ঘুম ভেঙে চোখ খোলার আগেই রীতির মনে পড়ে গতকালের ঘটনাটা, ও একটু অবাক হয় মাঝখানে একটা পুরো রাত কি করে নিমেষে উবে গেল। এমনতো হওয়ার কথা নয়।
চোখটা আবার আঠালো ঘুমে ভরে আসছে। নীল এর গায়ে লাল ছোপ ছোপ প্রজাপতিটাকে দেখতে পায় রীতি। আশ্চর্য! বারান্দার টবে ছোট গোল মোড়া সেপের ক্যাকটাসটার উপর বসে প্রজাপতিটা ব্যাথায় আরও নীল। সারা গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত যেন! কিন্তু ওর গায়ে অসংখ্য পরাগ রেণু থরে থরে সাজানোইতো আছে। ডানা দুটো অক্ষতই আছে। রীতি সুস্থ বোধ করে।
প্রজাপতিটা রীতির চেনা, রীতির ভেতরেই ওর বসবাস, আর নীলটা রীতির মনের রঙ, লাল ছোপ ছোপ রঙটা মঈনের দেয়া। রক্তচোষা টাইপের স্বভাব মঈনের, শরীরের যেখানেই ঠোঁট ছোঁয়ায়, সবটুকু রক্ত যেন শুষে নেয় একচুমুকে। দীর্ঘ দিন স্থায়ী হয় কালচে ছোপ ছোপ দাগ, এই দাগ ধীরে ধীরে লাল, লাল থেকে নীল হয়। বিয়ের প্রথম রাতেই মঈনের স্বভাবে এই রক্তচোষার অস্তিত্ত টের পেয়েছিল রীতি। আর বিয়ের পর প্রথম সকালে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে বড় বেলজিয়াম গ্লাসে পাওয়া রক্ত ছোপের নীল প্রজাপতিটার চিত্রকল্প।
আহ! সবাই কি একদিন আবিস্কার করে সুখের এই স্বর্ণ খনি। জীবনের কোষে কোষে ছড়িয়ে থাকা সুখের স্বর্ণরেণু! কিযে ভালো লেগেছিল রীতির, কতবার মঈন আগ্রাসী দাঁতও বসিয়ে দিয়েছে ওর গ্রীবায়, স্তনে, তলপেটে যত্রতত্র, ব্যাথায় কুকড়ে গিয়ে মইনকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে 'রক্তচোষা' বলে ভ্রম্নকুটি করে, মঈন হু্ -বলে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠে। এই হু্ - রীতির কাছে সহনীয় করে দেয় সব আগ্রাসন! মঈনকে তখন মনে হয় শিশু। টেকেনি সম্পর্কটা। সে অন্য গল্প।
সম্ভবত ঐ দিনগুলোতে রীতি এনিমিয়ায় ভুগছিল, শাওয়ারের নীচে দাঁড়ালে সামনের আয়নায় কদাচিৎ দেখা যেত ছোপ ছোপ রক্ত রঙের প্রজাপতিটাকে তাই হয়তো রক্তচোষাকে রক্তের সন্ধানে অন্যত্র যেতে হয়েছিল। আর প্রজাপতিটা রীতির মনের ফ্রেমে বাঁধা পড়ে। রীতি খুব সাবধানে প্রজাপতিটাকে হাতের পাতায় তুলে নেবে ভেবে হাত পেতে দেয় - উফ! ক্যাকটাসের কাঁটায় গেঁথে যায় ওর হাতের পীঠ। ওর আবার ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম ভাঙলেও ও চোখ বন্ধ করে থাকে, আচ্ছা ঘুম কি সত্যি ভেঙেছে একবার সংশয় জাগে মনে। দেয়াল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ শুনতে পাচ্ছে তার মানে কি এখনও রাত শেষ হয়নি! আচ্ছা প্রজাপতিটা আজ ক্যাকটাসে বসেছে কেন?
ওরতো বাথরুম বেলজিয়ামে থাকার কথা। ও কি এখনো অনিবার্য দুঃস্বপ্নের ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে জীবনের সর্বশেষ পল অনুপলের বিলাপ শুনছে! টিক, টিক, টিক। মনুষ্য জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করছে রীতি, প্রায় ভাবে কথাটা - কেন ও এরকম? সবই যদি এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায় ও কেন ঘটনার ঘূর্ণী আবর্তে আদি অন্তহীন দুঃস্বপ্নে পাক খেতে থাকে?
