ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার কলকাতা থেকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। গ্রামে এসেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন এলাকাবাসীদের খবরাখবর নিতে। তিনি হেঁটে হেঁটে এবাড়ি-ওবাড়ি যাচ্ছেন। কুশল-বিনিময় করছেন সবার সঙ্গে। কারো কোনো দুঃখ-দুর্দশা আছে কিনা, কারো কোনো সমস্যা আছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন। এরকম এক বাড়িতে গিয়ে তিনি ওদের খবরাখবর নিচ্ছেন, কথাবার্তা বলছেন -এইসময়ে তাঁকে জলখাবার খেতে দেওয়া হলো। তিনি সে-বাড়ির সবাইকে সাধছেন তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য। কিন্তু বাড়ির নারীটি খাবে না কিছুতেই। কারণ জিজ্ঞেস করতে সে বললো, আজ একাদশী, তাই সে উপবাসব্রত পালন করছে তার স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে। তাই সারাদিন সে কিছুই খেতে পারবে না। খাবে সেই সন্ধ্যায়। বিদ্যাসাগর খাবার হাত থেকে রেখে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। সবাই তো অবাক! আরে আপনি কাঁদছেন কেনো? তিনি বলছেন, তুই সারাদিন কিছু খাবি না? না খেয়ে থাকবি সারাটা দিন? আর তাতে কারো আয়ু বেড়ে যাবে? একজন মানুষ সারাদিন না খেয়ে থাকবে? এত নিষ্ঠুরতা!
হতভম্ব সবাই। এ তো নতুন কিছু নয়। অনাদিকাল ধরে হিন্দু নারীরা একাদশীতে স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য উপবাসব্রত পালন করে আসছে, এ কে না জানে? এজন্য কে কাঁদে, কোন বোকা পুরুষ চোখের জল ফেলে হাউহাউ করে কাঁদে? সবাই অনেক সাধাসাধি করলো, জোরাজুরি করলো অনেক, তাঁকে খাওয়ানোর জন্য। তিনি খেলেন না, খেতে তিনি পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বের হয়ে গেলেন ওই বাড়ি থেকে।
একজন নারীর একদিনের উপবাসের কথা শুনে আমাদের বিদ্যাসাগর হাউমাউ করে কেঁদেছেন, সে-নারীর উপবাসের কষ্ট তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। তিনি নিজে না খেয়ে, হাতের খাবার রেখে কেঁদে কেঁদে বেরিয়ে গেছেন সে-বাড়ি থেকে। আর এমন একজন নাকি আছে--অগণিত মানুষ দীর্ঘ একমাস সারাদিন না খেয়ে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ত্রাহি ত্রাহি করতে থাকলে যে মহানন্দে আটখানা হয়ে যায়! ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মানুষ কষ্ট পাবে, ছটফট করতে থাকবে, কিন্তু সামনে খাবার থাকা স্বত্ত্বেও কেউ মুখে দিতে পারবে না একবিন্দু জল কিংবা একদানা অন্ন। কারুর এই প্রাণফাটা কষ্ট দেখে যদি কেউ মজা নিতে পারে তার চেয়ে নিষ্ঠুর, তার মতো বদ আর কে আছে এ-জগতে?
