এবং উপন্যাস “একদিন অহনার অভিবাসন” (২০১৪)। ২০১১ সালে ডয়েচে ভেল আয়োজিত “ববস” সেরা ব্লগ নির্বাচন প্রতিযোগিতায় তাঁর নিজস্ব ব্লগ http://ratjagapakhi.blogspot.nl/ মনোনয়ন পেয়েছিল। “ইয়েপ আর ইয়ান্নেকে” ডাচ ভাষা থেকে বাংলায় তাঁর প্রথম অনূদিত বই।

জনতা খায় রাজনীতিবিদরা খাওয়ায়, খেলা চলছে হরদম এবং চলবে “কায়ামত সে কায়ামত তাক”।

সাম্প্রতিক কালে আসানসোলে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাটি নিয়ে অর্ক ভাদুড়ী’র হৃদয় নিংড়ানো লেখাটি বেশ কয়েকজন আমাকে ইনবক্সে পাঠিয়েছেন। প্রত্যেককে আমি আবারও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, আমাকে আপনারা এর যোগ্য ভেবেছেন বলে। ইমাম সাহেবের আচরনে আপনারা আশাবাদী হলেও আমি নিতান্ত বিনয়ের সাথে সাদামাটা ভাষায় এখানে আমার হতাশা বলছি,

ইমাম সাহেব তার ছেলে হত্যার বিচার চান না, তিনি অসম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেন, যেমন কখনো ছিলো। আচ্ছা, ইতিহাস আমরা সবাই কম বেশি পড়েছি, আমরা নিজেরাও কালের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ হয়ে আছি। “ভারতবর্ষ” ঠিক কোন সময়টাতে অসাম্প্রদায়িক ছিলো, বলতে পারবেন কেউ? সেই সময়ের কোনো ইতিহাস কি কেউ কখনো পড়েছেন? ইমাম সাহেব অলীক কোনো স্বপ্ন দেখছেন না তো? ইতিহাস সাক্ষী, ভারতীয়দের মধ্যে একতা থাকলে শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষ বিদেশীদের দ্বারা শাসন হতো না।বৃটিশ সামাজ্র্যে কখনও সূর্য অস্ত যেতো না, সে কি এমনি এমনি ছিলো? সেটুকু দূরদর্শিতা ছিলো বলেই তারা দু’শ বছর আমাদের শাসন করেছে। ভারতের সব বিচ্ছিন্ন টুকরো গুলোকে একসাথে জুড়ে যেমন গোটা ভারতের মানচিত্র এঁকেছিল আবার ছেড়ে যাওয়ার সময় টুকরো’ও করে গেছে এই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। নইলে কোন যুক্তিতে একটি দেশ এখন তিনটি দেশ?

তিনটি দেশ হয়েই কি থেমেছি আমরা কোথাও? এখনও সেই হানাহানি করেই যাচ্ছি। আড়াইশ বছর আগেও যা ছিলো এখনও তো তাই আছে। ব্রিটিশদের এই রাজনীতি এখন খেলছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা। বাংলাদশে যা অবস্থা ভারতেও অবস্থাও তথৈবৈচ। জনতা খায় রাজনীতিবিদরা খাওয়ায়, খেলা চলছে হরদম এবং চলবে “কায়ামত সে কায়ামত তাক”।

আড়াইশ বছরে ঈদ–পূজা ডিজিটালাইজড হয়েছে কিন্তু চলছে। বরং আরও বেড়েছে, থামে নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমরা কি করে রক্ষা করি? ফেসবুকে অসাম্প্রদায়িক স্ট্যাটাস লেখা’র মাধ্যমে। সেই স্ট্যাটাসের ভাষা হয়ঃ “সব মুসলিম বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা” কিংবা “সব সনাতন ধর্মালম্বীদের শারদীয়া শুভেচ্ছা”। শুভেচ্ছা’র মতো একটা সার্বজনীন ভদ্রতা’ও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই পায় না, হায় অভাগা ভারতবর্ষ। আমাদের পূর্ব পুরুষরা যা করে গেছে আমরাও তা বিনা বাক্যে পালন করে যাচ্ছি। কখনও কি নিজের মনকে প্রশ্ন করি, কি করছি আর কেনো করছি?

যেকোন একটি ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশ–পাকিস্তান–ভারতের মধ্যে যে পরিমান গালি’র বন্যা বয়ে যায় তাতে নিঃন্দেহে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতাই ধরা পড়ে। বিচ্ছিন্ন হওয়া যে আমাদের কতটা অনিবার্য ছিলো তা আজও প্রতীয়মান। ফেসবুকে’র বিভিন্ন লেখালেখি গ্রুপে আমার খুব সামান্য যাতায়াত। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষাভাষী গ্রুপে আমি বেশি যুক্ত। এই খেলা নিয়ে দু’দেশের দুই সৃজনশীল যে ভাষায় একজন মানুষ অন্য একজনকে আক্রমণ করে তারপর সেই মানুষই আবার প্রেমের কবিতা’ও লেখে। সেলুকাস।

সর্বশেষে বলছি, পুত্র হারা ইমাম সাহেব ছেলে হত্যার বিচার চান না। এই দুঃখী আত্মার প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এটি কিন্তু খুব সুস্থ কোনো ব্যাপার নয়। আপনারা যারা ইমাম সাহেবের মহানুভবতা দেখছেন এরমধ্যে তার সাথে কি তার বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, প্রচলিত গনতন্ত্রের প্রতি অনাস্থাটা দেখতে পেয়েছেন? তিনি মহান, আমিও নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করছি কিন্তু সাথের এই কারণ গুলো’ও বাস্তব। বিচার চান নি “দীপন” এর বাবা’ও। কারণ জানতেন বিচার পাবেন না। বিচার চেয়ে চেয়ে আজও পথে পথে ঘুরছেন, অভিজিতের বাবা। বিচার পাননি। তারা সবাই কিন্তু ঠিক একই কারণে খুন হয়েছেন। এই ভারতবর্ষে কম ছেলের প্রাণ উৎসর্গ হয় নি। আজকে আসানসোল তো কালকে ব্রাক্ষনবাড়িয়া। ইমাম সাহেবের ছেলের আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে যাদের কখনও কোন বিচার হয় নি, হয় না আর হবে না।

ইমাম সাহেবের শোকার্ত পরিবারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর অর্ক ভাদুড়ী’কে অসংখ্য ধন্যবাদ এই মর্মস্পর্শী লেখাটি আমাদের দ্বারে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।

 

1603 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।