মগবাজারে একটা দোকানে চশমা ডেলিভারি নিতে গিয়েছিল সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা জন্য দাঁড়িয়েছিল এই সময় ঘটে ঘটনাটা, ঘটনার কার্য কারণের সঙ্গে তার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত রীতির কোন সম্পর্ক না থাকলেও কার্য রীতির গা ছুঁয়ে একটু সামনে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে অবশ্য ছুটে যাওয়া অবয়বটা মানুষের কিনা প্রশ্নটা ঘটনা পরবর্তী মনপর্যালোচনায় উঠে এসেছে অনেকবার। যখন ওর গা ছুঁয়ে ছুটে গিয়ে হমড়ি খেয়ে পড়েছিল তখন মানুষইতো মনে হয়েছিল। আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই মানুষের মত অবয়বটি বদলে যেতে থাকলো, আরো কিছু অবয়ব তিন কি চার মনে করতে পারে না রীতি ঘটনার আকস্মিকতার কারণে।
তিন অথবা চারটি অবয়বও মানুষের মতই ছিল, ওদের হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া মানুষের মত অবয়বটিকে বদলে ফেলার ক্ষীপ্রতা ছিল অমানবিক, ওরা কেবল দেখতে মানুষের মত ছিল। পলায়নপর অবয়বটিকে ধাওয়া করে আসার সময় বায়ুমন্ডলে যে গতি সঞ্চার হয় রীতি তাতেই একদিকে ছিটকে পড়ে নাকি ঐ তিন কি চারটি মানুষের মত অবয়বের একটির ধাক্কায় রীতি পড়ে যায় এ প্রশ্নটি মনপর্যালোচনায় খুব জোরালো হয়ে উঠে না। পলায়নপর মানুষের মত অবয়বটি ফালি ফালি করে কাটা মিষ্টি কুমড়া অথবা তরমুজের অবয়ব ধারণ করে তিন কি চারটির ক্ষীপ্রতায়, এখন দেখে রীতি মনে করতে পারে না, পলায়নপরটি রূপান্তরিত হওয়ার আগে আদৌ মানুষের অবয়ব ছিল কিনা! ধেয়ে আসা তিন কি চারটির ছিল আজরাইল ফেরেশতার মত নুরানী সুরত! মাথায় গোল টুপি, ওরা যখন ফালি ফালি করে মিষ্টি কুমড়া অথবা তরমুজ কাটছিল তখন ওদের নুরের ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিলো জেহাদী জোস্। আর হুমড়ি খেয়ে পড়াটি ছিল যেন আরিচা ঘাটের হোটেলের ক্ষুধার্ত যাত্রী সাধারনের জন্য প্রায়শ জীবন উৎসর্গীকৃত কোন মহান কুকুর, হোটেলেরই উচ্ছিষ্ট খেয়ে অবৈধভাবে যে দেহে জমিয়েছে সুশোভন মেদ।
জুম্মাবারের দুপুরে আজরাইল ফেরেশতার মতো নুরানী সুরতগুলো আল্লাহু আকবর বলে যারা কুমড়া অথবা তরমুজ ফালি করার জন্য নিজেদের উদ্দীপ্ত করেছিল তারা এবং আরিচা ঘাটের কুকুরের অবয়বটি ছিল মানুষের মত। দুপুর দুইটার ঢাকার রাস্তায় অগণন অবয়ব ( অধিকাংশই মানুষের মত দেখতে) স্রোত মূহুর্তের জন্য চলৎশক্তি হারালেও কেউ ঘটনার সাথে নিজেকে প্রলম্বিত করতে চায় না বিধায় তিন কি চারটি, জেহাদী জোস যাদের মনকে উদ্দীপ্ত করেছিল তারা কোরবাণীর পশু জবেহ করার মহিমাময় অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে প্রলম্বিত না হতে চাওয়াদের দলে মিশে যায়।
