বাড়ি ফেরার পর গেদুর বাপের আর মাথা ঠিক থাকে না। বউয়ের নামে এমন কুৎসা তার কিছুতেই সয় না। গেদুর বাপ, ছোটোবেলায় যার নাম ছিলো কাশেম, বউকে কি ভালোবাসে? গেদুর বাপ, গেদু জন্মানোর পর ওটাই তার নাম হয়ে যায়। পাড়ায় অনেকগুলি কাশেম ছিলো। দেখতে নাদুসনুদুস হবার কারণে তার নাম হয়ে যায় লাউ কাশেম। লাউ কাশেম নিরীহ ছেলে, কারো সাথে বাড়ে না। গেদুর বাপ পরিচিতি পেলেও কাছের বন্ধুরা এখনো তাকে লাউ কাশেম বলেই ডাকে।
গেদুর বাপ সেলাই কারখানায় সেলাইদিদিদের আঙ্গুলের মাথার ওপর রাখে, ওটাই তার কাজ। মাস দুই পর এসে এসে বউকে আদর সোহাগ করে যায়। এই আদর সোহাগে আরো একটি সন্তান কামনা করলেও গেদুর বাপ আরেকটি সন্তানের বাপ হতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে গেদুর বাপের বউ পাড়ায় লোকেদের কাছে নিত্য গঞ্জনা পায়। তবে আট বছরে এখন তা গা সওয়া হয়ে গেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মীরা এখন আর গেদুর বাপের ঘরের দরজায় পা ফেলে না। স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে মাঝে সাঝে টুকটাক পরামর্শ দিয়ে যায়। সেগুলো গেদুর বাপ তার বউয়ের কাছ থেকে এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। বউ আগে এসবে রাগ করলেও এখন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
প্রতিবার বাড়ি ফেরার পর লাউ কাশেম তার বউয়ের নামে হাবিজাবি কিছু শুনে, তেমন পাত্তা দেয় না, বউকে ঝাড়ি দিয়ে থেমে যায়। কিন্তু আজ আর পাত্তা না দিয়ে উপায় নেই। গেদুর বাপকে বাড়ি ডেকে আনাই হয়েছে সালিশের জন্যে। এলাকার লাইট, এলাইট সকলে উপস্থিত। গেদুর বাপ তার বউয়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে চললো সালিশে। আজ তার দাম্পত্যের শুনানি হবে, বিচার হবে এবং তার বাস্তবায়নও হবে। সারারাত না ঘুমিয়ে বউকে কোনোরকম ঝাড়ি না দিয়ে লাউ কাশেম ঘুমহীন রাত পার করে। গেদুর বাপের নির্লিপ্ততা গেদুর মায়ের উদ্বিগ্নতা বাড়ায়। চোখ বুজে থাকা দুই নারী পুরুষের মাঝে আট বছরের শিশু গেদু অঘোরে ঘুমায়।
বউয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খুব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে লাউ কাশেম। তার বউ পরকীয়া করতেই পারে না। সে মাস দুই পরপর আসে তো কী হয়েছে? তার বউ এলাকার বাচ্চা যুবক রিন্টুর সাথে প্রেম করতেই পারে না, ওই একটাই কথা গেদুর বাপের। সালিশের একশোটা কথার উত্তর গেদুর বাপের একটাই। কিন্তু সালিশে বিচার হয়ে যায়। তারা প্রমান করে ফেলে কীভাবে কীভাবে যেনো। দেউড়িতে দাঁড়িয়ে রিন্টুর সঙ্গে প্রায়শ কথা বলাটা প্রেম না হয়ে যায় না। বউটারই বা তেমন কী আর দোষ, গেদুর বাপটা আসে দু দাস পর পর। এমন বাতচিতে সিদ্ধান্ত হয় গেদু পরিবারের সাথে এলাকার লোকজন আর কথা কইবে না। গেদুর বাপ এটাকে পাত্তা না দিয়ে বউছেলের হাত ধরে বাড়ি আসে। সারাদিন যায় বউয়ের সাথে কথা নাই, ছেলের সাথে মার্বেল খেলে আর টুকটাক কথা বলে। দুপুরের খাবার নিত্যদিনের মতোই তৈরি করে বউ। খেয়েদেয়ে গতরাতের ঘুম পুষিয়ে নেয় বউজামাই দুজনে। প্রায় সন্ধ্যায় লাউ কাশেম তার বউকে ডেকে তুলে। বউ হাই তুলে জানতে চায় কী হয়েছে?
বউকে তৈরি হতে বলে। কোথায় যাবে বউ? বাপের বাড়ি। কেনো? কারণ তার অপরাধ সে পরকীয়া করেছে। লাউ কাশেম কোনো কথা শুনে না, চোখের জলও তার কাছে নিতান্ত পানি মনে হয়। কাশেম তার নিজের ব্যাগ গুছায়, তাতে ছেলের কিছু জামা কাপড় ভরে। বউয়ের ব্যাগও সে গুছিয়ে দেয় তাতে শুধু বউয়েরই কাপড়চোপড়।
- তুমিই তো কইলা সালিশে, আমি এমন না। গেদুর বাপ, বিশ্বাস করো আমি রিন্টুর লগে খারাপ কিছু করি নাই।
কাশেম বউয়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ করে না। সন্ধ্যাটা আরেকটু ঘনিয়ে আসার অপেক্ষা করে।
- তয় তুমি যে সালিশে কইলা, আমার বউ এমন করতেই পারে না?
এবার কাশেম সরব হয়। তার পুরুষরক্ত খইয়ের মতোন ফুটে।
- চুতমারানির ঝি, আমি আমার ইজ্জত বাঁচাতে এমন কইছি। তুই আমার বউ না? তরে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহর দিয়া আমার করে আনছিলাম, তর ইজ্জতের সাথে আমার ইজ্জত মিশে গেছে। অহনো বুজছ নাই? নিজের ইজ্জত বাঁচায়ে আইছি।
গেদুর মা সংসারে থাকা না থাকা নিয়ে আর কোনো কথা বলে না।
- ছেলেটার কাপড়গুলা আমার ব্যাগে দাও।
- না, ছেলে আমার। আমার সাথে থাকব। তর সাথে থাকলে সে নষ্ট হইব তর মতোই।
সাফিয়া আর কথা বাড়ায় না। কাশেম নামের নিরীহ ছেলেটির ঘরের রুপ সে ন বছরে বহুবার দেখেছে। ছেলে চেয়ে কোনো লাভ নেই। ঘুমন্ত ছেলের মুখটায় হাত বুলিয়ে সে ব্যাগ হাতে বেরোয়। এইবার তার চোখ ভেঙ্গে যেতে থাকে। বাপের বাড়ির উল্টো পথে হাঁটে সাফিয়া। সে এখন লাউ কাশেমের বউ না, অনিবার্যভাবে গেদুর মাও না, সে এখন সাফিয়া, শুধুই সাফিয়া।