অনেক মডারেট ও অমডারেট মুসলমান এই বর্বর উপোস-থাকার পক্ষে তাদের নিজেদের মনগড়া অনেক যুক্তি দিয়ে থাকে। তাদের যুক্তিগুলি হচ্ছে- ১। এতে গরিবের কষ্ট বোঝা যায়। ২। এটা শুধু খানাপিনা-সংযম না, সব রকমের সংযম কিন্তু। তাই এ-মাসে অপরাধ কম হয়। ৩। দিনের বেলা খাওয়া হয় না বলে অপচয় কম হয়। ৪। এভাবে উপোস থাকা খুব বৈজ্ঞানিক ব্যাপারস্যাপার, তাই এইমাসে উপোসী মোসলমানদের স্বাস্থ্যের খুব উন্নতি হয়ে যায় ইত্যাদি।
আমি এখন একে একে এই নিষ্ঠুরতার পক্ষের হাস্যকর যুক্তিগুলি খণ্ডন করার চেষ্টা করছি।
১। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই উপবাস আইন পাস করেছিলো ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। অনাহারি মানুষের কষ্ট বোঝা ও সে-মর্মে দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করা যদি এর উদ্দেশ্য হতো তাহলে এই আইন প্রবর্তনের দেড় হাজার বছর পরে এ-পৃথিবীতে, সারা পৃথিবীতে না হোক অন্তত কোনো মুসলিম দেশে কোনো দরিদ্র বা অনাহারি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাওয়ার কথাই ছিলো না! কিন্তু ফ্যাক্ট হচ্ছে এই যে, এ-পৃথিবীতে মুসলিম জাতিই সবচেয়ে বেশি পশ্চাৎপদ, জ্ঞান বিজ্ঞান অর্থনীতি মন-মানসিকতা শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাকার সবদিক থেকেই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, নবী যেভাবে বলেছে সেভাবে তো কেউ করে না। এটাও শুধুই পক্ষপাতিত্বের জন্যই পক্ষপাতিত্বমূলক কথা বলা। কারণ নবী নিজেও তার জীবদ্দশায় উপোস করে কোনো দরিদ্রের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে দেয় নি। দিতে পারবেন কি আপনারা কোরান-হাদিস থেকে এর কোনো রেফারেন্স? পৃথিবীর উন্নত, মানবিক ও সভ্যতম দেশগুলির দিকে দেখুন, সবগুলি দেশই কিন্তু অমুসলিম দেশ। সবচেয়ে বেশি চ্যারিটি ওরাই করে, ওরাই বঞ্চিত মানুষের পাশে এসে সবার আগে দাঁড়ায়। এ-মানবিক গুণাবলি ওরা রোজা, মানে উপোস থেকে থেকে অর্জন করে নি। মানবিক হবার জন্য বোধশক্তি ও হৃদয়ে ভালোবাসা প্রয়োজন। এবং তা উপোস থেকে অর্জন করা সম্ভব না। উপোস থাকলে মস্তিষ্ক কিংবা হৃদয় ঠিক মতন কাজ করতেও সক্ষম হবে না।
হার্টের ডাক্তার হবার জন্য হার্টের রোগী হতে হয় না। ক্যান্সারের গবেষককে ক্যান্সারের রোগী হতে হয় না। পশু-ডাক্তার হতে হলে পশু হতে হয় না। নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে নারী হওয়া লাগে না। কিডনির ডাক্তার হতে কিডনির রোগী হতে হয় না। তেমনি অনাহারি মানুষের কষ্ট বোঝার জন্য অনাহারি আইনের প্রয়োজন নেই। কেউ ইচ্ছা করে উপোস করলে করুক। সেটা কারো নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আইন করে সবাইকে অনাহারে থাকতে বাধ্য করা হবে কেনো? এটা বর্বরতা ছাড়া আর কী? প্রাপ্তবয়স্ক সকল সুস্থ মুসলমানের জন্যই রোজা ফরজ। গরিবের দুঃখ বোঝাই যদি এর উদ্দেশ্য হতো তাহলে দরিদ্রদের উপরেও তা ফরজ করা হলো কেনো? যারা সারাবছরই অনাহারে অর্ধাহারে থাকে তাদের ওপর আবার এই বাড়তি অনাহার অনশন ধর্মঘট বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগের নির্যাতন কেনো? এ-যুক্তিটি তাই এখানেই নাকচ হয়ে যায়।
২। এই উপোসী মাসটাকে সংযমের মাস বলে মোসলমানরা। এটা নাকি শুধু খাওয়ার সংযম না, সবকিছুর সংযম। তা সে-সকল সংযমগুলি কী কী? মুসলিম দেশগুলিতে কি অপরাধ কম হয় এ-মাসে? মুসলমানরা কি অপরাধ কম করে এ-মাসে? না, বরং অত্যাচার অবিচার অপরাধ আরো বেশি মাত্রায় করে মুসলমানরা উপোসের মাসে। গতবছর রোজা রেখে নি বলে এক গ্রামে একটি ছেলেকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে সে-গ্রামের সহী তাওহিদী জনতা। কে উপোস করবে, কে করবে না এটা যার যার ব্যাপার। রোজা না রাখার জন্য একজন মানুষকে কেনো কেউ গোটা পৃথিবীর সামনে অপদস্থ করবে? এবং রাষ্ট বা সরকার বা প্রশাসনও সেসব জালেমদের বিচার করে নি। রোজা রাখার অপরাধে যদি কোনো মানুষকে এভাবে কান ধরিয়ে উঠবস করানো হতো পৃথিবীবাসীর সামনে তাহলে কি সরকার চেয়ে চেয়ে দেখতো সে তামাশা?
