সম্প্রতি দেশের আলেমদের একাংশ দাবী করেছেন টার্গেট কিলিং ও আত্মঘাতি হামলা ইসলামে হারাম। যদিও উনারাই ক’দিন আগেও নাস্তিক হত্যাকে ওয়াজিব বলে প্রকাশ্যে নাস্তিকদের হত্যার ফতোয়া দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে এই স্ববিরোধীতার অন্তরালে আসল সত্যটা কি? ইসলাম আসলে কি বলে? এই লেখাটি মোটেই আলেমদের ‘পজেটিভ উদ্যোগকে’ নেগিটিভ দেখানোর কোন ইচ্ছা নেই। এদেশের আলেমদের রঙ বদলের যে চরিত্র, নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে তারা কিভাবে ব্যবহার করে সেটাই দেখানো হবে।প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক যে কোন সাধারণ মুসলমানের মনে কারণ ইসলাম ‘আত্মহত্যাকে’ জঘন্ন পাপ বলে অভিহত করেছে। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বা কাফেরদের উপর প্রতিশোধ নিতে বুকে বোমা বেঁধে বা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কেন মুজাহিদরা আক্রমন করতে যায়? আত্মহত্যাকারীকে অনন্তকাল দোজগে জ্বলতে হবে- এটা সব মুজাহিদই জানেন, তাহলে আত্মঘাতি হামলায় কেন তারা অংশগ্রহণ করে? প্রায় বাইশ বছর আগে (১৯৯৪ সালে) এক শিবির কর্মীর সঙ্গে তর্ক করেছিলাম ইসলামে আত্মঘাতি হামলার কোন বিধান নেই কারণ ইসলাম আত্মহত্যাকে অনুমোদন দেয় না…। শিবিরের সেই ছেলেটি আমার কথা শুনে মুচকি হেসেছিল। কেন হেসেছিল সেটা জানতেই আসুন মূল আলোচনায় যাই।
যে মুজাহিদ নিজের শরীরে বোমা বেঁধে বিমান উড়িয়ে দিতে যায় বা কোন নাইটক্লাবকে ধ্বংস করতে যায় তার মৃত্যুর সম্ভাবনা একশত ভাগ নিশ্চিত থাকে বলেই একে আত্মঘাতি বোমা হামলা বলা হয়ে থাকে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যারা এইসব অপারেশনে যান তাদেরকে মুজাহিদ ভাইরা ‘শহীদ’ বলেন। এইসব শহীদের মর্যাদা বেহেস্তে সর্বচ্চ স্তরে থাকবে। এবং হাদিস অনুসারে এইসব বোমাবাজদের অভ্যর্থনা জানাতে তাৎক্ষণিক ৭২টি হূর নেমে আসে সাত আসমান থেকে…। অথচ কুরআন আত্মহত্যাকারীদের সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন কঠিনতম শাস্তির কথা বলে-
“… আর নিজেদেরকে হত্যা করো না (বা একে অন্যকেও নয়), নিশ্চয়ই, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান। আর যে কেউই বাড়াবাড়ি বা জুলুম করতে গিয়ে এতে লিপ্ত হবে, আমরা তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করব, আর সেটা আল্লাহর জন্য সহজ” (৪:২৯-৩০)।
কুরআনের এই আয়াতটি দেখিয়ে আইএস, আল কায়দা, তালেবান ও ওমর মতিনদের আত্মঘাতি হামলাগুলোকে ইসলাম সম্মত নয় বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু একজন ইসলামের সৈনিক ইসলামকে জেনেই তার জন্য মরতে এসেছে। আপনি-আমি ‘ইসলামে এসব নেই’ বলে নিজেদের ধর্মের মুখ বাঁচাতে পারবো সাময়িক সময়ের জন্য, কিন্তু একজনও সুইসাইড বোমারুকে থামাতে পারবো না। কারণ সে জানে- আত্মঘাতি বোমা হামলা ইসলামে ‘আত্মহত্যা’ নয়, বরং এই শহীদী মৃত্যুকে ইসলাম প্রশংসা করেছে! আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আইএস, জেএমবি ইত্যাদি জিহাদী দলগুলো সুইসাইড বোম্বিং করতে কুরআনের এই আয়াতটি ব্যবহার করে বলে জানতে পেরেছি তাদের বইপুস্তক পড়ে। কুরআন বলছে-
“আর মানুষের মধ্যে এমন আছে যে নিজেকে বিক্রয় করে দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির খোঁজে, আর আল্লাহ নিশ্চয়ই নিজের বান্দাদের ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অনুগ্রহশীল”(২:২০৭)।
ইবনে কাথির তার তাফসিরে এই্ আয়াত সম্পর্কে বলেন,
“সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মত যে এই আয়াতটি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী প্রতিটি মুজাহিদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে … ‘আর যখন হিশাম ইবনু আমির শত্রুদলের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়লেন, কিছু লোক এ ব্যাপারে আপত্তি করল। তখন উমার বিন খাত্তাব এবং আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।”(তাফসীর ইবনে কাথির, খন্ড ১ম, ২য়, ৩য়, সুরা বাকারা, পৃষ্ঠা-৫৮০)।
