আজ ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের ৪৮-তম মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সবাইকে প্রানঢালা শুভেচ্ছা। স্বাধীনতা দিবসে জনগন আনন্দ করবে, মুক্তির গান গাইবে, সত্যের জয়গান করবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও আজকের দিনটি স্বাধীনতার যথার্থ মূল্যায়নের দিন, ৪৭ বছর পরে কি পাওয়ার কথা ছিলো আর কি পেয়েছি তার হিসেব মেলাবার দিন এই স্বাধীনতা দিবস।
এই দিনটির পর্যালোচনা করতে কিছুটা পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির আন্দোলনে বাঙালিদের ভূমিকাই ছিলো প্রধান। “কান মে বিড়ি, মু মে পান, লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” আন্দোলন বাঙালি মুসলমানকে যতোটা নাড়া দিয়েছিলো, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশকে ততোটা নাড়া দেয় নি। এটা ইতিহাসের কথা। সেই বাঙালির মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে মোহভঙ্গের কাহিনী হলো শোষণ আর বিশ্বাসভঙ্গের কাহিনী। কারণ সেসময় ছিলো ২২ পরিবার যারা বাংলার শ্রমিকদেরকে শোষণ করেছে, তবে এখন হয়েছে ২২ হাজার।
এবার আরো কিছু ঘটনাপঞ্জী না উল্লেখ করলেই নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ অকল্পনীয় সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও আওয়ামী লীগকে আরো শক্তিশালী করেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল যেমন ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কারণ তারা সবাই লড়েছিলো মুসলিমলীগ এর বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ৩১৩ টি আসনের ১৬২ টি আসন পায় আওয়ামীলীগ, মুসলিম লীগকে পরাজিত করে, কিন্তু তবুও ক্ষমতায় যেতে পারে নি, ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে, তবে পাকিস্তানের এই খেলাটা বাঙালি বুঝতে পেরেছিলো একাত্তরের ৭ মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর ছাত্র যুব সমাজ সর্বত্র সংগ্রাম কমিটি তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
চূড়ান্ত বার্তা আসে ৭ ই মার্চ, বঙ্গবন্ধু দৃহকন্ঠে ঘোষণা দিলেন "তোমাদের যা কছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও, শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে", "আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না! আমি বাংলার জনগনের অধিকার চাই"
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সরকার গঠনে আহবান জানানোর পরিবর্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেন এবং এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন।
৭ ই মার্চের পর আরও অনেক আন্দোলনরত অগ্নিঝরা দিন পেরিয়ে যায়, অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিনে খবর আসে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের ও প্রথম অস্ত্র নির্মাণ কারখানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন নৌসেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তাঁরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান। সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, "আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, সময় এলে অবশ্যই আমি সব কিছু বলবো"। মুক্তিপাগল মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় সেদিন রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শপথ গ্রহণের শেষে একের পর এক শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে গিয়ে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দৃঢ়তার সাথে বলেন, মুক্তি পাগল সাড়ে সাতকোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনো শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আলোচনা চলে আরো তিন দিন। আর রাজপথে উত্তাল জনতা মিছিল আর শোভাজাত্রায় মত্ত, এরই মাঝে খবর হয় ২৫ মার্চ আলোচনা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে শুরু হয় 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু হয় পাকিস্তানি সৈনদের বর্বরোচিত গনহত্যা, আটক হয় বঙ্গবন্ধু।
এর পরের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই অংশটি আমার কাছে এক মূল্যবান অধ্যায়। আর মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই আজকের স্বাধীনতা দিবস, সেখানে নেতার অনুপস্থিতিতেই মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে গেলেন অন্য চার জাতিয়নেতা, তাদের নাম নতুন প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে। তাই আজকের স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায় তার পরবর্তী অধ্যায় উল্লেখ না করলে সম্পুর্ন অর্থহীন হয়ে যায়। তাজুদ্দিন আহম্মেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি ও কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজ ছিলো ভারতের সহায়তায় মুক্তাঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী তৈরি করা ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সেই লক্ষেই প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল ৩০ সে মার্চ দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মিটিং করেন ও ৩১ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাব তোলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করতে ও তা সংসদে গৃহীত হয়। এভাবেই শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধর প্রশিক্ষণ যার পর ৯ মাস পরে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন হয় ১৬ ই ডিসেম্বর। মুজিবনগর সরকার ফিরে এলো স্বাধীন বাংলাদেশে, সেই সাথে নেতা ফিরে এলেন পাকিস্তানের বন্দিঘর থেকে। রচনা হলো সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধর মূলনীতির ওপর, গনতন্ত্র - সমাজতন্ত্র - জাতীয়তাবাদ - ধর্মনিরপেক্ষতা।