মুসলিম দেশগুলিতে এ-মাসে দিনের বেলায় হোটেল রেস্টুরেন্টগুলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাড়ায় পাড়ায় সহী মুসলমানেরা মাইকিং করে করে রেস্টুরেন্ট ও রাস্তার ধারের ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলি বন্ধ করে দেবার হুকুম জারি করে। যদিও মাইক আবিষ্কার করেছে বিধর্মী মানুষ। খাবারের দোকানগুলিকে কালো বোরকা পরিয়ে দেয়। কোনো দোকান খোলা পেলে ওরা ভাংচুর করে, লুটপাট করে, খাবারে বালি মিশিয়ে দেয়, নষ্ট করে ফেলে মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস, মানুষের ক্ষুধার অন্ন। এতে করে খেটে খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষ খেতে পারেন না। দোকানের মালিকদের বেচাকেনা থাকে না। অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হন তাঁরা। অন্যকে খেতে দেখলে বা খাবারের দোকান খোলা দেখলে যে রোজাদারের লালা ঝরে, ঈমান জেগে যায়, জিঘাংসা ফণা তোলে সে কতটা বিপজ্জনক প্রাণী, একবার ভেবে দেখুন। ওরা ওদের নারীদেরও কালো বস্তায় পুরে রাখে, খাবারের দোকানকেও কালো বোরকায় পুরে রাখে। খাবার ও নারী এদের কাছে একই জিনিস। এ-দুই জিনিস দেখলেই এদের ঈমান ফোঁস ফোঁস করে। কবি বলেছেন, এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়। আর ইসলামে জেনানারা খাবারের মতো, খাবারও জেনানার মতো রসনাময়। শুধু খেটে খাওয়া মানুষ কেনো, অভুক্ত থেকে কোনো মানুষের পক্ষেই কাজকর্মে স্বাভাবিক কর্মশক্তি প্রয়োগ সম্ভব নয়। স্টুডেন্টদের পক্ষে সম্ভব নয় সারাদিন উপোস করে পড়ালেখা করা, সৃষ্টিশীল কিছু করা সম্ভব নয় একজন শিল্পীর পক্ষে। এগুলি অপরাধ নয়? এগুলি নির্যাতন নয় মানুষের উপর? শুধুই শান্তি বিনষ্ট করা নয়? নিজেরা আমরণ অনশন করো না! কারুর কোনো সমস্যা নেই তো তাতে। অন্যদের উপর চাপিয়ে কেনো দাও নিজদের উপোসনীতির হিংস্রতা?