হিশাম ইবনু আমির নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শুধুমাত্র দ্রুত বেহস্ত লাভের জন্য নিজের জীবন দান করেন। আত্মহত্যা ইসলামে নিষেধ জেনে অন্যান্য সাহাবী এটাকে আত্মহত্যা বলে মনে করলে উমর ও আবু হুরায়রাহ’র মত ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলেন এই সুইসাইড আক্রমন দ্বিনের জন্য অবশ্যই হালাল। মুসলিম শরীফে এইরকম আত্মঘাতি হামলার দলিল আছে যা জিহাদীরা ব্যবহার করেন-
সহীহ সনদে আবূ বাকর বিন মূসা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ “আমি আবূ হুরায়রাহ্কে শত্রুর উপস্থিতিতে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেন, “জান্নাতের দরজা তরবারির ছায়াতলে !’ তখন একজন শক্ত সমর্থ লোক উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘হে আবূ মূসা ! আপনি আল্লাহর রসূল (সঃ)- কে এই কথা বলতে শুনেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ !’ তখন লোকটি নিজের সাথীদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, ‘তোমাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে সালাম’ তারপর নিজের তরবারির খাপটি ভেঙ্গে ফেলল এবং শত্রুর দিকে খোলা তরবারি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকল”।
এছাড়া স্বয়ং নবীজি জান্নাতের লোভ দেখিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে অনুসারীদের ঝাপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করতেন। মুসলিম শরীফে আছে-
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ “মুশরিকরা (এখন আমাদের দিকে) এগিয়ে আসল, আর রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “উঠ এবং জান্নাতে প্রবেশ কর, যার প্রস্থ আসমান ও জমিনের সমান ।” উমাইর বিন আল-হুমাম আল- আনসারী (রাঃ) বললেনঃ হে রসূলুল্লাহ (সঃ) ! জান্নাত কি আসমান ও জমিনের সমান?” তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ” । উমাইর বললেনঃ “ভাল, ভাল!” রসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ কিসে তোমাকে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করতে উদ্বুদ্ধ করল? (অর্থাৎ “ভাল, ভাল !”)” তিনি (উমাইর) বললেন, “হে রসূলুল্লাহ (সঃ)! অন্য কিছু নয় বরং এই ইচ্ছা যে, আমি যেন তার (জান্নাতের) অধিবাসীদের একজন হতে পারি ।” তিনি (রসূলুল্লাহ (সঃ)) বললেনঃ “তুমি (নিশ্চয়ই) তাদের একজন ।” এরপর উমাইর (রাঃ) নিজের থলি হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন । এরপর বললেন, “যদি এই সবগুলি খেজুর খাওয়া পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি তবে তা হবে একটি দীর্ঘ জীবন ।” (বর্ণনাকারী বলেন): “সে তার সাথে যত খেজুর ছিল সব ফেলে দিল এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়ে গেল” (বুখারীঃ ৪০৪৬, মুসলিমঃ ১৮৯৯)।
আরো একটি হাদিসে পাওয়া যায় যেটি জিহাদী দলিল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে-
মুয়া’জ ইবন ‘আফরা (রাঃ) আল্লাহর রাসূলকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “কি করলে আল্লাহ তার বান্দাদের ব্যাপারে হাসেন ?” তিনি বললেন, “বান্দার নিজেকে বর্ম ব্যতিতই শত্রুদলের মধ্যে নিমগ্ন করা ।” মুয়া’জ তখন নিজের বর্ম খুলে ফেললেন এবং নিহত হওয়া পর্যন্ত শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন”
এটা একজন মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার সবচেয়ে বড় প্রণোদনা। এটা পরিষ্কার আত্মহত্যা! লোহার বর্ম খুলে যুদ্ধ করতে যাওয়া মানে তীর আর বল্লমের ঘায়ে প্রাণ হারানোর শতভাগ নিশ্চয়তা। নবী বলছেন, এইরকম জীবনের মায়া ত্যাগ করে লড়াই করলেই আল্লাহ খুশি হোন!