রীতিও নিজেকে প্রলম্বিত করতে চায় না ও জানে প্রলম্বনের ভয়াবহতা, জীবনবোধ সঞ্চারের মূহুর্ত থেকে রীতি জেনেছে ওর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া যে কোন ছোট বড় ক্রুরতা, নৃশংসতা মানেই ঘটনার মনপর্যালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া। রাতগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠা, অথবা নিদ্রা আচ্ছন্ন হয়ে সুনামী গ্রস্ত দুঃস্বপ্নের ঘূর্ণী আবর্তে পাক খেতে থাকা, আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠে রীতি, দুপুর সাড়ে বারোটার শহরের রাস্তায় যেন কিছুই ঘটেনি এমনি ভাব করে রীতি মানুষের মতোদের স্রোতে মিশে যেতে চায় কিন্তু ঘটনাস্থলে ওর দৃষ্টি আটকে যায় কারণ একটি কুকুরের অবয়ব নিজেকে প্রলম্বিত করেছে ঘটনায়, সময় রীতির পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়, আতঙ্ক ওর গলা দিয়ে বমির মতো বেরিয়ে আসতে চায়, বিস্ফারিত চোখে ও দেখে একটি পুলিশের গাড়ি, কখন কষাই খানার মাংসের স্তুপে পরিণত হওয়া কর্তনের পূর্বে যে ছিল মানুষের অবয়ব, ঢিমে তালে তার সুরত হাল রিপোর্ট তৈরী করে মিষ্টি কুমড়া অথবা তরমুজের ফাঁলির মতো পুলিশের লাশবাহী গাড়ীতে তুলে নেয়।
রীতি পুলিশ কর্মকর্তার মুখের অভিব্যাক্তি লক্ষ্য করে কারণ ইচ্ছে না থাকলেও রীতি ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রলম্বিত করে ফেলেছে ঘটনার সঙ্গে। পুলিশগুলোও মানুষের মত দেখতে, ওরা ওদের কাজ করে নিয়ম মাফিক কিন্তু নিজেদের প্রলম্বিত করে না। মিউনিসিপালিটির সুইপার যে রকম অভ্যস্ত হাতে পেঁয়াজ, রসুন, আনারস, পেঁপেঁর খোসা, মোরগ-মুরগীর নাড়িভুড়ি, ব্যবহৃত সেনেটারী নেপকিন, অথবা কুকুরের মত দেখতে বেড়ালের মতো দেখতের মৃত অবয়ব, কখনো কখনো ডাষ্টবিনের রুচি পরিবর্তনের জন্য পলিথিনে মোড়ানো নিষ্কলুষ মানব শিশুর মৃত অবয়ব আবর্জনার গাড়ীতে তুলে নেয়, একই অভ্যস্ততায় একটু আগে যে ছিল মানুষের অবয়ব সেই কুমড়া অথবা তরমুজের ফালিগুলো তুলে পুলিশ ভ্যান চলে যায়। ওরাও যেন চায় না মানুষের মতো দেখতে অন্যরা এখানে প্রলম্বিত হোক।
মাংস কিংবা মিষ্টি কুমড়া বা তরমুজের ফালিগুলো যেখানে পড়েছিল সেখানে থোক থোক রক্ত জমাট বেঁধে আছে, অন্য মানুষের মত দেখতেরা যে যার মত চলে যেতে যেতে নিরুৎসুক তাকাচ্ছে, একটি অবয়ব যেটি কুকুরের মত দেখতে, এগিয়ে জমাট রক্ত শুকে প্রকাশ করে তার সংবেদনশীলতা তারপর গোলাপী জিহ্বা দিয়ে পরম মমতায় চেটে খায় জমাট রক্ত যেন মানুষের আজন্ম অনুগত কুকুরের মতটি চায় না কোন পথচারীর পায়ের নীচে দলিত হোক আশরাফুল মাখলুকাতের রক্ত। কুকুরের মতটি মানবিক যত্নে পুরোটা রক্ত খেয়ে চলে গেলে রীতি বুঝতে পারে না ঠিক কোথায় ঘটনাটি ঘটেছিল, একটু পরে আরো বুঝতে পারে না ঘটনাটি আদৌ ঘটেছিল কিনা, ঘটনার কোন চিহ্নইতো এখানে নেই সবকিছু স্বাভাবিক, সুস্থির, কিন্তু রীতি প্রলম্বিত হয়ে আছে, এটা যেন ওর এজন্মের কোন ঘটনা নয়, ঐতো সব কিছুই সময়ের গতিপ্রবাহে এগিয়ে যাচ্ছে রীতি শুধু হাতড়ে বেড়াচ্ছে পূর্ব জন্মের কোন স্মৃতি, ওকি জাতিস্মর! তানাহলে