প্রাপ্তবয়স্ক সকল সুস্থ মুসলমানের জন্য রোজা ফরজ। ধনী-দরিদ্র বলে কথা নাই। একজন রিকশাচালক, একজন ঠেলাগাড়িচালক, একজন শ্রমিক যিনি মাটি কাটার কাজ করেন, একজন শ্রমিক যিনি ইট ভাঙেন, একজন কারখানার শ্রমিক এঁদের পক্ষে কি সারাদিন উপোস করা সম্ভব? তৃষ্ণায় গলা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, গলা দিয়ে রক্ত পড়বে তবুও পারবে না একফোঁটা জল মুখে দিতে। পেটের ক্ষুধায় প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইবে তবুও পারবে না একদানা অন্ন মুখে দিতে। দিলে দয়াময় সাহেব অভিমান করবে। এ-অমানবিক আইন যে চালু করেছিলো তার প্রতি আহ্ববান জানাচ্ছি, সারাদিন রিকশা চালিয়ে, ইট ভেঙে, মাটি কেটে, কারখানায় কাজ করে, ঠেলাগাড়ি চালিয়ে শখের উপোস করে দেখাও! আর তাতে তোমার পুলক হলে তুমি করো উপোস। মানুষকে ঠুলি পরিয়ে অমানবিক কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করো না।
রোজার মাসে কর্মজীবী মুসলিম নারীদের কথা ভাবুন একবার। সারাদিন উপোস বাইরে কামলা দিয়ে বাড়ি ফেরা-মাত্রই ইফতারি তৈরিতে লেগে যেতে হয় বেচারাদের। উপোস পেটে চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয় তৈরি করতে করতে নিজেদের আর হাল থাকে না। এরপর সবাইকে পরিবেশন করে খাওয়ানো, সবার এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করা। সারাদিন না খাওয়ার পর হঠাৎ খাবার পেটে পড়লে শরীর কাঁপে। সে-কম্পমান শরীরে আবার ডিনার তৈরি করা, নামাজ পড়া। রোজার মাসে আবার ২০ রাকাত তারাবির নামাজ বাড়তি পড়তে হয়। উটকো ঝামেলা আরকি। সারাদিন ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কষ্ট পাবার পর কার সাধ্য থাকে দুর্বল শরীরে এতবার উঠবস করে করে মেঝেতে বারম্বার কপাল ঠোকার? কিন্তু মানুষে ঠোকে রূপকথার দোজখের ভয়ে আর বেহেস্তের লোভে। না ঠুকলে যে আগুনে পোড়ানো হবে, ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ করা হবে। আর পড়লে মদ দুধ ও মধুর নদীতে ছেড়ে দিয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতা দেওয়া হবে। গৃহকর্মীদের উপরও কাজের চাপ বেড়ে যায় অনেকখানি এসময়ে। বাড়ির পেইড ও আনপেইড নারীরা এমনিতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিত। এই মাসে সে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এগুলি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। এবং এ-ভায়োলেন্স রোজার মাসে বেশি হয়।
গ্রীষ্মকালে রোজার কথা ভাবুন! অনেক শীতপ্রধান অঞ্চলে গ্রীষ্মের সময় দিন হয় অনেক দীর্ঘ, ১৮-১৯ ঘণ্টাও হয় একেকটা দিন। এতক্ষণ একজন মানুষ না খেয়ে থাকবে কীভাবে? একবিন্দু জলও তো খেতে পারবে না! গরমে প্রয়োজন-মতো পানি না খেলে মানুষ ডিহাইড্রেটেড হয়ে মারাও যেতে পারে। কোথাও কোথাও গ্রীষ্মে কয়েকমাস কেবলই দিন থাকে, সূর্য অস্তই যায় না কয়েকমাসে। আর রোজা নামাজ করতে হয় সূর্যের হিসেবে। তিনমাস কোনো জীবিত মানুষ উপোস থাকবে কীভাবে?
শব্দদূষণ এক বিরাট সমস্যা বর্তমান পৃথিবীতে। অনুন্নত দেশগুলিতে এ-সমস্যা বড় প্রকট। গাড়ি কলকারখানা ইত্যাদির দূষিত শব্দে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাণ অতিষ্ঠ। ধর্মীয় শব্দদূষণ অন্য সকল শব্দদূষণকে হার মানিয়ে যায়। মন্দির ও গীর্জার ঘণ্টার দূষিত শব্দে কলিজা ছিঁড়ে যেতে চায়। পূজা কীর্তন এসবের শব্দে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। ওয়াজ মাহফিল ও দৈনিক পাঁচবেলা দশদিক হতে অন্তরীক্ষ ঝালাপালা-করা আজানের কথা আর কী বলি? এগুলির সাথে রোজার রহমতের মাসে আরো অনেক ডিটেইল যোগ হয়। রাতের তিনটায় মাইক বাজিয়ে শুরু করে দেয় আর্তনাদ সহী মুসলমানেরা। উঠে পড়ুন। উঠে কোথায় পড়বে? কী পড়বে? কেনো পড়বে? ঘুমন্ত মানুষ উঠে পড়ে হাত-পা ভাঙবে আরকি সম্মিলিত কর্ণকুহরবিদারী আর্তনাদ শুনে! ঘুমন্ত মানুষ, অন্যান্য জীবজন্তু ও প্রকৃতির স্ট্রোক হবার জোগাড় হয় এই আর্তনাদ শুনে। মানুষের কি শান্তিতে একটু ঘুমোনোরও অধিকার নেই? ধর্মগুলি ও তাদের অনুসারীরা কি কাউকে ঘুমোতেও দেবে না? উঠে পড়ার জন্য ও রাত তিনটায় হস্তিগ্রাসে হাস্যকরভাবে খাওয়ার জন্য ওরা এলার্ম দিয়ে রাখুক না! সবার উপর গণহারে এমন অমানবিক অত্যাচার কেনো?
