তসলিমা নাসরিন এর সাথে আমার ফেসবুক বন্ধুত্ব নেই এটা অনেককে অবাক করে। আমার অবাক লাগে না। ২০১২/২০১৩ তে তাঁকে দুবারের মতোন অনুরোধ পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। পরে আর তাঁকে অনুরোধ পাঠানোই যায় না দেখে বিরত থেকেছি। তাঁর পোস্ট তাঁর ওয়ালে গিয়ে পড়ে আসি। সেদিন ছোটো এক ভাই বললো তনাদির সাথে আপনার এড করিয়ে দিবো। আচ্ছা বললাম। এড হলাম।
তসলিমা নাসরিন নামের মানুষটিকে আমি ফেসবুকে চিনি না। আমার যখন টিনএজ চলছে তখন তাঁর কলাম পড়ে আমি অভিভূত হয়ে যাই। সহমত পোষণ করতে থাকি। সময়টা হবে ১৯৯০-১৯৯২। আমার কাজিন বলছিলো যে- একটা কাগজ দিব তোমায় পড়ো, আমাদের ময়মনসিংহেরই মেয়ে, তবে সে অদ্ভুত কথা লিখে। আমি পড়লাম। বললাম, ঠিকই তো আছে। তাঁর কথাগুলি তো আমারও কথা। প্রথম যে লেখাটা পড়েছিলাম সেটি তিনি লিখেছিলেন তার ডাক্তারি পেশায় রোগীদের সম্পর্কে। যে লেখাটি পড়ে প্রায় সকলে তাকে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলো। লেখাটি ছিলো এক সন্তানহীন দম্পতির সন্তান প্রাপ্তির চিকিৎসা নিয়ে, সন্তান না হবার দরুণ বউটিই পরিবারে তিরস্কৃত হয়ে আসছিলো। বরটির ফের বিয়ের কথা বলছিলো পরিবারের লোকজন। তসলিমা নাসরিনের সাথে এ কথা বউটি শেয়ার করলে তিনি প্রশ্ন রাখেন, যদি এমন হয় যে আপনার স্বামী বন্ধ্যা মানে সন্তান দিতে অক্ষম তখন কি এই পরিবারে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন পুনর্বার বিয়ে করার? বউটি জানায় এটি কেমন করে হয়। তিনি বলেন, যে অভিযোগে সে আপনাকে রেখে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা ভাবতে পারে আপনি কেন একই অভিযোগে সে কাজ করতে পারবেন না? বউটি মাথা নীচু করে থাকে। এমনই ছিলো মূল বিষয়। অনেক আগের কথা হয়তো হুবুহু তুলে দিতে পারলাম না।
আমার সে কাজিন পুরাদস্তুর মৌলবী মহিলা, আমার চে বছর আট বড়ো। আর আমি তখন স্বাধীনতার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছি এক টিনএজড, নিজেকে কেবল মেয়ে মানুষ নয় একজন মানুষ হিসেবে দৃঢ় মেরুদন্ড নিয়ে গড়ে উঠবার লড়াই করছি। যতোবার মুখ থুবড়ে পড়েছি ততোবার তাঁর লেখাগুলো পড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। বইয়ের দোকান তখন আমার প্রিয় জায়গা হয়ে উঠে। দোকানে গিয়েই খোঁজতে থাকি তাঁর নতুন কোনো বই এসেছে কি না। এলো তো কিনতেই হবে আমার, কিনেছি আর বার কয়েক পড়েছি। কারণ একটাই। ওসবে মানুষ হয়ে বাঁচবার চেতনাটা প্রবল হয়।
'যাবো না কেন যাবো', 'তুমি যদি চরিত্রহীন হও' এ দুটো লেখা তো প্রবলভাবে মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলেছে। সেই থেকে কতো বছর হয়ে গেলো। তার সাথে কোনোওভাবে আমার কোনো এড নেই। তাঁকে ধারণ করেছিলাম মগজের ভেতর, বুকের ভেতর। তাঁর লজ্জা বইটি নিয়ে যখন তোলপাড় তখন এক বন্ধুকে বললাম, মোল্লারা লাঠিসোটা নিয়ে নামতে যাচ্ছে আমরা কি বসে থাকবো? সে বলেছিলো, নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমাদের চেতনা ধারণ করা মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম। আমরা তাঁকে রাখতে পারিনি। চলেই যেতো হলো তাঁকে নিজের পরিচিত গন্ডী ছেড়ে। আজো নিষিদ্ধ। অবাক লাগে। বাঙলাদেশ নামক ভূখন্ডটি এবং তার শাসকদের প্রতি আফসোস হয়, করুণা হয়, দুঃখ হয়।
আমি সরাসরি মিশিনি তাঁর সাথে কিন্তু তাঁর সাথে যারা মিশেছে তাদের অনেকের সাথে আমি মিশেছি। সাহসী, মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে তারা তসলিমা নাসরিনকে দেখেছেন। ফেসবুকে আমাকে অনেকবার 'তনার মুরিদ' 'তনান্ধ' বলে তিরস্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রেও এটি ফেস করেছি। বরাবরই বলেছি, তাঁর মতো সাহস আমার নেই। ফেসবুকের বাসিন্দারা তনান্ধ বলে কী মজা পায় বুঝি না ঠিক। শুধু এটুকু বুঝি, যাকে ভালোবাসি তাকে অহেতুক তিরস্কার করলে আহত হই। অনুভূতি আহত হয়। ভালোবাসার অনুভূতি। জগতে সম্ভবত এর চে মহৎ অনুভূতি আর একটিও নেই।