ওর চারপাশের সময়কে স্পর্শ করেনি কেন ঘটনাটি ওরই কেন এমন হয়! মুছে যাওয়া ঘটনাগুলো কেন ওর মনে বার বার রিওয়াইন্ড- ফরোয়ার্ড হতে থাকে, যে ঘটনা পৃথিবীতে একবার ঘটে গেছে ওর মনে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে একবার, দুইবার, তিনবার, বার বার চলতেই থাকে। ও চায় না এই পুনরাবৃত্তি। একেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটে আর ওর অনেক কষ্টে গোছানো জীবনটা তছনছ হয়ে যায়। রীতি ঘুমাতে পারে না, অনেক অনেকবার রীতি পৃথিবীটাকে গুছিয়েছে। আর পারে না।
রীতি তখন বেশ ছোট, অনেক পায়রা ছিলো রীতিদের বাড়িতে, গোনা যায় না, রীতি হাতের মুঠিতে ভরে গমের দানা ছিটিয়ে দেয় ছাদে, ওরা আকাশ আড়াল করে উড়ে এসে পড়ে ছাদে ওরা রীতির হাত থেকে গমের দানা খুটে খায় আর বাক-বাকুম বাক-বাকুম সঙ্গীতে মুখরিত হয়ে উঠে রীতির ছেলেবেলা। এভাবে কখন যেন পায়রার সাথে উড়তে উড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে রীতির শৈশব আবার পাক খেতে খেতে নেমে আসে পায়রার ডানায় ভর দিয়ে।
সেদিনও খুব ভোরে উঠে রীতি আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে নিয়ে ছাদে যায়, দুলে উঠে ওর পৃথিবী এবড়ো ধেবড়ো মাটির পৃথিবীতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ওর আকাশে উড়বার বাহন দুটি পায়রার দেহাবশেষ। রক্ত ছড়ানো ছাদের এদিক ওদিক নৃশংস ভাবে ছিড়ে খেয়েছে কেউ, বাড়ীর বয়োজৈষ্ঠ্য বড়বাবা তিনি সিদ্ধান্ত দেন মোঁয়াপ! রাতের অন্ধকারে সন্তর্পনে অত উঁচুতে পায়রার খোপ থেকে শুধু মোঁয়াপ এর পক্ষেই সম্ভব পায়রার গিলা কলিজা রক্ত খেয়ে যাওয়া, মোঁয়াপ দেখতে একটুকরো অন্ধকারের মতো, উড়ে এসে জুড়ে বসে পায়রার গিলা কলিজা রক্ত খেয়ে কেউ দেখতে পাওয়ার আগেই মিলিয়ে যায় বাতাসে, বড় বাবা তার সাদা হয়ে যাওয়া দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে একশো বছর অতীত থেকে কথা বলেন, গমগম করে তার কন্ঠ
- 'মোঁয়াফ লাইগগে, থাইকতো ন উজাড় অই যাইবো কইতরর চাল, উজাড় অই যাইবো কবিরর গেরস্থি' ডাইনোসরের চেয়েও অতীত কোন দানবের ছায়া পড়ে রীতির হৃদপিণ্ডে। এর আগে কখনই শোনেনি রীতি এমন রক্ত হিম করা দানবের নাম।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফলে যায় বড় বাবার কথা। টলে যায় রীতির মানসিক ভীত। রীতি ঘুমাতে পারে না, মোঁয়াফ আক্রান্ত হয় ওর সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো, মোঁয়াপ মোঁয়াপ বলে - রীতি চীৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে! বাবা মা দুজনেই পালা করে জেগে থাকে রীতির পাশে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় রীতিকে, বাবা কিংবা মায়ের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রীতি ঘুমিয়ে পড়ে। বাবা-মা সরে গেলেই আবার মোঁয়াপ- মোঁয়াপ চীৎকার করে জেগে উঠে। এই দু:সময়েই একদিন ঘুমের মধ্যেই থেমে যায় বাবার হৃদযন্ত্র। সেই শুরু রীতির অস্থির পৃথিবী আর সুস্থির হয় না। বিস্তর চিকিৎসা চলে। মা সারা দেশ ঘুরে তাবিজ কবজ যেখানে যা পান কালো গুনছিতে বেঁধে ঝুলিয়ে দেন রীতির গলায় কোমরে। কালো গুনছিতে বাঁধা পড়ে রীতির মোঁয়াপ আক্রান্ত সময়।
