ডোর (২০০৬) হিন্দী ছবিটা একটা মালায়ম ছবি পেরুমাযাক্কালাম (২০০৪) এর হিন্দী এডাপশান। দু’জন খুব আলাদা জীবনে অভ্যস্ত নারীর জীবন নিয়ে এই সিনেমাটা। একজন থাকে রাজস্থান আর একজন হিমাচল প্রদেশ, একজন হিন্দু রাজপুত আর একজন সাধারণ মুসলিম, একজন মুখে শব্দ না তোলা লক্ষী পয়মন্ত গৃহবধূ তো অন্যজন নিজের জীবন নিয়ে কঠোর সংগ্রাম করা স্কুল শিক্ষিকা। দু’জনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব কিন্তু একটি দুর্ঘটনা দু’জনকে কাছাকাছি নিয়ে এলো এবং শেষে এক সূঁতোয় খানিকটা গেঁথে নিলো। “নিয়তি” একটি অমোঘ পরিণতি যাকে চাইলেই এড়ানো যায় না। দু’জনের স্বামী’র কারণে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কিংবা তাদের স্বামীদের ভাগ্যে তাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে। একটি হলো দুর্ঘটনা আর একটি বিবেচনা।
রাজস্থানের কূলবধূ মীরা, স্বামী মরে যাওয়ার পর মন্দিরে যাওয়া ছাড়া আর যার কোথাও যাওয়ার স্বাধীনতা নেই। নেই কোনো রঙিন কাপড়, চুড়ি, গয়না পরার অধিকার। হাসি, গান আনন্দ যার ষোড়শী জীবন থেকে প্রায় কেড়ে নেয়া হয়েছে, বন্ধুত্ব হয় তার স্বাধীনভাবে নিজের মতো গুছিয়ে জীবন যাপন করা হিমাচল প্রদেশের মেয়ে জিনাতের সাথে। মীরার অসহায় মুহূর্তের সাথী হয় জিনাত। জিনাত মীরা কে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে অনুপ্রেরণা দেয়। দুঃখী মীরা’র জীবনে আনন্দ হয়ে আসে, মীরা তো তাই ভাবে, আসলেও তাই কি?
কোন পরিস্থিতিতে কেনো বন্ধুত্ব হয় মীরা আর জিনাতের? দু’জনের জীবন যাত্রায় এত এত পার্থক্য থাকা সত্বেও কি সেই পটভূমি যা দু’জনকে এক সাথে করে? যখন মীরা জানতে পারে, মীরা’র বন্ধুত্ব নিঃর্স্বাথ থাকলেও জিনাতের বন্ধুত্ব পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ছিলো না তখন কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না এই মেয়েটির ওপর? তার এই একলা জীবনে সারা পৃথিবীতে জিনাতই তো এক মাত্র বন্ধু ছিলো যে মীরাকে বুঝতো, মীরা যার ওপর ভরসা করতে পারতো। এখানেও জীবন তাকে ধোঁকা দিলো? ভালোবাসার এই প্রতিদান! তবে কি স্বার্থহীন বন্ধুত্ব বলে আসলেই কিছু নেই?
আয়েশা টাকিয়া আর গুল পানাংগ সমান সমান অভিনয় করেছে এটাতে। বড় বড় মেলোড্রামা নেই কিন্তু ছোট ছোট অভিব্যক্তি দিয়ে পুরো সিনেমা জুড়ে নারী জীবনের অব্যক্ত বেদনা’র রঙ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে সার্থক হয়েছে দু’জনেই। যখন মীরা জানতে পারলো, কূলের মান রক্ষার্থে, বাড়ি বাঁচানোর জন্যে তার শ্বশুর তাকে কন্ট্রাকটারের কাছে বিক্রি করে দেবে তখন তার চেহারার অভিব্যক্তি, শ্বশুরের সাথে কথোপকথনে গলার স্বরের যে পরিমিতি বোধ মনে দাগ কেটে যায়। গুল পুরো সিনেমাতেই তার শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের জন্যে অনন্য ছিলো।
“ডোর” খুব নীরবে কিন্তু খুব শক্তিশালী কন্ঠে নারীদেরকে জানায়, তোমার অধিকার আর কর্তব্য দুটো সম্বন্ধেই সচেতন হও। যে পরিস্থিতিতে দু’জন মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিলো তা সবার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেবে। দুটো ছেলে তাদের পরম প্রিয় ভালোবাসাকে পেছনে রেখে সৌদি আরবে যায় জীবিকার সন্ধানে। তাদের কি ধারনা আছে তাদের অনুপস্থিতির এই সময়টা তাদের কেমন কাটবে নিজের দেশে? বদ্ধ বাড়িতে কেমন হয় মেয়েদের জীবন, কূল-মানের নামে? পদে পদে বাড়িতে অবহেলা, শাস্তি, মনুষ্যত্বের অপমান, পশুদের সাথে যেমন নির্দয় ব্যবহার করে ভারতবর্ষের মানুষ তার কাছাকাছি আচরণ করে নারীদের সাথেও। তাদের যত চিন্তা সমাজ নিয়ে, যেনো মেয়েরা সমাজের কোনো অংশ নয়, তারা অন্তপুরে মরার জন্যেই জন্মায়। মেয়েদের যত অন্তপুরে আবদ্ধ করে রাখবে সমাজে তত প্রতিপত্তি বাড়বে, নাম – যশ, খ্যাতি হবে। নারীদের মুক্ত জীবনের ধারনা দেয়ার জন্যে উচ্চকন্ঠের আন্দোলন আর কঠিন কঠিন শ্লোগানের চেয়েও অনেক বেশি বলা যায় এ ধরনের সিনেমার মাধ্যমে।
মীরা কি সম্মতি দিয়েছিলো জিনাতের হাতে থাকা “মার্সি পিটিশানে”? কোনো নাম ঠিকানা ছাড়া পুরো রাজস্থানে কি করে মীরাকে জিনাত খুঁজে বের করলো? কেনোই বা করলো? শ্বশুর বাড়ির পুরো বিপক্ষে যেয়ে মীরার কি পরিণতি হলো? জানতে ইচ্ছে করছে তো? সব মানব মানবী’র জন্যে অবশ্যই দেখনীয় সিনেমা এটি। খুবই ভিন্ন বক্তব্যধর্মী সিনেমা’র মূল বক্তব্যটি ধর্ম, সম্প্রদায়, শ্রেণি, লিঙ্গ সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এটির শেষটাও খু্ব অভাবনীয়, বলা যায় যা সচরাচর হয় না। সিনেমাটা যদিও আর্ট ফিল্মের মতো এত নিরস করে বানানো নয়, যথেষ্ঠ চিত্তবিনোদনের উপকরণ দিয়েই তৈরি কিন্তু এতে প্রচুর সূ্ক্ষ্ণ সূ্ক্ষ্ণ বার্তা দেয়া আছে। সম্মোহিত হয়ে দেখার মতো সিনেমা বটে।