নারীত্বের চেতনা নিয়ে লিখতে গেলে দ্বিধায় পড়ে যাই। সুনিশ্চিতভাবে লিখতে গেলে লিখতে হবে আমি যা বোধ করি তাই। কারণ ছোট থেকে আমার পরিবার, সমাজ, দেশ, পরিবেশ আমাকে যা বোধশক্তি দিয়েছে তাই আমার জন্য বাস্তবতা। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে আমাদের দেশের বাইরে অন্যান্য দেশের সভ্যতায় নারীদের অবস্থানের কথা। এক মূহুর্তের জন্য আমার বোধশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কোনটা লিখব ভেবে। পরে মনে হয় আমার কাছে সেসব দেশের নারীদের অবস্থান দুর্বোধ্য। কারণ আমি কখনো সেসব দেশে গিয়ে নারীদের অবস্থান প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করিনি। তাই দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিই নারীকে আমি সেভাবেই লিখব যেভাবে আমি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি। জেন্ডার ভেদে নারী পুরুষ আমাদের জন্মগত সৃষ্টি। তাতে পার্থক্য করার সুযোগ নেই মানুষ ভিন্ন। আমরা কেউ স্বীকার করতে পারি না নারী পুরুষ একে অন্যকে বাদ দিয়ে মানুষ সৃষ্টি হতে পারে। বরং এটা সত্য যে নারী পুরুষ উভয়ই মানুষ আর মানুষ সৃষ্টির পরিপূরক।
আমাদের দেশে নারী শব্দটা শোনামাত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে সুরেলা কন্ঠ, মায়াবী রূপশ্রী আর কারুময় এক অনবদ্য সৃষ্টি। আমাদের সমাজে চোখের সামনে ভেসে উঠা নারীত্বের দৃশ্য এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। তারপর ভেসে উঠে এই দৃশ্যের একের পর এক নিরস পটভূমি। আমাদের সমাজ নারীর মিষ্টি কন্ঠ, রূপশ্রী আর নিয়মের বেড়া দেখিয়ে বলে, ‘ওখানে স্তব্দ হও নারী‘। যেন সত্যিই ঈশ্বরের হুংকার। আমরা কখনো অনুভব করার চেষ্টা করি না এই ঐশ্বরিক হুংকার আমাদেরই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার আমাদের পুরুষের। নিয়তিকে মৌন সম্মতি জানিয়ে নির্বোধের মতো আমরা পরবর্তী নির্মমতাকে স্বীকার করে নিই। আমরা যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে এভাবেই নিমজ্জিত ছিলাম। অপরদিকে পুরুষ শব্দটা শোনামাত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে এক দাম্ভিক পরিশুদ্ধ ঐশ্বরিক ক্ষমতা। যার হুকুমে নারীদের সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি। নারী পুরুষের সামাজিক এই দুই অবস্থানই সৃষ্টি হয়েছে মূলত আমাদের জেন্ডারভিত্তিক কিছু বৈশিষ্ট্যের সংকীর্নতাবোধ ও প্রয়োজনীয় সদুপায় অবলম্বনের অভাববোধ থেকে। বিজ্ঞান আর শিক্ষার প্রসারতায় যার দুই তৃতীয়াংশ এখন আর নেই বললেই চলে। যা আছে তা কেবল ধারাবাহিক প্রেক্ষাপটের কিছু কুসংস্কার আর অপরাধ প্রবনতা।
বিজ্ঞান আর শিক্ষা আমাদের বাস্তবতাকে স্বীকার করার পথ সুগম করে। যা অস্বীকার করার সামর্থ্য আমাদের কারো নেই। পুরুষের কাছে প্রভুত্ব স্বীকার করা এখন নারীর নির্বুদ্ধিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ধর্ষণ হচ্ছে একটা অপরাধ। আমি বলতে চাই নারী আর পুরুষের কোনো অসাম্যতা নেই। শিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনস্ক কোনো একজন নারী যেমন অযথাই পুরুষের প্রভুত্ব স্বীকার করেন না, তেমনি একজন মানবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো পুরুষও ধর্ষণ করেন না। নির্বুদ্ধিতা আর অপরাধ সবসময় নারী পুরুষের বাইরে। যেখানে আইনের স্বচ্ছ পদক্ষেপ বিদ্যমান। অপরাধ যেখানে অপরাধ বলে চিহ্নিত, সেখানে ঢালাওভাবে নারী পুরুষ পক্ষপাত নিতে পারি না। আমরা এখন উন্মুক্ত পরিবেশে বিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছি। যেখানে নারী পুরুষ সমানে সমান শিক্ষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আমরা স্বেচ্ছায় নারীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছি। ঠিক যেমন অকর্মণ্য উপাসক। বর্তমান সভ্যতা শিক্ষার অপার সম্ভাবনার বাঁধভাঙা স্রোত।