এই রকম সময় মা কার কাছে যেন শুনে টেকনাফের কোন এক গ্রামে একজন শিশু ফকিরের আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি সর্বরোগের ঔষধ দিচ্ছেন। আয়শা খাতুন রীতিকে নিয়ে ছুটলেন তার কাছে।
জল কাদা পার হয়ে নাফ নদী পাড়ের সেই গ্রামের নাম ওয়াব্রাং, সেখানে পৌঁছে রীতি দেখে রোগ গ্রস্ত পৃথিবী দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে শিশু ফকিরের ঔষধ এবং দোয়া প্রার্থী। লাইনের দৈর্ঘ্য আয়েশা খাতুনের বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় ভিত্তির উপর দাড় করায়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত লাইন পাড়ি দিতে আয়েশা খাতুনের তাই কষ্ট হয় না তিনি তসবিহ জপেন আর শিশু ফকিরের কাছে সন্তানের আরোগ্য কামনা করেন। রীতি শিশু ফকির দর্শনের উদগ্র উৎসাহে ভুলে যায় ক্ষুধা তৃষ্ণা এমন কি মোঁয়াপ আক্রান্ত দুঃস্বপ্নের কথা।
লাইন পাড়ি দিতে দিতে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে শিশু ফকিরের বাড়ীর মধ্যে একটি দীর্ঘ বিলাপ ধুমায়িত হতে থাকে এবং কিছু টুকরো সংবাদ ভেসে এসে রীতির কানে মৌ চাকের মত ঝুলে পড়ে গুঞ্জন করতে থাকে, এক সময় মৌচাক থেকে একটি শোক সংবাদ গলে গলে পড়ে।
কেরামতি কারবার, দেড় বছর বয়সের শিশু মায়ের কোলে শুয়ে একমাস যাবৎ রোগ গ্রস্ত পৃথিবীকে সর্বরোগ নিবারক ঔষধি শিকড় বিতরণ করতে করতে কখন মায়ের কোলে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন কেউ বলতে পারে না। শিশু ফকিরের গর্ভধারিণী এক সময় ঠাহর করেন শিশুর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেছে, হাত আর রহমতের ভান্ড থেকে শিকড় তুলে আনছে না এই সংবাদ গর্ভধারিণীর বক্ষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এসে উপস্থিত জরার জমায়েতকে বিশৃংখল করে রীতির কানকে দীর্ণ করে আকাশটাকে ফুটো ফুটো করে দেয়। মুষলধারে বৃষ্টি নামে। আয়েশা খাতুন নিজের মন্দ ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে মেয়ের হাত ধরে ফিরতি বাসে চেপে বসে।
বাইরে ফুটো আকাশ বেয়ে তুমুল ঝড়ে পড়ছে শিশু ফকিরের মায়ের কান্না। বাস কক্সবাজারের পথে সেই কান্না মুছে মুছে এগিয়ে যাচ্ছে, বালুখালী বিডিআর ক্যাম্প পেরিয়ে নির্জন পাহাড়ী রাস্তায় এসে বাস থেমে যায়, রাস্তার পাশে অঝোড় বৃষ্টিতে শুয়ে আছে একটি মৃত মানুষের অবয়ব। অবয়বটি একটি গামছায় ঢাকা, কাছেই পাহাড়ের কোল ঘেসে ঝুপড়ি দোকান থেকে একজন মানুষের অবয়ব ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে এসে যাত্রীদের