তামান্না ঝুমু

ব্লগার ও লেখক

হলে আমার সিনেমা দেখা

আমি আমেরিকায় আসার কয়েক বছর পরে এক কাকা, সুজন-কাকার বাসায় বেড়াতে যাই। কাকা-কাকি কী আদর-যত্ন যে করেছিলো আমায়, মনে পড়লে এখনো বুকে টান পড়ে। কাকা আমায় জিজ্ঞেস করে, তোর কী কী করতে ইচ্ছা করে, কোথায় কোথায় যেতে ইচ্ছা করে, কী কী খেতে ইচ্ছা করে, বল। আমি বলি, কাকা, সিনেমা হলে গিয়ে একটা মুভি দেখার আমার জীবনের একটা বড় সাধ। সিনেমা হল কেমন তা দেখতে খুব ইচ্ছা করে, জীবনে কখনো দেখিনি! আপাতত আর কোনো সাধ-আহ্লাদ নাই।

কাকা অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, তুই জীবনে সিনেমা হল দেখিস নি! এ সময়ের সন্তান হয়ে কী অদ্ভুত কথা শোনালি রে! দেশেও না? এত বছর আমেরিকায় থাকছিস, এখানেও না? আমি হেসে বলি, না, কাকা! সেদিন বিকেলেই কাকা-কাকি, আমার দুই কাকাতো ভাইবোন আর আমি মিলে সিনেমা দেখতে যাই হলে। যিশুর উপর নির্মিত কোনো মুভি, ইংরেজিতে। তখন আমি ইংরেজিতে নির্ভেজাল A-অক্ষর গো/শূকর-মাংস, একশব্দও বুঝি না। তাছাড়া হলে গিয়েছি তো হল দেখতে, মুভি দেখতে তো না! সবাই মুভি দেখছে নিমগ্ন হয়ে, আর আমি চোখ গোল গোল ক'রে অপলকে হলের সিলিং দেখছি, মেঝে দেখছি, চারদিকের দেয়াল দেখছি, বিশাল পর্দার বিশাল বিশাল মানুষদের দেখছি। মনে হচ্ছে, পর্দার বিরাট বিরাট মানুষেরা হেঁটে হেঁটে আমার গায়ের দিকে চলে আসছে। ভয় লাগছে, আবার রোমাঞ্চও হচ্ছে। নিজেকে বিশ্ববিজেতার মতো মনে হচ্ছে। আমি হলে বসে সিনেমা দেখছি, তাও ইংরেজি সিনেমা! কত বড় সৌভাগ্য আমার! ইংরেজি বুঝি না, তাতে কী! আমার যে সাধ বিয়ের আগে আমার পিতামাতা পূরণ করে নি, বিয়ের পরে বর পূরণ করে নি, সেই সাধ পূরণ করে দিলো কাকা। আনন্দে অমি অভিভূত হয়ে থাকি।

মুভি শেষে কাকা-কাকি জিজ্ঞেস করে, মুভি কেমন লাগলো রে? আমি ভাব নিয়ে বলি, খুব ভালো। আমি যে ইংরেজির ই-ও বুঝি না তা কাকা-কাকিকে বুঝতে দেওয়া তো কোনো বুদ্ধিমানের কাজ না।

আমার প্রতিবেশী জ্যাঠাত বোন রত্না শর্মিলা নার্গিস আপারা ওদের নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে প্রতিবারই হলে মুভি দেখতো। ওদের নানাবাড়ির পাশেই সিনেমা হল কিনা! আমার জেঠি খুব উদার মনের মানুষ। তার মেয়েরা মুক্তবিহঙ্গের মতো মানুষ হয়েছে। জেঠি নিজেও ছিলো পাখির মতো জীবনের। ওরা বাড়িতে ফিরে এসে কত কী গল্প করতো! আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো। আমি তৃষিতের মতো শুনতাম ওদের সিনেমা দেখার গল্প। বলতাম, ইশ, আমিও যদি পারতাম তোদের সঙ্গে যেতে! ওরা বলতো, পরের বার নানাবাড়ি যাবার সময় তোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো রে! নানাবাড়ির সবাই তোকে অনেক আদর করবে; তোর সিনেমা দেখাও হবে, বেড়ানোও হবে।

