"ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন- এটি তিনি সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে করেছিলেন কিনা সে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁজতে সাপ বেরিয়ে গেলো! এই অনুসন্ধানে দেখা গেলো হেফাজত ইসলামের জন্মের বহু বছর আগেই শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচী থেকে ‘হিন্দু লেখক’ খেদানোর আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। যারা এই আন্দোলন করেছিলেন তাদের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল হিসেবেই এদেশে ধরা হয়। বলতে গেলে হেফাজত ইসলাম বা চরমোনাই পীর হচ্ছে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম…।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে অধ্যক্ষ থাকাকালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যে পাঠ্যসূচী পাস করান তা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল লেখক গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য আবুল ফজল চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবুল ফজলের বহু কথাকে এখন ‘বাণী চিরন্তন’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তিনি মৌলবাদ বিরোধী লেখালেখি করেছেন। তার ‘সমকালীন চিন্তা’ পাঠ করলে তার মুক্তচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এদেশের মুক্তচিন্তা আর প্রগতিশীলতা কেবল মুসলমানকে কেন্দ্র করে। আবুল ফজলরা চেয়েছেন মুসলমানরা প্রগতিশীল হোক। সে অর্থে তারা সবাই প্রগতিশীল। কিন্তু তাদের রাষ্ট্র চিন্তা হেফাজত ইসলাম কিংবা চরমোনাই পীরের অনেক কাছাকাছি। আবুল ফজল ১৯৫২ সালে শহীদুল্লাহকে চিঠি লিখে বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাসের প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘মুসলমানের আবেগ অনুভূতি, ধ্যানধারণা আর রুচিতে যে সব রচনা আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে তা এখন পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়াই উচিত। আর উচিত এখন থেকে মুসলমান লেখকদের কিছু কিছু বই পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা। তা হলেই পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে রক্ষিত হবে সংগতি আর মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাও পাবে কিছুটা তৃপ্তি’ (আবুল ফজল, স্মৃতিকথা রেখাচিত্র, ১৯৬৫)।
এই চিঠি লেখার পরও যখন কাজ হলো না তখন আবুল ফজল বেনামে তখনকার ‘জিন্দেগী’ পত্রিকায় (বাঙালি মুসলমান বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করে আবার তাদের পত্রিকার নাম হয় জিন্দেগী!) পত্রিকায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান-বিরোধী মনোভাব’ শিরোনামে লিখেন, ‘আমাদের এই রচনার শিরোনাম পড়িয়া অনেকেই যে তাজ্জব হইবেন তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ এবং ষোলআনাই সত্য। অখন্ড ভারত বা অখন্ড বাংলায় মুসলমানদের একটি বড় অভিযোগ ছিলো – ‘হিন্দু সংস্কৃতি, ইসলামবিরোধী পৌত্তলিক মনোভাবপূর্ণ সাহিত্য মুসলমানদের উপর জোর করিয়া চাপানো হইয়াছে। এই অভিযোগ লইয়া মুসলমান সমাজ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও কম আন্দোলন করে নাই।’ মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির মূলেও সক্রিয় প্রেরণা জোগাইয়াছিলো এই অভিযোগ। এই বিষয়ে বোধ করি কাহারো মনে কোনো সন্দেহ নাই। আজ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের আয়ু দ্বিতীয় বৎসরে পদার্পণ করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের তমদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক জীবন ও আদর্শ গঠনের একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দায়িত্ব সম্বন্ধে কোনোদিন সচেতন ছিলেন না এবং কোনোদিন পালন করেন নাই। আজও সেই দায়িত্বকে (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও) কিভাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি প্রদর্শন করিতেছে তাহার একটি মাত্র দৃষ্টান্ত আপনাদের সামনে পেশ করিতেছি’।
