একজন মানুষ জঙ্গি হয় কেন- তার উপর বহু গবেষণা গ্রন্থ পাশ্চত্যের নোয়াম চামস্কি টাইপের পন্ডিতদের দ্বারা লেখা আছে। উপমহাদেশেও এডওয়ার্ড সাঈদ টাইপ লেখকদের এই জাতীয় লেখা ভালা বাজার পেয়েছে। সবার এক সুর- মুসলমান অভিমানে, ভালোবাসাহীনতায়, বৈষম্যের শিকার হয়ে জঙ্গি হয়ে উঠে। আর এর মূলে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত…।১৯৪৭ সালে এদেশের হিন্দুরা চরম মূল্য দিয়েছে। নিজের দেশ হারিয়ে শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঠাই নিয়েছে। নোয়াখালী দাঙ্গায় শত শত হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্মান্তরিত করা হয়েছিলো অগুণতি মানুষকে। বসতবাড়ি ফেলে চিরতরে দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে তারা। ১৯৬৫ সালে এদেশে হিন্দু সম্পত্তি ‘এনিমি প্রপার্টি’ করে দখলের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। ৬৫ সালের রায়টে অবশিষ্ট হিন্দুদের একটি বড় অংশ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়।… একজন হিন্দুও এই ভাগ্য বিড়ম্বনার কারণে জঙ্গি হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশী মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নিতে ‘হর হর মহাদেব’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। আশ্চর্য যে ৪৭ সালের পূর্ববঙ্গের মুসলমনাদের পাকিস্তান দাবীতে দেশহারা হিন্দুরাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আশ্রয় নেয়া পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য রাস্তাঘাটে বাক্স হাতে অর্থ তুলেছে। কোলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ ছিলো দেশভাগের কারণে মাতৃভূমি হারা। তারাই লঙ্গরখানা খুলে শরণার্থীদের খাইয়েছে। ৬৫ সালে যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের বাড়িঘর হারিয়েছে হিন্দু পরিচয়ের কারণে, তাদের স্বদেশ ফেরত যাবার কোন ন্যায্যতা পর্যন্ত বাঙালী মুসলমানের কাছে ছিলো না। কোলকাতার টাউন হলে ১৯৭১ সালের এক সভায় এম আর আখতার মুকুল ৬৫ সালে দেশ ত্যাগ করা হিন্দুদের বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেখানে ফেরত যাবার দিবাস্বপ্ন দেখতে বাড়ন করেছিলেন। যদিও তারাই বরাবই নির্বাসিত ফিলিস্তিনীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন!
যাই হোক, এদেশের মুক্তির সংগ্রামে চরম মূল্য দিয়েছে হিন্দুরা। পাকিস্তান আর্মির কাছে প্রথম পায়োরিটি ছিলো ‘কাফের কাঁহা?’… মুসলমান হলে যদি বা ছাড় পাওয়া যেত কিন্তু হিন্দু হলে আর রক্ষে ছিলো না। শাখারী বাজারসহ পুরান ঢাকায় চালানো তান্ডব দেখেই বুঝা যেত পাকিস্তানীদের কাছে হিন্দুদের প্রতি কি পরিমাণ ঘৃণা জমা ছিলো। হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা ছিলো যুদ্ধবন্দনী গণিমতের মালকে ভোগ করা। পাকিস্তান ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য ধরে রাখতে ভারতের মালাউনদের চড় আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদকে রুখতে জিহাদে শামিল হয়েছিলো, তাই কাফের নারীরা ছিলো মুসলিম সৈন্যদের কাছে হালাল গণিমত!
দেশ স্বাধীন হবার পর পূর্ব পাকিস্তান ঠিকই আরেকটা মুসলিম রাষ্ট্রে রূপ নিলো। বেকুব হিন্দুর দল যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তাদের একটা বড় অংশ আবার দেশে ফিরে এসেছিলো বিরাট স্বপ্ন নিয়ে। প্রথম ধাক্কা খেলো রমনা কালি মন্দির নিয়ে। পাকিদের পুড়িয়ে দেয়া মন্দির এবার উচ্ছেদ করলেন ৭২-এর সরকার বাহাদুর! এনিমি প্রপার্টি বহাল থাকল। ওআইসিতে যোগ দিল। ইজমেতার জন্য জমি দিলো। এত কিছু করার পরও তবু আওয়ামী লীগের কপালে জুটল ‘হিন্দু’ নামের অপবাদ! পাকিস্তান ভাঙ্গা ছাড়া ‘হিন্দু’ হবার মত কোন দল আওয়ামী লীগ কোনকালেই ছিলো না। হিন্দু তোষণের ভুয়া অভিযোগ বিএনপি-জামাত করেছে কারণ এদেশের মুসলমান প্রচন্ডভাবে হিন্দু বিরোধী। তারা একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিভক্তি বিরোধী এবং হিন্দু বিরোধী। ৯১ সালে নির্বাচনে হারার পর আওয়ামী লীগ তাদের নামে ‘হিন্দুত্বের’ অপপ্রচারের মুখে বেশি করে মুসলমানিত্ব প্রকাশিত করায় মনোনিবেশ করে। সেই ধারায় রেলের জমি দান করে, ৫৬০টি মসজিদ জেলায় জেলায় নির্মাণের প্রজেক্ট নিয়েও তাদের শুনতে হয় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম’!
মহান মহান সব গবেষক চিন্তকদের কেউ উত্তর দেয় না আফগানিস্থানে বুদ্ধ মূর্তি কামান দেগে ভেঙ্গে দেবার পর কতজন বৌদ্ধ জঙ্গি হয়ে মুসলমানদের উপর হামলা চলিয়ে ছিলো? অথচ বার্মা থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানরা গঠন করে জিহাদী সংগঠন ‘আরসা’। এদেশে কাবার উপর শিব বসলে কাবার অবমাননা হয়ে যায়। মিলাদুনব্বীকে কেউ জন্মাষ্টামীর সঙ্গে শ্লেষভরে তুলনা করলে মিলাদুনব্বীর অবমাননা হয়। রাসরাজ কিংবা শ্যামলকান্ত্রিরা যদি বা কোনদিন নিদেন পক্ষে ‘হিন্দুত্ববাদী’ হয়ে উঠে তখন তারা হবে ‘মুসলমান প্রগতিশীলদের’ চোখে সাম্প্রদায়িক হিন্দু! নোয়াম চামস্কি-এডওয়াড সাঈদ গ্রুপ কোনদিন গবেষণা করবে না – কেন হিন্দুরা হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুকে পড়ছে…।