যেসকল মুসলিম নারীরা নিজেদের মানুষ মনে করে এবং সারাবছর স্বাভাবিক পোশাক পরে তাদের অনেকেও এ-মাসে নিজেদের আর মানুষ মনে করে না, মনে করে খাদ্যদ্রব্য। নিজেদের মাথা ও চুল ওরা ত্যানা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সুতোর বাণ্ডিল বানিয়ে নিজেদেরকে কিম্ভূত-দর্শন করে উপস্থাপন করে পৃথিবীর সামনে। টিভির সংবাদ পাঠিকা, অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা সবাই এসময়ে কিম্ভূত-দর্শন সাজার প্রতিযোগিতায় নেমে যায়। নিজের পছন্দমত পোশাক পরাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই যখন এরকম কিমাকার সাজে কেউ সাজে সমাজ এবং জুজুর ভয় ও লোভে।
৩। দিনের বেলা খাওয়া হয় না, তাই এ-মাসে খরচ কম হয়—এমন যুক্তিও কেউ কেউ দিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তার উলটো। রোজার মাসে কমপক্ষে দ্বিগুণ খরচ হয়। এ-মাসে সব জিনিসপত্রের দাম বেশি থাকে। দিনের বেলা না খেলেও খাওয়া কিন্তু কম হয় না মোটেই, বরং বেশিই হয়। হরেক-রকমের ইফতারি খাওয়ার পর তারাবি পড়ে অধিকাংশ মানুষই ভাত খায়। তারপরে সেহেরিতেও রাতের তিনটায় ঘুম থেকে উঠে খেতে খেতে কাত হয়ে যায়।
একজন রোজাদার মানুষ রাতে যে পরিমাণ খাবার খায় তা ভাগ ভাগ করে খেলে তো কয়েকদিন খাওয়া যাবে। দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টা উপোস করে রাতের বেলায় কয়েকগুণ খাওয়ার চেয়ে সমপরিমাণ খাবারটা ভাগ করে দিনরাত মিলিয়ে খাওয়া তো সবদিক থেকেই উত্তম। স্বাস্থের পক্ষেও উত্তম, নিজের কষ্টও হলো না শুধু শুধু উপোস করে।
ধরুন, খাওয়ার খাতে আপনার মাসিক খরচ ১০০০ টাকা। আপনি ঠিক করলেন, একমাস আপনি আপনার খাওয়ার খরচটা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনবেন। এজন্য আপনি দিনের বেলা খাবেন না, শুধু রাতে খাবেন। এতে করে যে টাকাটা সেইভ হবে তা দরিদ্র মানুষদের দেবেন। রোজা ব্যাপারটা এমন হলে তো আর কথাই ছিলো না। কিন্তু তা ত নয়।
অনেকে ফিতরা যাকাতের কথা বলে বলতে পারেন, দেখো কতো মহান ব্যাপার দরিদ্রদের সাহায্য করতে বলা হয়েছে ফিতরা যাকাতের মাধ্যমে এ-মাসে। জেনে রাখুন, ফিতরা যাকাত শুধু মুসলমান দরিদ্রদের দিতে পারবেন। কোনো অমুসলমানকে নয়। অমানবিকতা ও সংকীর্ণতা এখানেও লুকোনো। অন্ধত্ব, অন্ধ-ভয়, লোভ ও পক্ষপাতিত্বের কারণে তা লোকে বোঝে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো আবিস্কার শুধু আবিষ্কারকের নিজের জাতির জন্য না, তা সব মানুষের জন্য, মানবকল্যাণের জন্য। এরকম বিজ্ঞানের যেকোনো কল্যাণমূলক আবিষ্কারই সকল মানুষের জন্য। আজ মুসলমানরা আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক জীবনের যতটা সুবিধা ভোগ করছে তার কিছুই তো তারা আবিষ্কার করে নি, কোনো ভালো কিছুতেই নেই তাদের কোনো অবদান। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানী কি বলেছেন আজ অবধি, কোনো মুসলমান আমার আবিষ্কারের সুবিধা ভোগ করতে পারবে না? তাহলে যাকাত ফিতরা শুধু মোসলমানদের জন্য কেনো? কোনো মুসলমান ব্যক্তি কি বলতে পারবেন যে তিনি তাঁর ফিতরা যাকাতের টাকা কোনো অমুসলিমকে দিয়েছেন?