জানায়, সহায় সম্বলহীন মানুষটিকে সকালে আরেকটি বাস পিষ্ট করে চলে গেছে তাই লাশটি রাস্তায় শুয়ে তার দাফন কাফনের জন্য চাঁদা তুলছে, আয়েশা খাতুন বিড় বিড় করে ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন পড়তে পড়তে অনেক গুলো টাকা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে শিশু ফকিরের মায়ের আর্তচীৎকারে ফুটো হয়ে যাওয়া আকাশের বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা মৃত চাঁদাবাজ এর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তারপর অতি সতর্কতায় রীতির গলায় পেঁচানো স্কার্ফটি ওর মাথায় বেধেঁ দেবার আগেই মৃত চাঁদাবাজ অবয়বটি রীতির মগজে কবিতার দুর্লভ চিত্রকল্পের মত উঠে আসে যা পরবর্তীতে রীতির মোঁয়াপ আক্রান্ত বোধের জমিনে শুয়ে পুন: পুন: শিশু ফকিরের মায়ের কান্নায় ফুটো হয়ে যাওয়া আকাশের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চাঁদাবাজী করবে। রীতির মা আয়েশা খাতুন প্রতিবারই সোয়া সের চাল একটি জীবন্ত মোরগ সোয়া পাঁচ টাকা রীতির জানের ছদকা স্বরূপ দান করবে একজন মৌলানার অবয়বকে। মোঁয়াপ আর মৃত চাঁদাবাজ ছিড়ে খুড়ে খায় রীতির স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আর আয়েশা খাতুন ঘুষ দেয় মৌলানার অবয়বকে এই চিন্তা রীতিকে সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে মোঁয়াপের জাগতিক অবয়ব হচ্ছে মৌলানার মত দেখতে, সময়ের ব্যবধানে যা পরিণত হয় এক টুকরো অন্ধকার জালে যা ওর মগজের কোষে উড়ে এসে জুড়ে বসে স্বপ্নগুলোকে ছিড়ে খুঁড়ে খেতে থাকে।
এই সময়েই একদিন রীতির জীবনে স্বতারুণ্য উঁকি দেয় মঈন, ওর মনে মেঘের মত সাদা এক ক্যানভাস! পাঁচ বছরের ঝড়ো প্রেমের কাছে পরাভুত হয় মোঁয়াপ আক্রান্ত সময়। তারপর বিয়ে, বিয়ের পরেও দুই বছর একই ক্যানভাসে ছবি আঁকে দুজনে তারপর আর রেখাগুলো মেলে না প্যালেট নিংড়ে যে রং তা বিভৎসতায় রুপ নেয় ক্রমশ। সুখের স্বর্ন রেণুমাখা প্রজাপতির শরীর থেকে ঝরতে থাকে ফোটা ফোটা রক্তপুঁজ। আয়েশা খাতুন বেঁচে থাকলে এবারও হয়তো রীতিকে নিয়ে ছুটতেন কোন সর্বরোগের চিকিৎসকের কাছে কিন্তু রীতি এবার আর তাবিজ কবজের খোঁজে যায় না, একজন কলিগের সহায়তায় এডভোকেট আলতাফের শরণাপন্ন হয়। গতকাল সিটি কর্পোরেশনের সালিশী পরিষদ থেকে শেষ চিঠিটা পেয়েছে।
ঘুমে আবার কখন যেন চোখের পাতা লেগে এসেছে। তবুও মিষ্টি কুমড়া অথবা তরমুজের ফালি অথবা জেহাদী জোসের নুরের ফেরেশতারা ওর স্বপ্নকে ক্ষতবিক্ষত করতে ছুটে আসছে না দেখে রীতি একটু অবাক হয়, প্রতিরোধ তৈরী হচ্ছে তাহলে! সংবেদী হৃদয়ের বাইরে ঝিনুকের মতো শক্ত একটা আবরণ যেন ওকে নিরাপত্তা দেয়। প্রজাপতিটা ক্যাকটাসে পাখা ঝাপটাচ্ছে। একটা যুদ্ধে রীতি জিতেছে পরের যুদ্ধগুলোতেও ওকে জিততে হবে। দু'একটা ভোরের পাখি জেগে উঠে ওর বারান্দায় কিচিমিচি করছে। রীতিও উঠে পড়ে।