জেঠি বাপের বাড়ি যাবার সময় অনেকবার আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে কত আগ্রহের সঙ্গে! তা আমার সিনেমা দেখার শখ পূরণ করতে যতটুকু, তার বাপের বাড়িতে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া তারচেয়ে বেশি। পিতাকে কতবার বলেছিলো জেঠি বাপের বাড়ি যাবার সময়, ঝুমুকে আমার সঙ্গে দাও, ক'দিন বেড়িয়ে আসবে। আমাকে বলতো, চল রে, নানুবাড়ি যাবি। কিন্তু আমার পিতামাতা যেতে দেয় নি কখনো। পিতার এক কথা, মেয়েমানুষ বিয়ের আগে থাকবে বাপের বাড়ি, আর বিয়ের পরে থাকবে শ্বশুরবাড়ি। অন্য কোথাও খারাপ মেয়েছেলেরা যায়। সিনেমা খারাপ মেয়েছেলেরা দেখে। মায়েরও একই কথা।

আমি মনে মনে আকাশে-বাতাসে স্বপন বপন করতাম দিবানিশি। একদিন আমার বিয়ে হবে। আমি বরের সঙ্গে হলে গিয়ে মুভি দেখবো, আরো কত জায়গায় বেড়াতে যাবো। তখন কখনো জ্যাঠাতো বোনদের সঙ্গে দেখা হলে এসব রোমাঞ্চকর আনন্দগাথা শোনাবো ওদের।

একদিন আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর আমি বরের কাছে অনেক আশা নিয়ে অনুনয় করে বলি, চলো না, আমরা একটা মুভি দেখতে যাই হলে। সে আমাকে মুখ ঝামটা মেরে বলে, নষ্ট মেয়েরাই শুধু এ ধরনের কথাবার্তা বলে। কই, আমার মা তো কোনোদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখে নি! আর তুমি দেখতে চাইছো সিনেমা! আর কোনোদিন যেনো না শুনি এসব বাজে কথা! তাহলে সম্পর্ক রাখবো না, ব'লে দিলাম। স্বপ্নভঙ্গে আর তালাকের ভয়ে আমার আশৈশব লালিত স্বপ্ন-সাধ আমি নিজের মধ্যে হজম করে ফেলি টুপ করে গিলে। চোখ, বুক আর কণ্ঠে বাষ্প জমে। আমি নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে মন দিয়ে শ্বশুরবাড়ির আনাজ কুটতে থাকি, বাটনা বাটতে থাকি, রুটি বেলতে থাকি।

আমেরিকায় আসার অনেকদিন পর আরেকদিন তার কাছে একই আবদার করে বসি। চলো না, একটা মুভি দেখে আসি। হল দেখার বড় শখ যে আমার! শুধু হলটা দেখার জন্যই যেতে চাই। সে একই উত্তর দিয়েছিলো এতদিন পরেও। আমি ভেবেছিলাম, এতদিনে হয়তো তার মনে রহমত পড়েছে কিছুটা। কিন্তু আমার আশৈশব লালিত সাধের গুড়ে এবারেও বালি। নিজে নিজে যে হলে মুভি দেখতে যাবো, সেই স্বাধীনতা তখন আমার ছিলো না, সেটা ছিলো এক কল্পনাতীত ব্যাপার।

আমার জীবনের বিরাট একটা সাধ পূরণ করেছে সুজন-কাকা। একথা যতবার মনে পড়ে ততবারই চোখের কোণে নোনা জল জমে। চোখেরা বড় দুর্বোধ্য। আনন্দের অনুভূতিতেও বড় অবুঝ বেয়াড়ার মতো আচরণ করে!

1966 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।