আমাদের সে যুগ আর নেই। যে যুগে শ্রদ্ধেয়া বেগম রোকেয়াকে চুরি করে বই পড়তে হতো। আর তাঁর স্বামী শ্রদ্ধেয় সাখাওয়াত হোসেনকে সর্বদা স্ত্রীর পাশে থাকতে হতো সহযোগীতার জন্য। আমাদের বরং এখন সময় শিক্ষার স্রোতে নিজের অস্তিত্বকে বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করার। আমরা যতদিন নারী শব্দটার মধ্যে অন্যায় নিপীড়ন দেখবো ততদিন মুক্তি নেই। আমাদের বরং দেখা উচিত জেন্ডার ভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টির কারণগুলো এবং জেন্ডার সমতায়ন বা জেন্ডার সচেতনতার দ্বারা কিভাবে এর উত্তরণ সম্ভব। নামপ্রসিদ্ধ চলমান নারীবাদকে চমকে দিতে সেখানে প্রবেশ করানো উচিত জেন্ডার সচেতনতা। নারী আমাদের সমাজ দ্বারা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি। আর জেন্ডার আমাদের অন্তর্নিহিত সত্য। আমরা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই নারী চক্রব্যূহের মধ্যেই ঘুরেফিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ি।
এতে করে জেন্ডার আর মানুষ শব্দটার বিলুপ্ত হয়ে যায়। নারী পুরুষ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত যে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে সকল মানুষ সমান। নিজের অধিকার আর স্বাধীনতাকে একজন মানুষের অধিকার আর স্বাধীনতা চিন্তা করতে না পারলে এবং তার স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও বাস্তবতা অনুধাবন করতে না পারলে, না আসবে আমাদের মুক্তি, না আসবে নারী মুক্তি। নারীর শরীর, পোশাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, রুচিসম্মত স্বাধীনতাবোধের থেকে একজন মানুষ হিসেবে ব্যক্তিত্ববোধের স্বাধীনতাই হবে নারী পুরুষ বিভেদের দুর্বার প্রতিরোধ। জেন্ডার আর তার বৈশিষ্ট্যের কাছে আমাদের নমনীয়তা থাকা আবশ্যক। পারস্পরিক এই শ্রদ্ধাবোধ মানবিক বৈশিষ্ট্য। আমরা ভুলে যাই মূলত এই জেন্ডার এর সমতায়ন থেকেই কিন্তু একটা পরিবার আর সমাজের সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে যুগ যুগ ধরে নারী নিগৃহীত হবার সংস্কৃতি এই সমতায়নকে উপেক্ষা করে এসেছে।
যেখানে একজন পুরুষ টক মিষ্টি স্বাদ অনুভব করতে পারে সেখানে একজন নারীও একই স্বাদ অনুভব করে। যেখানে একজন পুরুষ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন করার পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম সেখানে একজন নারীও তাই। অথচ আমাদের সমাজ দেখে নারী পুরুষের বিস্তর ব্যবধান। যে সমাজ আমরা সৃষ্টি করি সে সমাজ আমাদের নিগৃহীত হবার সংস্কৃতি লালন করতে পারে না। এক্ষেত্রে সঠিক চেতনার বিকাশই আমাদের মুক্তি দিতে পারে। অতিরিক্ত নারীত্ববোধের আসক্তি জেন্ডার আর মানুষকে অতিক্রম করে আমাদের মানসিক ভারসাম্যতাকে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে যায়। তখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নারী পুরুষে পরিণত হয়। অপরদিকে মানবিক চেতনাবোধ লোপ পায়। একজন পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীকে আমরা সহাবস্থান মূল্যায়ন করতে পারি না। অথচ খুব সূক্ষ্মভাবে এই নারীর কাছ থেকেই আমরা একজন মানবসন্তান কামনা করি।
