একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্কুলে কাজ করছি কয়েকদিন ধরে, একটা বাঙালি বাচ্চার ইন্টারপ্রেটার হিসেবে। তিনবছর আগে সে আমেরিকায় আসে পরিবারের সাথে। সম্পূর্ণ সুস্থ সবল ছেলে ছিলো। হঠাৎ করেই ওর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসা শুরু হয়। ওকে রিহাবে দিয়ে দিতে হয় একসময়। বেশ অনেকদিন ওখানে থেকে চিকিৎসা নিতে হয় ওকে। ও রিহাব শেষে এখন স্কুলে আসছে, স্পেশাল স্কুল।
আমাদের ক্লাসে মোট সাতজন বাচ্চা। ১৫-১৬ বছর বয়েস ওদের। সবাই রিহাব শেষে এখন স্কুলে। একেকজন বাচ্চার মন-মেজাজ একেকরকম। কেউ কেউ অকারণেই যখন-তখন রেগে যায়, আগ্রাসী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ মাঝে মাঝে মনমরা হয়ে যায়। কেউ কেউ আছে কথায় কথায় গালিগালাজ করে। কেউ মাঝে মাঝে খুব নির্জীব হয়ে টেবিলে মাথে রেখে ঘুমিয়ে থাকে।সাধারণ স্কুলের মতোই এখানে বিজ্ঞান, ভূগোল, গণিত, ইংলিশ, আর্ট ইত্যাদি সবই পড়ানো হয়। তবে একটু ভিন্নভাবে। এইসব বাচ্চারা পড়ালেখার অত চাপ নিতে পারে না। তাই বিনোদনমূলকভাবেই সব ক্লাস দেওয়া হয় ওদের। ওরা যখন চায়, ছবি আঁকতে পারে, গেইম খেলতে পারে, টিভি দেখতে পারে, গল্প করতে পারে। ক্লাসে টিচারদের সাথে সাথে সবসময় থাকে মেন্টাল থেরাপিস্টরা। কয়েকজন থেরাপিস্ট সবসময়ই ক্লাস পরিদর্শন করতে থাকে। পরিদর্শন বলতে শুধু যে দেখে চলে গেলো, তা নয়। এরা প্রত্যেকে একেকজন বাচ্চার সাথে বসে গল্প করে, গেইম খেলে, ছবি আঁকে; এরকম আরো কত্তো কী!
খেলাধুলা করতে এদেরকে মাঠে ও জিমরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। থেরাপিস্ট ও টিচাররা বাচ্চাদের সাথে ফুটবল ক্রিকেট বেডমিন্টন ইত্যাদি খেলে। বাচ্চাদের সাথে এরা বাচ্চা হয়ে যায়, আমাদের দেশের শিক্ষক ও ডাক্তারদের মতো 'খাইসি তোরে' টাইপ ভাব নিয়ে থাকে না। বাচ্চাদের মধ্যে কাউকে আগ্রাসী হতে দেখলে, কারো মন খারাপ হতে দেখলে এরা তাৎক্ষণিকভাবেই সে বাচ্চার কাছে যায়। স্নেহের একটি কোমল হাত তার মাথায় রেখে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার, হানী? কেউ রেগে গেলে অতি স্নিগ্ধভাবে তাকে বোঝায়, তার সাথে কড়া গলায় কথা বলে না। এদের মুখে সর্বদা মায়াময় স্নিগ্ধ হাসি গেলেই থাকে। কাউকেই কখনো রাগতে দেখি না, কারো মুখ ভার দেখি না, দেখি না, বিরক্তির কোনো ছায়া বা চিহ্ন কারো চোখে-মুখে কখনো।
এক মেয়ে আমাকে সেদিন বাংলায় গালি দিতে শুরু করে জিমে। এবং সে অন্যান্য বাচ্চাদেরও বাংলা গালি শিখিয়ে দিয়ে আমাকে গাল দেওয়াতে থাকে ওদের মাধ্যমেও। এর আগে আমি জানতামই না যে মেয়েটি বাঙালি। আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। যদি ওরা আমাকে আক্রমণ করে বসে! মারধোর যদি করে! জিমরুমটা অনেক বড়। আমি আস্তে করে অন্যদিকে সরে যাই। কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়ে না। আমাকে অনুসরণ করে আমার কাছে এসে আবার গালি দিতে শুরু করে।
অবস্থা দেখে একজন শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? আমি তাকে ঘটনার বর্ণনা করি। আরো শিক্ষক ও থেরাপিস্টরাও এগিয়ে আসে। ওরা বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে শুরু করে, বোঝাতে শুরু করে। বাচ্চারা বুঝতে পারে নিজেদের ভুল, এবং আগের মতো খেলতে শুরু করে।
থেরাপিস্টরা এই ঘটনাটির উপর রিপোর্ট লিখে। প্রতিদিন প্রতিটি বাচ্চার প্রতিটি আচার-আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও রিপোর্ট করাও এদের কাজ। কারণ ওদের চিকিৎসা এর উপর নির্ভর করেও অনেকখানি হয়ে থাকে। অষুধ কতটুকু কমাতে বা বাড়াতে হবে, কনসাল্টেশন কী রকম হবে তাও নির্ভর করে ওদের আচরণের উপর।
আমি একটু ভয় পাই বাচ্চাদের ব্যবহারে। যদি আমাকে আবার আক্রমণ করে! আমি একজন থেরাপিস্টকে জিজ্ঞেস করি, কালকে কাজে আসতে কোনো বিপদ নেই তো আমার? সে আমাকে অভয় দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, কোনো ভয় নেই। এই ঘটনা এখানেই শেষ। তুমি নির্ভয়ে কাজে আসতে পারো কাল। সত্যি, তার পরদিন কাজে গিয়ে দেখি, সবই ঠিকঠাক! এ-কয়দিন এদের সাথে কাজ করে আমি উপলব্ধি করলাম, এই প্রতিষ্ঠানে এইসকল বাচ্চাদের সাথে যারা কাজ করে, তারা এসব বাচ্চাদের দেখাশোনা ও যত্ন শুধু বেতনের বিনিময়ে দায়িত্ব হিসেবে করে না, এরা সবকিছু প্রাণের গভীর থেকে ভালোবেসে করে, সুগভীর মমতার সাথে। প্রতিটা বাচ্চার জন্য এদের প্রত্যেকের নির্ভেজাল অক্লান্ত মমতা ভালোবাসা যত্ন দেখে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় এদের প্রতি আমার মাথা অবনত হয়ে আসে। এমন সহকর্মী এমন পরিবেশ আর এমন বাচ্চাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য।