সুচনা হয় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আর সেইসাথে রাজনৈতিক দলসমুহের কর্মপথ। আওয়ামীলীগ এর পাশাপাশি ন্যাপ, কমুউনিষ্ট পার্টি আর জাসদ এর। ১৯৭৩ সনে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে ভোট হয় সে সময়ও আওয়ামী লীগ আবার শতভাগ ভোট পায়, তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদ এর 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' বাঙালিদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে নি, ন্যাপ, কমুউনিষ্ট পার্টিও ভোটে সুবিধা করতে পারে নি, প্রশ্ন হলো তবুও কেনো বঙ্গবন্ধু সমস্ত দল বিলুপ্তি করার পরিকল্পনা করলেন ১৯৭৪ রে? তবে কি স্বাধীনতার পরে নতুন বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়েছিলো? এব্যাপারে দৈনিক বাংলায় লেখা সাখাওয়াত হোসেন এর এক নিবন্ধ থেকে কোড করছি
"বঙ্গবন্ধুর তেজোদীপ্ত নেতৃত্ব এবং পাহাড়সম দৃঢ়তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই নগন্য। বঙ্গবন্ধুর বিরামহীন ও নিবিষ্ট পরিশ্রমে গড়ে তোলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের অনেক সময় বলতে শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাসে কাঁটা ধরার কোনো সুযোগ নেই কেবলমাত্র ব্যতিক্রম বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা। বাকশাল প্রতিষ্ঠাকে তারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত করে থাকেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনার ক্রীড়নক হিসেবেও বাকশালকে দায়ী করা হয়। অথচ আমার মনে হয় তাঁরা বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের উদ্দশ্যে ও বাস্তবায়ন সাপেক্ষে ফলাফলের কথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা না করেই অবচেতন মনে বিবৃতি দিয়ে থাকেন। তৎসাপেক্ষে, গবেষকরা বঙ্গবন্ধুর ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনকে শত বছরের ফ্রেমের চেয়েও অধিক গুরুত্ব বিবেচনায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে থাকেন কেবল দূরর্দশিতা ক্ষেপন সাপেক্ষে। তাই বঙ্গবন্ধুর চিন্তনকে গভীর র্অন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করলে বাকশালের মর্মার্থ অনুধাবন সম্ভব হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসে র্ব্যথতার বা ভুল সিদ্ধান্তের আশংকা করাটাও বোকামি ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়।
পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই তিনি কাজ করতেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূলনীতিকে বিশ্বাস করে। সুতরাং, বাকশাল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরর্দশিতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফিরিস্তির কারণেই বিষয়টির বাস্তবায়ন জরুরি ছিলো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরিশীলিত রাজনীতিবিদ এবং আর্দশের জায়গায় অটুট। দলীয় সংর্কীণতা, ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো বাংলার মানুষের মুক্তি ও উন্নয়ন। বাকশাল গঠনও এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলো না। বাকশাল ব্যবস্থাকে তিনি পরীক্ষণীয় কর্মসূচি হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে যখন সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়েছিলো ঠিক তখনি বিকল্প ব্যবস্থাকল্পে বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষক ড. অজিত কুমার দাস বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের উদ্দশ্যে যুক্তিসহকারে তুলে ধরেন। সে সময়কার উগ্র দলগুলোর সশস্ত্র বিপ্লবের নামে ব্যাংক লুট, থানা লুট, ফাঁড়ি লুট, রাতের অন্ধকারে রাজনৈতিক ডাকাতি চরম আকার ধারণ করলে বঙ্গবন্ধু উপায়ন্তর না দেখে বাকশাল গঠন করেন সামগ্রিক পরিস্থিতির অবলোকনে। বঙ্গবন্ধু বাকশালকে সাময়িক সময়ের জন্য রাখতে চেয়েছিলেন, পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করেই আবার ১৯৮০ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও উদ্যমী ছিলেন। কিন্তু ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই সপরিবারে হত্যা করেন।"
দু’বছর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, "জাসদ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলো। ওই সময় বঙ্গবন্ধুকে না হারালে আজ অন্য বাংলাদেশ হতো।”
১৯৭৫ রে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন পথে মোড় নেয়। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল দেশকে স্বাধীনতার উল্টো পথে নিয়ে গেলো। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি দালাল শাহ আজিজ, খান এ সবুরকে রক্ষা ও আর তাদের পূনর্বাসন করেন জিয়া। এছাড়া ও জিয়া সেনাপ্রধানও করেছিলেন পাকিস্তানপন্থী এক বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা এইচ এম এরশাদকে। কিন্তু জিয়া শান্তিতে ছিলেন না। বলা হয়, তার ৫ বছরের শাসনামলে কমপক্ষে ১৯ থেকে ২১টি সেনা অভ্যূত্থানের চেষ্টা হয়েছিলো। এরই একটায় ১৯৮১ সালে ৩০ মে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন।
বর্তমান হাসিনা সরকার গত কয়েক বছর ধরেই বলছে যে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। এর মধ্যেই ২০ মার্চ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশের এই আলোচনায় অনেকেরই প্রশ্ন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলে দেশের জনগনের অবস্থার কী পরিবর্তন হবে?
একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি-ডিসি) পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। প্রথম শর্তে দেশে মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে বলছে সরকার। দ্বিতীয় শর্তে মানবসম্পদের উন্নয়ন, অর্থাৎ দেশের ৬৬ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ২৫ ভাগ। এসব কারণে সরকার গত ৬ দিন ধরেই আনন্দ শোভাযাত্রা করছে রাজধানীতে।
জাতিসঙ্ঘ’র কথা অনুসারে যখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, তা জেনেও আমরা ৬ বছর আগেই ‘দেশ উন্নয়নশীল হয়ে গেছে’ বলে মহা-আনন্দ সেলিব্রেশন করে দেখালাম, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে রাষ্ট্রের শত কোটি টাকার শোভাযাত্রা করলাম। ষ্টেডিয়ামে আনন্দ উৎসব ও আতশবাজি ফুটালাম। এসব আনন্দ মিছিল আর শোভাজাত্রায় তৃনমূল ৭০ শতাংশ জনগন কি পেয়েছে তার হিসেব করার দিন এই স্বাধীনতা দিবস। সরকারের বক্তব্য, দেশে উন্নতি হচ্ছে, অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, আমলাদের বেতন বেড়েছে তিনগুন, এমপি দের ভাতা বেড়েছে দ্বিগুণ। জনগন বলছে শ্রমিকের বেতন বাড়ে নি সেই হারে। তবুও আনন্দ সেলিব্রেশন কার জন্যে?
এর আগে ১৭ মার্চ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৯৮ বছর, সেই উপলক্ষে সর্বত্রই ৭ ই মার্চের ভাষণ বাজানো হচ্ছিলো বাংলাদেশে।
৭ই মার্চের ভাষণটা এখন সেলিব্রেশন এর জায়গা খুঁজে পেয়েছে, জাতিসংঘ হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমরা যে ভাষণটা শুনে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধর অনুপ্রেরণা খুঁজতাম।
ঘুনে ধরা সমাজকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের আগের অনেক সমাবেশে এমনই ঘোষণা দিতেন তিনি। বদলাতে চেয়েছিলেন মান্ধাতার আমলের আইনও। সমবায় আন্দোলন, বেকার সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু নেই সেটাও এখন ৪৩ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন বাহাত্তুরের মূলনীতি থেকে কত দূরে? গনতন্ত্র এখন দারুন সংকটে, বাংলাদেশ এখন 'স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র' বলছে গবেষণা ইন্সটিটিউশন 'ব্যার্টেলসয়ান ফাউন্ডেশন', সমাজতন্ত্র সেতো বহু আগেই পালিয়েছে, ২২ পরিবারের জায়গায় হয়েছে ২২ হাজার পরিবার, জাতীয়তাবাদ সেটাও কতটা মজবুদ তা অনুসন্ধানের বিষয় আর ধর্মনিরপেক্ষতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠী।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদ 'দাওরায়ে হাদিস'কে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান করে দিয়ে এপ্রিল ২০১৭ তে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ গণভবনে কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিস্টদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বৈঠকে এই স্বীকৃতির ঘোষণা দেওয়ার একদিন পরই এই প্রজ্ঞাপন জারি হয়৷ সম্প্রতি ১০১০ জন মাদ্রাসা পাস করা ছাত্রকে সরকারী চাকুরি ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
যদিওবা শফি সাহেবের ৯০ দশকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকার আছে, যেখানে তিনি কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির পক্ষের লোকদের কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন৷ কেননা, তাতে ধর্মীয় শিক্ষাকে আর্থিক সুবিধার জন্য জলাঞ্জলি দেয়া হবে৷
এছাড়াও বিচারবিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, আইন শৃংখলার অবনতি, ব্যাংক সমুহের ঋণ খেলাপি, সরকারী তহবিল লুটপাট ও হত্যা ধর্ষন এর সূচক এই স্বাধীনতা দিবস এর সাথে কোনভাবেই মিলছে না।
একটি রাষ্ট্র, তার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈধতা উৎস হলো জাতি। আর জনগণ হলো রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান, যার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাসস্থানের সুষম ব্যবস্থা করার দায়িত্বে রাষ্ট্রের সরকার নির্বাচিত হয় আর একটি রাষ্ট্রে একটিই সরকার থাকে, তার কেনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বা থাকে না। কাজেই রাষ্ট্রের উন্নতি ও জনগণের সেবা নিশ্চয়তা দেবার একমাত্র দায়িত্ব সরকারের। প্রাচীন যুগে যে সরকার পরিচালিত হতো সামন্তবাদী বা রাজতন্ত্র দিয়ে এখন সেটি জনগণের নির্বাচিত সরকার, এখন যদি কোনো গণতান্ত্রিক সরকার অভিযোগ করে বলে যে একটি বিশেষ দল, রাষ্ট্র ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক কাজে লিপ্ত তাহলে সে সরকার দুর্বল। সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ক্ষমতায় বসিয়েছে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউশনের (প্রশাসন, আইন, পুলিশ, প্রতিরক্ষা, কোষাগার ও রাজস্ব) দায়িত্ব দিয়েছে দেশ পরিচালনার জন্যে। তাই যদি না হবে তাহলে রোমান দার্শনিক মার্কুস সিসেরোর দু'হাজার বছরের রাষ্ট্র গঠনের সংজ্ঞায় কি কিছু গলদ আছে?