প্রকৃতিগতভাবে হরমোনের কারণে নারী পুরুষ সৃষ্টি হলেও আমরা সেটিকে এড়িয়ে সামাজিকভাবে সৃষ্টি হওয়া নারী পুরুষকে লালন করি। সেখানে কিছু কৌশল অবলম্বন করে নারীকে ভিন্ন একটা সত্তায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
চিন্তা চেতনা বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একজন নারী নিজেই অবমুক্ত হন। সাহসীকতা আর ন্যায়পরায়ণতা থেকে একজন নারী নিঃসন্দেহে একজন আলোকিত স্বাধীন মানুষ। যে জিনিসগুলো দিয়ে একজন নারীকে বিচার করা হয় যেমন সন্তান লালন পালন, গৃহস্থালির দৈনিক কার্য সম্পাদন, পারিবারিক সদস্যদের ভরনপোষণ, দেখাশোনা ইত্যাদি দিয়ে একজন পুরুষকেও বিচার করা যায়। কিন্তু আমরা এখনো কেবল নারীকেই বিচার করি। একজন পুরুষ যে আবেগ আর চাহিদা দিয়ে একজন নারীকে অনুভব করে একজন নারীও সেই একই আবেগ আর চাহিদায় একজন পুরুষকে অনুভব করে। আমাদের দীর্ঘদিনের নারী পুরুষ সংস্কৃতির চর্চায় আমরা এখনো নির্যাতিতা, ধর্ষিতা, অবলা নারীকে দেখি। এটা মূখ্য বিষয় নয়।
অযথা নারী পুরুষ বিভেদ সৃষ্টি মানব সভ্যতা বিকাশের প্রতিরোধ হিসেবে বাতুলতা মাত্র। আর নারী সংস্কৃতির চর্চা যিনি করেন নারী বলে যিনি অবজ্ঞা করেন তিনিই কিন্তু নারী। সে পুরুষ বা নারী যেই হোক। কারণ তিনি নিজেই নারী শব্দটিকে নিজের মধ্যে পোষণ করেন। এবং তাই সবসময় নারী দেখেন। কেনো আমাদের নারীবাদী হয়ে নারীর উত্তরণ খুঁজে নিতে হবে। নারীবাদী হবার পিছনে আদতে আমি নারীই থেকে যাই সেটা আমাকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা হুমায়ূন আজাদ, তসলিমা নাসরিন দেখি কিন্তু জাহানারা ইমাম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দের, বেগম রোকেয়া দেখি না। কারণ আমরা নারী সংস্কৃতি চর্চা করি মানুষ সংস্কৃতি চর্চা করি না। আমরা নারীর স্তন, পিউবার্টি, মেনোপজ দেখি কিন্তু জেন্ডার দেখি না। আমরা নারীর ধর্ষণ দেখি অপরাধ দেখি না। আমরা কি ভুলে যেতে পারি এখন পুরুষও ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছেন।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের টনক নড়ে। যেখানে যেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারী দাঁড়িয়েছে সেখানে তাদের সহাবস্থান প্রমান করেছে। কোনো কোনো প্রতিযোগিতায় পুরুষ হেরে গিয়ে নারী জিতে। আবার নারী হেরে গিয়ে পুরুষ জিতে। আবার কোথাও কোথাও পুরুষ হেরে গেলে পুরুষ জিতে। নারী হেরে গেলে নারী জিতে। প্রতিদ্বন্দিতার মঞ্চে কেবলই প্রতিযোগী। নারী কিংবা পুরুষ নয়। আমাদের খুব সোজাভাবে নারী সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে যে অবস্থানই সৃষ্টি হোক না কেনো আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত আমরা মানুষ। একজন মানুষ হিসেবে জীবনে যা যা দরকার আমাদের তাই অধিকার করে নিতে হবে। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা নয়। নারী , পৃথক মঞ্চের সমাবেশ দিয়ে নয় বরং শিক্ষা সচেতনতা মানবিক মূল্যবোধ আমাদের এই সহিংসহতা থেকে মুক্তির উপায়।