কুরআন বলে-
মুমিনদের জীবন-সম্পদ আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন (সুরা তওবা-১১১)। এবং যারা এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে তাদের পরিণত কি হবে সেটা বলছেন অন্যত্র-
“কিন্তু যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, নিশ্চিতভাবেই, তার জন্য আছে কঠিন এক জীবন, আর তাকে পুনরুত্থান দিবসে উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়” (২০:১২৪)।
মারামারি-কাটাকাটি, অন্যের পাকা ধানে মই দিতে সবাই রাজি নয়। জিহাদে সবাই আগ্রহী ছিল না বলে আল্লাহ বলেন-
তোমাদেরকে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা আসলে তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার এমনও হতে পারে কোন জিনিসকে তোমরা পছন্দ করো অথচ, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না (সুরা বাকারা: ২১৬)।
অসংখ্য হাদিস ও তাফসিরে বর্ণনা আছে রসূলের বর্ণনা শুনে তৎক্ষণা সাহাবীরা নিজের জীবন জিহাদের ময়দানে বিলিয়ে দিয়েছেন বেহেস্তে যাবার জন্য। এবং শহীদের মৃত্যু কষ্টও হবে অন্যদের চেয়ে অতি সামান্য, পিঁপড়ার কামরের চেয়ে অধিক নয়!
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ শাহাদাত অর্জনকারী ব্যক্তি মৃত্যুর কোন কষ্ট অনুভব করে না, তবে তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি পিঁপড়ের কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে শুধুমাত্র ততটুকুই অনুভব করে (তিরমিযীঃ ১৬৬৮, মিশকাতঃ ৩৮৩৬)।
এছাড়া হাম্বালী মাজহাবে, ইবন তাইমিয়া বলেছেনঃ
“চার মাজহাবের আলেমরা ঘোষণা করেছেন যে মুশরিকদের দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া জায়েজ যদিও এটাই সম্ভাব্য হয় যে তারা তাকে মেরে ফেলবে, যদি এতে মুসলিমদের উপকার থাকে।”
এতখানি পড়ে আপনাদের উপলব্ধি কি হয়েছে অনুমান করতে পারি। অনেকেই এখন বলতে শুরু করতে পারেন, ইসলামের উদার ও লিবারেল ব্যাখ্যাগুলোর প্রচার দরকার যাতে কেউ বিপথগামী না হয়। অথচ যারা এসব বলেন তারা কি কোনদিন বলেছেন কুরআন ও হাদিসের এই দলিলগুলো নিষিদ্ধ করা হোক? কেমন করে কুরআন ও হাদিসের এইসব সন্ত্রাসবাদকে রেখে দিয়ে উদার ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠা করবেন? একজন তরুণ যে আল্লাহ ও রসূলের উপর অন্ধভাবে বিশ্বাসী সে কি চাইবে না আল্লাহর রাস্তায় এভাবে জীবন বিলিয়ে দিয়ে জান্নাত লাভ করতে? হাজার হাজার তরুণ আনসারুল্লাহ, জেএমবির সদস্য হচ্ছে ইসলামের প্রতি তাদের আনুগ্যতার দরুণ। তারা ইসলামকে জানতে গিয়ে দেখছে কুরআন ও হাদিস তাদেরকে মরতে বলছে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এবং তা আল্লাহর কাছে অতিপ্রিয়! এইসব তরুণদের কিভাবে ফেরাবেন হাজার হাজার সহি দলিলকে জিইয়ে রেখে?
উপরের যে হাদিসগুলো ও কুরআনে তাফসির আমরা পাঠ করলাম, সেগুলো পড়েই একজন আলেম তার শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। একজন ‘ফরিদ উদ্দিন মাসউদ’ও এইসব পড়েই সোলাকিয়ার ঈদ জামাতের ইমামতির যোগ্যতা লাভ করেন। আসলে প্রয়োজন কুরআন ও হাদিসের এইসব আয়াত ও দলিলগুলোর ভিন্ন উপলব্ধির। ‘শিবির লাইব্রেরি’ কিংবা ‘তিতুমির মিডিয়া’ যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এসবকে তুলে ধরে, আমরা সেই একই দলিলকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরি যার মূল সুর থাকে জিহাদ থেকে একজন তরুণকে দূরে রাখা। আমাদের বিশ্লেষণই তাকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখাবে। অহেতুত ‘উদার ইসলামের’ পিছনে ছোটা হবে ছায়ার পিছনে ছোটার মতই পন্ডশ্রম…।