আর মূল ধর্মগ্রন্থে কী লেখা আছে তা ৯০ভাগের বেশি ধার্মিক লোক জানে না, সেসব বই নিজের ভাষায় পড়ে না বলে। আপনি একজন অসহায় মানুষকে সাহায্য করবেন, সে-মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন বলে, এবং আপনি সে-সাহায্য করতে সমর্থ্য বলে। কোনো পূণ্যের আশায় নয়, কোনো বিনিময়ের লোভে নয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির পানে দেখুন, দেখুন পৃথিবীর সভ্যতম দেশগুলির পানে। মানুষকে ওরা কোনোকিছুর ভয়ে বা লোভে সহায়তা করে না, করে ভালোবেসে এবং মানুষের তা দরকার বলে। এবং যাকাত ফিতরা সমাজের বা কোনো মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু নয়। এটা ভিক্ষাবৃত্তি। এতে দরিদ্র মানুষের মন ভিখারি হয়ে যায়। এতে কোনো কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় না। মানুষ কর্মবিমুখ পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। হয়েছেও তা-ই। মুসলিম দেশের মানুষই সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরমুখাপেক্ষী। ফিতরা যাকাত শুধু ভিখারি তৈরি করে—এর প্রমাণ বিশ্বজুড়ে। মানুষকে এরকম ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষাজীবী না বানিয়ে রেখে ওদের শিক্ষিত করা জরুরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। তা যেকোনো মানুষের জন্য, সকল মানুষের জন্য, কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের জন্য নয় শুধু।
৪। আমাদের এ-পৃথিবীর প্রাণীজগতে সকল প্রাণীর metabolism একরকম নয়। একেক প্রাণীর একেকরকম। শীতপ্রধান অঞ্চলের যেসব প্রাণী hibernation মানে শীতনিদ্রায় যায় তাদের মেটাবলিসম আমাদের থেকে ভিন্ন। আবার আমরা যারা হাইবারনেশনে যাই না তাদের সবারও মেটাবলিসম কিন্তু এক নয়। বিভিন্ন জলজ প্রাণীর মেটাবলিসমও বিভিন্ন রকম। হাইবারনেশনে যাওয়া প্রাণীদের মেটাবলিসমও আবার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়, এর অনেকটা ওইসব অঞ্চলের শীতকালের দৈর্ঘ্যের ওপরেও নির্ভর করে।
আমরা Homosapien রা সাধারণত ২৪ঘণ্টার মধ্যে ১৬ঘণ্টা জেগে থাকি, আর বাকি ৮ঘণ্টা ঘুমাই। ঘুমন্তাবস্থায় যেহেতু শরীরের কাজ কমে যায়, তাই ওইসময়ে আমাদের খাওয়া লাগে না। জাগ্রত ১৬ঘণ্টায় আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক সতেজ ও কর্মক্ষম রাখতে আমাদেরকে ৫/৬বার খেতে হয়। এর মধ্যে তিনটা বড় meal-- ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ও ডিনার, আর এদের ফাঁকে-ফাঁকে হালকা কিছু নাস্তা জাতীয় খাবার খেতে হয়। আমাদের শরীরের জন্য পানি অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি সুস্থ মানুষকে দৈনিক দুই লিটার পানি খেতে হয়। তবে তা একবারে নয়। সারাদিনে। ২৪ ঘণ্টার প্রয়োজনীয় পানি ও খাবার ১ ঘণ্টায় খেয়ে নিয়ে বাকি ২৩ ঘণ্টা পেটে-মুখে তালা মেরে উপোস থাকা খিদায়-তৃষ্ণায় ত্রাহি ত্রাহি করা মোটেও স্বাস্থকর কিছু নয়। এবং এই প্রক্রিয়ায় এ-নিখিলের কেউই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃতও হচ্ছে না, অপকৃত হওয়া ছাড়া।