কি পাঠক, মনে হচ্ছে যেন ফরহাদ মজহার কিংবা ডানপন্থী কোনো বুদ্ধিজীবীর কথা পড়ছেন যেন- তাই না? কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে আরো নগ্ন কদর্য। এবার বেনামে আবুল ফজলের লেখার এই অংশটুকুর পুরোটুকু পড়ে নিন- ‘সিলেবাসের আগাগোড়া মুসলমান সাহিত্যিকদের নামগন্ধ কোথাও নেই, শুধু কায়কোবাদের অশ্রুমালা ও ড. শহীদুল্লার একটি স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের নাম ছাড়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গোটা মুসলমান সমাজকে কীভাবে লাঞ্ছিত করিয়াছে তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। বি. এ. পরীক্ষার জন্যে কামিনী রায়ের ‘আলো ও ছায়া’ এবং সত্যেন দত্তের কুহু ও কেকা পাঠ্য হইয়াছে! অথচ নজরুল ইসলাম বা জসীমউদ্দীন, শাহাদাৎ হোসেন বা গোলাম মোস্তফা কারো কোনো বই পাঠ্য করে নাই। বাংলাদেশে এমন আহম্মক কী কেউ আছে যে নজরুল ও জসীমউদ্দীন হইতে কামিনী রায় ও সত্যেন দত্তকে বড় কবি বলিয়া স্বীকার করিবেন? ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রাম-রাবণের লড়াই আমাদের পড়িতে হইবে অথচ মহাশ্মশানের দুই সর্গ পড়া হইবে না! মোহিতলাল মজুমদার-সম্পাদিত ‘কাব্যমঞ্জুষা’ পাঠ্য হইয়াছে অথচ ড. এনামুল হক-সম্পাদিত ‘কাব্যকুঞ্জ’ বা রেজাউল করীম ও আবদুল কাদির-সম্পাদিত ‘কাব্যমালঞ্চ’ পাঠ্য করা হয় নাই! ইহা কী মুসলেম বিদ্বেষ নহে? আর ‘কাব্যমঞ্জুষা’ হইতে বাছিয়া বাছিয়া হিন্দু লেখকদের হিন্দু ভাবাপন্ন কবিতাগুলিই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হইয়াছে। সেই গ্রন্থ হইতেও মুসলমান কবিদের রচনা (একটি কি দুটি ছাড়া) পাঠ্য করা হয় নাই! সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম ও ড. এনামুল হক-সম্পাদিত আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য এত মূল্যবান গ্রন্থ যে তাহা প্রকাশিত হওয়ার পর ডা. সুনীতিকুমার তাঁহার ‘ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ বইতে সংশোধনী পরিচ্ছেদ যোগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বাংলা সাহিত্যের একাধিক বিশেষজ্ঞ এই বইটির মূল্যবান অবদান সম্বন্ধে মন্তব্য করিয়াছেন, নিজেদের মতামত পর্যন্ত সংশোধন করিয়াছেন! অথচ সেই বইটিও পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয় নাই। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, গীতগোবিন্দ, চন্ডীমঙ্গল, ধর্ম্মমঙ্গল, সারদামঙ্গল সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দয়া করিয়া পাঠ্য করিয়াছেন অথচ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামনি’ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই গ্রন্থের প্রকাশক) পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা হয় নাই! ইহাকেও মুসলেম বিদ্বেষ বলিব না ত কী বলিব? জনা, কৃষ্ণকুমারী, পুরুবিক্রম ইত্যাদি সম্পূর্ণ হিন্দু ভাবাপন্ন নাটক পাঠ্য করা হইয়াছে অথচ… ও পাকিস্তানের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী নাটক পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয় নাই’!
