মনে করে নেই পুরুষ মানেই হিংস্র জানোয়ার, আর এটা প্রকৃতি পুরুষকে সেই কোডে তৈরি করে থাকলে নারীবাদে তার সমাধান কি? সমস্ত পুরুষকে হত্যা করে কিংবা এই গ্রহ ছেড়ে পুরুষহীন কোন নতুন গ্রহে গিয়ে তো আর বাস করা যাবে না। নিশ্চয় এর সমাধান নারীবাদে আছে। যদি না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে- নারীবাদ প্রকৃতি বিরুদ্ধ অবৈজ্ঞানিক এক থিউরি। আসলে আমরা যারা পুরুষ হয়েও নারীবাদী, অর্থাৎ নারীর সমমর্যাদা স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য সোচ্চার তারা তো বটেই খোদ বহু নারীবাদী নারীই নারীবাদ সম্পর্কে কোন খোলসা ধারণা, নারীবাদ আসলে কি দাবী করে- সে সম্পর্কে কোন কথা বলেন না- অন্তত সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমি যদি নারীবাদ সম্পর্কে ভুল না বুঝে থাকি তাহলে আমার বক্তব্য হলো-
পুরুষ সত্যি সত্যি নারীর জন্য হিংস্র জানোয়ার হয়ে থাকলেও সেটা নারীবাদের কোন সাবজেক্ট নয়। একইভাবে কোন নারীর সঙ্গে দু’দণ্ড বসবাস করাও যে পুরুষের কাছে অসহ্য, যে নারী মনে করে পুরুষকে সঙ্গমের জন্যই কেবল তার প্রয়োজন- তারও একজন নারীবাদী হতে বাধা নেই। নারী পুরুষ আগামী পৃথিবীতে একত্রে থাকবে কিনা সেটা নারীবাদ ঠিক করে দিবে না। পুরুষতন্ত্রের অলটারনেটিভ নারীবাদ নয়। সেটা হলে নারীবাদও হতো একটা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান। হ্যাঁ, এখন অনলাইনে কিছু কিছু মানুষের অবস্থান পুরুষতন্ত্রের মতই আরেকটা জিনিসে এসে দাঁড়িয়েছে যার নাম হতে পারে ‘মহিলাতন্ত্র’। এই মহিলাতন্ত্র পুরুষতন্ত্রের মত একত্রে চারজন স্বামী রাখার দাবী করতে পারে। ঘরে বউ রেখে পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের মতো স্বামীকে ঠকিয়ে গোপন প্রেমিক রাখাকেই পুরুষতন্ত্রের প্রতি প্রতিশোধ ধার্য করতে পারে। নারীবাদ নারীর সাইকেল চালানোর মতো মামুলি অধিকার থেকে একা নিজের জীবন কাটানোর স্বাধীনতার মতো পূর্ণাঙ্গ মানুষের অধিকারের কথা বলে। পুরুষতন্ত্রের বদমাইশির পাল্টা প্রতিশোধ তার লক্ষ্য নয়।
পুরুষ মাত্রই ধর্ষক হলেও নারীবাদের মাথা ঘামানোর কিছু নেই এখানে। কোন পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে না চাইলে নারীর একা থাকার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়াই নারীবাদ। অপরাধ, বদনাম, দোষী সাবস্ত হওয়ার যে লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনা- নারীবাদ সেই সমতার আন্দোলন। মানুষের সুনাম, দুর্নাম, ভাল, মন্দের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিলোপ চায় নারীবাদ। তাই লাম্পট্য কেবল পুরুষবাচক শব্দ না হয়ে এটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিবেচিত হবার কথা বলে নারীবাদ। ‘পতিতা’ যেমন কেবল স্ত্রীবাচক শব্দ তৈরি করে পুরুষতন্ত্র বৈষম্য করেছে নারীর প্রতি, নারীবাদ এইখানে বলে সত্যিই যদি মানুষের পতিত হবার কোনো সামাজিক সংজ্ঞা থেকে থাকে কেবলমাত্র নারীর বেলায় তা প্রযোজ্য হবে না। কাজেই নারীবাদ পুরুষের লাম্পট্যকে নিয়ে সোচ্চার হয়ে নিজে লাম্পট্যের প্রচার করে না। নারীবাদ হচ্ছে মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। যে মুক্তি প্রতিটি পুরুষেরও কাম্য। পুরুষতন্ত্রের যাতাকলে পড়ে পুরুষও সমাজে শৃঙ্খলিত। নারীর মালিকানার অধিকারে সে জীবনজীবিকায় পিষ্ট নিঃশেষিত। নারীবাদ আসলে এইসব শৃঙ্খল হতে নারী পুরুষ সবাইকে মুক্তি দিতে চায়…।