হাঙরদের মধ্যে কয়েক প্রজাতি আছে। এক ধরণের হাঙর আছে, যারা একটি বড় আকারের meal খেলে দুইমাস না খেয়ে দিব্যি সুস্থ সবল থাকতে পারে। এরকম সময়ে ওরা নিজের চারপাশে খাবার দেখলেও খায় না, খিদে বা প্রয়োজন থাকে না বলে। কিন্তু হোমোসেপিয়েনদের মেটাবলিসম তো হাঙরের মতো নয়, যে ওরা সারাদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় রাতের বেলায় গ্রহণ করে দিনের বেলায় উপোস দিয়ে স্বাভাবিক রকমের কর্মক্ষম থাকতে পারবে। কিন্তু হোমোসেপিয়েনদের কেউ কেউ হাঙর হওয়ার চেষ্টা কেনো করে, কে জানে! তাও আবার বছরে মাত্র একমাসের জন্য! এবং তাও আবার পুরোপুরি হাঙরের মতন আচরণ না। হাঙররা তো খিদে না থাকলে দুইমাস খাদ্যগ্রহণ করে না মোটেই। কিন্তু হাঙরের অনুরকণকারী এসকল হোমোসেপিয়েনরা দিনে মাত্র ক’ঘণ্টা না খেয়ে থাকে, আর রাতে একেকজনে অন্তত দশজনের সমান খায়। খেতে না পারলেও ঢেঁকি দিয়ে ঠেসে ঠেসে খায়, তারপর অজ্ঞানের মতো হয়ে পড়ে। হুদাই স্থলজ হাঙর হবার চেষ্টা কেনো, বাপু? এতে তো স্বাস্থ্যের ক্ষতি, অর্থের ক্ষতি, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়ের ক্ষতি।
পরবর্তী ধর্মগুলি সবসময় পূর্ববর্তী ধর্মগুলির অনুকরণে তৈরি হয়। ইসলাম প্রবর্তণের সময় আরবে ইহুদি খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক ধর্ম ছিলো। এর সবগুলি থেকেই ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ধার ও নকল করেছিলো। ওল্ডটেস্টামেন্ট, নিউটেস্টামেন্ট ও কোরান পড়লে এর প্রমাণ দেখতে পাবেন। ইসলাম ধর্মে সিজদা দিয়ে নামাজ পড়ার বিধান আছে। এটা নেওয়া হয়েছে পৌত্তলিক ধর্ম থেকে। পৌত্তলিকরা ষষ্ঠাঙ্গে মূর্তিপূজা করে এভাবে। পৌত্তলিকরা পুতুলপূজা ও পাথরপূজা করে। ইসলামও ধার করেছে তা। জাহরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া আর শিবলিঙ্গে দুধ ঢালার মধ্যে পার্থক্য কী? এসব ধর্মেও উপবাসব্রতের নিয়ম আছে। ব্যস, আর যায় কই? ইসলাম সাব এ-উপোসব্রতও নকল মেরে দিলো। তবে তা আরো অনেকগুণ কঠোর ও ভয়াবহ আকারে।
ফিতরা যাকাত ও কোরবানির প্রচলন করেছিলো নবী, মদিনায় হিজরতের পর দরিদ্র মদিনাবাসীদের সামান্য কিছু সাহায্যের লোভ দেখিয়ে দলে ভেড়ানোর জন্য। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার মজুদ রেখে মাত্র ক’ঘণ্টা না খাওয়ার ভং ধরে থাকা এবং সন্ধ্যায় খাবারের উপর হামলে পড়ে দশজনের খাবার সাবাড় করা, সমাজে ও রাষ্ট্রে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে বিভিষিকা বানিয়ে রাখা কারো জন্যই কল্যাণকর কিছু নয়। অফ করুন এ-ভয়াবহ অনশনের ভং।