এবার নিশ্চয় আপনাদের কাছে মনে হচ্ছে বাবুনাগরি কিংবা আহমদ শফীর পাঠ্যক্রম নিয়ে চরম সাম্প্রদায়িক কথা শুনছেন- তাই না? আবুল ফজল কোনো রাখঢাক না রেখে বাংলা সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িক বিভেদ করে বলেছেন ‘‘হিন্দু সংস্কৃতি, ইসলামবিরোধী পৌত্তলিক মনোভাবপূর্ণ’। তার বদলে তিনি বারবার ‘মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার’ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। আজকে পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানী বলা, ইসলামী সংস্কৃতি জাগরণের যে মৌলবাদী চেতনা দেখি, দেখা যাচ্ছে একই কথা বলে গেছেন এদেশের প্রগতিশীল বলে পরিচিতজনরা। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে হিন্দু ও ভারত প্রেমী বলে কটুক্তি করা হয়েছিলো। আজো যেমন অনলাইনে আমাদের মত ব্লগারদের হিন্দু আর ভারতপ্রেমি বলে কটাক্ষ করা হয়।
আবুল ফজল তার সমকালীন চিন্তা (১৯৭০) বইতে পাকিস্তানের ইসলামী দলগুলোর ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ বাস্তবায়নের বিরোধীতা করে লিখেছিলেন, মুসলমান রাষ্ট্র বা ইসলামী রাষ্ট্র যদি গঠন করা সম্ভব হতো তাহলে আরব দেশ এতগুলো ছোট ছোট জাতি রাষ্ট্রে ভাগ হতো না…। এরকম উক্তি করা একজন লেখককে প্রগতিশীল মুক্তমনা বলা ছাড়া উপায় কি? তার মানে কি তিনি মত বদলে ছিলেন পরবর্তীকালে? তা যে করেন নি তা জীবনের শেষ সময় এসেও বাংলার হাজার বছরের ঐক্যকে তিনি দেশী ও বিদেশী এই দুইভাবে বিভক্ত করেছিলেন। তিনি লিখেন, ‘জাতীয় মানস গঠনের যুগে বিদেশী ভাবধারার চেয়ে স্বদেশী ভাবধারায় পুষ্ট মাঝারি রচনাও অনেক মূল্যবান। এ বিশ্বাস আমার মনে আজো অটুট’। পাকিস্তানের মুসলমান তারা। বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে তাদের এরকমই বিভেদ যা তিনি শেষদিন পর্যন্ত অটুট রাখতে পেরেছিলেন।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আবুল ফজল ও গোলাম মুস্তফার লেখার প্রতিবাদ করে একটি লেখা লিখেন যা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদে। শহীদুল্লাহ অভিযোগ স্বীকার করে নেন যে হিন্দুদের লেখা বেশি এবং তার সংস্কার করা প্রয়োজন। মুসলমানদের মধ্যে ভালো লেখক কম সেকারণেই আবুল ফজল লিখেছিলেন ‘স্বদেশী ভাবধারায় পুষ্ট মাঝারি রচনাও অনেক মূল্যবান’। শহীদুল্লাহ সিলেবাস পরবর্তীকালে সংস্কার করে হিন্দুদের লেখা কমিয়ে ফেলেছিলেন যেমনটা এখন হেফাজতের হুমকিতে বর্তমান সরকার করেছে। কিন্তু শহীদুল্লাহ প্রতিবাদ করে কি লিখেছিলেন তা জানাও আবশ্যক। তাকে ‘হিন্দু’ বলায় তিনি লিখেছিলেন, ‘সমালোচকের জানা উচিত কাহারও ওপর কুফরী ফতোয়া দিলে সে যদি প্রকৃত কাফির না হয়, তবে ফতোয়াদাতাই কাফির হইবেন, ইহাই ওলামা সমাজের অভিমত। আমি পাকিস্তানের মতবাদকে ইসলামী মতবাদেরই আদত বলিয়া মনে করি। কাজেই কোনও মুসলমান পাকিস্তানের মতবাদের বিরোধী হইবে ইহা ধারণাই করিতে পারি না’ (একটি পুরনো বিতর্ক সংগ্রহ, সংকলন ও পূর্বলেখ, ভূঁইয়া ইকবাল, কালি ও কলম, সেপ্টম্বর, ২০১৩)।
হায়াৎ মাহমুদ ডক্টর শহীদুল্লাহকে গোড়া মুসলমান বলেছিলেন। তিনি নাকি পানিপড়াও দিতেন লোকজনকে! ডক্টর শহীদুল্লাহ সংস্কৃতি ভাষা অধ্যায়ন করেছিলেন। তিনি মৌলবাদী ছিলেন না। তার সন্তান মুর্তজা বশির একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। শহীদুল্লাহ রবীন্দ্র সান্নিধ্যে এসেছিলেন। আবুল ফজলও মৌলবাদী ছিলেন না। পরবর্তীকালের ‘শিখা গোষ্ঠীর’ লেখক শিল্পীও ছিলেন প্রগতিশীল। তাদের এই প্রগতিশীলতা আর মৌলবাদ বিরোধীতা ছিলো স্বধর্মীদের প্রশ্নে। হিন্দু বা অমুসলমান প্রশ্নে তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা প্যান ইসলামিস্ট প্রগতিশীল ছিলেন। ড. আহমদ শরীফ তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, তারা কেউ মুক্তচিন্তক বা সেক্যুলার ছিলেন না। সে অর্থে এখানে তেমন কেউ কোনোকালেই ছিলো না। তারা ছিলেন মুসলমানদের মঙ্গলকামী। তাই বলে অমুসলমানদের ক্ষতিসাধন চাইতেন তা নয়, অমুসলমানদের জন্য অমুসলমানরাই ভাবুক- এমনটাই ছিলো তাদের পজিশন।