তার মানে কি নারীবাদে প্রেম-ভালোবাসা নেই? পরস্পর দায়-দায়িত্ব নেই? দুজন স্বাধীন মানুষ একত্রে পরিবার সৃষ্টির প্রচেষ্টা মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ একা বাস করতে পারে না। প্রকৃতি তার সৃষ্টিকে সচল রাখতে তার বশংধারা প্রয়োজন। প্রকৃতির সেই প্রজনন ক্ষমতার উপরই মানুষ নিজে ‘ভালোবাসা’ নামের আশ্চর্য সুন্দর রামধনু রঙের সৃষ্টি করেছে। মানুষের এই সর্বচ্চ সৃজনশীল প্রয়াসকে পৃথিবীর কোনো মানবিক আন্দোলনই অস্বীকার করতে পারে না। নারীবাদও যেহেতু মানুষের মুক্তির সবচেয়ে বড় মানবিক আন্দোলন তাই প্রেম-ভালোবাসাকে সে অস্বীকার করতে পারে না। পুরুষতন্ত্র নারীকে সেক্স আর বাচ্চা পয়দা করার মেশিন মনে করলেই তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুরুষকে সেক্স অর্গাজম মেশিন মনে করার নাম হতে পারে ‘মহিলাতন্ত্র’ বা অন্যকিছু যা পুরুষতন্ত্রে অলটারনেটিভ। নারীবাদ নয়।
কোনো নারী সন্তান ধারণ করতে না চাইলে সেটাও তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু এটা নারীবাদ নয় যে সন্তান ধারণ করার দায়িত্ব দিয়ে নারীকে পুরুষতন্ত্র শোষণ করছে। এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। সন্তানের মা হতে চাওয়া এবং না চাওয়া দুটোই একজন নারীর স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার স্বীকৃতির নামই নারীবাদ। আপনি এর কোনটির পক্ষে অন্ধ অনুসারী হয়ে নারীবাদকে তার সংজ্ঞায় ফেলে বিকৃত করার নামই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল আরেক রূপ।
পাগলা কুকুর আপনাকে কামড়াতে আসলে আপনি কি করবেন? নিজেকে রক্ষা করতে হাতের কাছে লাঠি পেলে সেটা দিয়েই তাকে আঘাত করবেন। যদি আপনি জানেন কুকুরের ঠিক কোথায় দুর্বলতা আপনি স্বভাবতই সেই স্থানেই আঘাত করতে চাইবেন নিজেকে রক্ষা করতে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য ঘাতককে হত্যা করারও রাইট আছে। ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া একজন নারী যখন ধর্ষকের লিঙ্গে আঘাত করে- আর তাতে আমাদের সমাজের নারী-পুরুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে পক্ষে-বিপক্ষে তখন মনে হয় আমাদের নারীবাদে কারোই স্পষ্ট ধারণা নেই। যে ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয় মাদ্রাসায়, চার্চে, স্কুলে বা অন্য কোথাও- তারও নিজেকে রক্ষা করতে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তনের অধিকার আছে। আমার দিকে যে বন্দুক তাক করে আছে আমার প্রথম চেষ্টাই হবে সেই অস্ত্রটিকে যেভাবেই হোক নিষ্ক্রয় করে ফেলা। এটি আমার বাঁচামরার প্রশ্ন। আমার ঘাতকের প্রতি আমার সর্বোচ্চ মানবতা প্রদর্শনের আহ্বান বাস্তবতাবর্জিত। এর মধ্যে শরীয়া আইনের হাতের বদলে হাত, চোখের বদলে চোখ- এসবকে টেনে আনার যৌক্তিকতা নেই। কেউ বলছে না ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি লিঙ্গ কর্তন করা হোক। ধর্ষকের শাস্তি আমাদের আইনে আছে। আত্মরক্ষাকারী কি করে তার ঘাতকের হাত থেকে বাঁচবে, কতটা মানবাধিকার রক্ষা করে সেই আত্মরক্ষা করবে এরকম আইনই যারা বাতলে দিতে চাইছেন তারাই বরং শরীয়ার কন্ঠস্বরে কথা বলছেন। এটা অনেকটা ধর্ষণের ভিকটিমকেই সাক্ষী খুঁজে আনার মতোই রূঢ শোনায়।
যৌন স্বাধীনতা মানে হচ্ছে নিজের পার্টনারকে নিজে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। নিজের পার্টনারকে ঠকানো কিংবা প্রতারণা নয়। নারীবাদ নিজের জন্য হেরেম চায় না। নারীবাদ পুরুষতন্ত্র নয়। মানুষের মুক্তি আর স্বাধীনতার নাম। নারীবাদের উগ্র ভদ্র বলে কিছু নেই। আমি স্বাধীনতা চাই- এই চাওয়াটায় নম্র উগ্র হয় না। আপনার স্বাধীনতা যে কেড়ে রেখেছে তার কাছে স্বাধীনতা চাওয়াটাই আস্পর্ধা। নম্র ভাবেই চান আর জোরালো গলায়…।