কেনো আজো বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে তার নিজস্ব সংস্কৃতির বারবার সংঘর্ষ লাগে তা বিদ্যান পন্ডিত শহীদুল্লাহর লেখা থেকে বুঝে নিতে পারেন। তিনি একই লেখায় কবি গোলাম মুস্তফার অভিযোগের জবাবে লিখেছিলেন, ‘আমি নাকি আগে বাঙালী পরে মুসলমান, এইরূপ মত প্রচার করিয়াছি। তিনি কি আমার অসংখ্য লেখা হইতে এইরূপ কোনও উক্তি উদ্ধৃত করিতে পারেন? আসল কথা আমি আমার অভিভাষণে বলিয়াছিলাম যে আমরা বঙ্গদেশবাসী হিন্দু ও মুসলমানগণ ধর্ম্মে ও আচারে পৃথক হইয়াও আমরা ভাষাভাষী হিসাবে বাঙালী। সমালোচক ইহারই কদর্থ করিয়াছেন। কিন্তু আল্লাহ পাক এবং যাঁহারা আমাকে ঘরে বাহিরে জানেন তাঁহারাই ভালভাবে জানেন যে আমি কিরূপ মুসলমান, আমার আকীদা এবং আমার আমল কিরূপ। আমি শুধু এইটুকু বলিয়া ক্ষান্ত হইব যে আলহামদুলিল্লাহ। আমি সমালোচক হইতে কোন অংশে কম মুসলমান বা পাকিস্তানী নই (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, দৈনিক আজাদ)।
গোলাম মুস্তফা শহীদুল্লাহ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি তো বাঙালী বলেন নিজেকে, তারপর তিনি মুসলমান। এর জবাবে শহীদুল্লাহ কি জবাব দিলেন পড়েছেন। আজকের বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের ছয়লাব তার জনক কারা তাহলে? মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক হলেও তার পেছন পেছন যে ফান্ডামেন্টালিজম এসে হাজির হয় তা বারবার বলেছি। আজকের হেফাজত, আলেম ওলামাদের যে আস্ফালন তার জন্য সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে, এককভাবে জিয়াউর রহমানের ইসলামী রাজনীতিকে সুযোগ দেয়াকে দায়ী করে সত্যকে ঢেকে রাখলে মুক্তি পথ কোনদিনই বের হবে না।
লেখাটা শেষ করি। যে বাংলা পঞ্জিকা সংস্করণকে কেন্দ্র করে এই লেখাটার সূচনা হয়ছিলো তার একটা সমাধানে পৌঁছানো যাক। ইতিহাসে দেখতে পাই, জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ত্রুটি থাকায় এর সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকনাথ পঞ্জিকা সমগ্র ভারতবর্ষে যে পরিমাণ বিক্রি তাতে ধস নেমে যাবে বলে ধর্মবেত্তারা তাতে বাধা দেয়। তাই এটা সত্য সনাতন বাংলা পঞ্জিকায় সমস্যা রয়ে গেছে যা সংস্করণ কাম্য ছিলো। কিন্তু ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালী হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান বাঙালিরা যাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সঙ্গে একইদিনে পালাপার্বন পালন করে কোনোভাবেই জাতিগত ঐক্য অনুভব না করতে পারে তার জন্যই সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই সংস্কার কার্যক্রম সাধন করেন। এতক্ষণ যে আলোচনা আমরা পড়লাম, লেখক পন্ডিতদের নিজেদের লেখার যে রেফারেন্স পেলাম, তাতে কি মনে হতে পারে না, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহরা নিজেদের বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে বিভেদ বিচ্ছেদে কোনো অঙ্গছেদ বলে মনে করতেন না। তারা ‘মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিতে’ বিশ্বাস করতেন। এমনটা তো বিশ্বাস করা যায় না যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য শহীদুল্লারা জানতেন না। তাহলে যা দাঁড়ায় তাতে আশাহত হওয়া ছাড়া আপাতত কোনো পথ নেই। আজকের মৌলবাদের উত্থান হঠাৎ ঘটনা বা কোন আকস্মিকতা নয়। বলা চলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মাত্র…।"