জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

একটি আগামাথাহীন স্মৃতিগদ্য

একজন যৌন নির্যাতক শিক্ষকের কারণে আমার প্রাইমারী স্কুলের জীবন কেটেছিলো ভীষণ অস্থিরতা এবং অস্বস্তিতে। ওই পাঁচ বছরের কোনো মধুর স্মৃতি আমার নেই। কীভাবে উনার হাত থেকে বেঁচে থাকব সেটাই ছিল আমার একমাত্র ভাবনার বিষয়। পড়াশোনার বিষয়টা তখন মাথায়ই ঢুকত না, প্রতিবছর ফেল করতাম এবং শিক্ষকদের দয়ায় উপরের ক্লাসে প্রমোশন পেতাম। আমার পড়াশোনা নিয়ে আমার চেয়েও বেশি উদাসীন ছিলেন আমার অভিভাবকেরা।

কিন্তু ক্লাস সিক্সে ওঠার পর জীবনে আমূল পরিবর্তন এলো। ঘরে-বাইরে নির্যাতন-মুক্ত থাকা শিখে গেছি ততদিনে। নিজের চারপাশে তাকাতে শিখেছি, প্রকৃতির নানান রঙ উপভোগ করতে শিখেছি, পাঠ্যবইয়ের কবিতা আর গল্পগুলো বুঝতে শিখেছি। আমাদের স্কুলটা ছিলো একটা ছোট পাহাড়ের উপর, চারদিকে গাছপালা, বনবাদাড় আর ধানক্ষেতে ঘেরা। তখনো পড়াশোনায় আমার তেমন একটা মনোযোগ ছিলো না। বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই, ছড়া লিখি, পাহাড়ের ঢালের কাঁঠালচাঁপার ফুলের গন্ধ আসলেই কাঁঠালের মতো- এমন সব তথ্য আবিষ্কার করে পুলকিত হই।

তারপরও বছরের পর বছর ফেল করা আমি ক্লাস সিক্সের ষান্মাসিক পরীক্ষায় একেবারে প্রথম হয়ে যাই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেয়া ব্যক্তিগত বৃত্তির ৩৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে সবাইকে অবাক করে দেই। তারপর প্রতিটা পরীক্ষায় প্রতিটা বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ঠেকাতে পারি না আমি নিজেও। ক্লাসের পাঠ-মনোযোগী দুটো ছেলে আমার চেয়ে ভালো করার চেষ্টায় হিমশিম খেয়ে যায় কিন্তু পারে না। শিক্ষক একদিন কৌতুক করে বলেন- 
'এই মেয়েকে তোমরা সহ্য করো কী করে? একে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দাও।' 
একটা ছেলে কৌতুক দিয়েই কৌতুকের উত্তর দেয়- 
'স্যার, ও রোজ সকালে আটার রুটি আর ডিম খায়, গায়ে অনেক শক্তি।' 
স্যার ক্লাস শেষে বেরিয়ে গেলে মজা করে সবাই ঘিরে ধরে আমাকে, 'আজ সত্যি তোকে পাহাড় থেকে ফেলে দেব।' আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকা, বাকিরা সবাই আমাকে চেপে ধরেছে। আমি পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ছি, না পেরে একসময় ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়। আব্বার মিলিটারি স্টাইলের নাশতার গুন বুঝতে পারি।

সাফল্য অভ্যাসে পরিণত হয়। শুধু পড়াশোনা নয়, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা সবকিছুতে প্রথম হতে থাকি। ক্লাস সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষা, ক্লাস সেভেনের ষান্মাসিক এবং বার্ষিক পরীক্ষায় পরপর প্রথম হবার পর হঠাৎ আমার অভিভাবকরা আমার শিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলে আমার সুখের শিক্ষাজীবনে আবার বিপর্যয় নেমে আসে। আমাকে পাঁচ মাইল দূরের শহরে পাঠানো হয় সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। সেই সময়েও ওই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো যার কথা জানতেন না আমার অভিভাবকেরা। তবু আমি ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যাই। আমার স্কুল জীবনে অস্থিরতা আর অস্বস্তি ফিরে আসে, যদিও এবার ভিন্ন কারণে।

নতুন স্কুলের চৌকস সব মেয়েদের ভীড়ে গ্রামের স্কুলে পাহাড়-কাঁপানো আমার নিজেরই এবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপে। এদের নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম, চুল বাঁধার ঢং, কথা বলার কায়দা কিছুর সাথেই পাল্লা দিতে পারি না আমি। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে, মা অসুস্থ। আমাকে সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য রান্না করে রেখে স্কুলে যেতে হয়, কাপড় ইস্ত্রি করার সময় হয় না আমার। তাছাড়া পড়াশোনা, খেলাধূলা সবদিক দিয়েই এরা আমার থেকে অনেক পটু। আমার সাথে মিশে না কেউ, আমিও আগ বাড়িয়ে মেশার চেষ্টা করি না। পেছনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকি, খুব একা লাগে।

এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল। ক্লাসের একটা মেয়ে একদিন যেচে কথা বললো আমার সাথে। এই মেয়েটার আসল নাম কেনো বলা যাবে না, সেটা গল্পের শেষে বোঝা যাবে। ধরা যাক তার নাম মিথিলা। আমার পুরোনো স্কুলের একজন শিক্ষক মিথিলাকে প্রাইভেট পড়াতেন। তিনি তাকে বলে দিয়েছিলেন, 'জেসমিন খুব ভাল মেয়ে। ওর সাথে মেলামেশা করবে, অনেক কিছু শিখতে পারবে।'

মেয়েটা আমার সাথে কথা বলতো ঠিকই কিন্তু আমার প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিলো বলে আমার মনে হতো না। ওই বয়সেই সে ভুরু প্লাক করতো, ভুরু প্লাক করা বলে যে একটা বিষয় আছে তা তার কাছেই আমি প্রথম জানতে পারি। ওর আংগুলের সুন্দর করে শেপ করা লম্বা নখগুলোতে নিখুঁতভাবে নেল পলিশ লাগানো থাকত সবসময়, ক্লাসে শিক্ষিকাদের কাছ থেকে নিজের হাত দুটো লুকিয়ে রাখতে অনেক বেগ পেতে হতো তাকে। প্রতিদিন টিফিন টাইমে বারান্দায় আমার কাছে এসে বসত মিথিলা এবং নানানভাবে আমার সমালোচনাই করতো শুধু। তুমি অমন উটপাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটো কেনো? নখ এতো ছোট করে কাটো কেনো? তোমার জামার সাদাটা এমন মলিন কেনো, সাদা জামায় নীল দিতে হয় জানো না?

ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দেবো বলে আমার জন্যও বাসায় প্রাইভেট শিক্ষক রাখা হয়েছে তখন। মাঝে মধ্যে স্যার আসতে না পারলে তার বড়ভাই আসতেন আমাকে পড়াতে। ইনার কবিতা লেখার হাত খুব ভাল ছিলো। উনি এলে আমার মন আনন্দে নেচে উঠতো কারণ উনি পড়াতেন খুব কম, গল্প করতেন বেশি। আমাকে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ শেখানোর চেষ্টা করতেন, স্বরবৃত্ত/মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে মধ্যে আমার খাতায় কবিতাও লিখে দিতেন। একদিন তার লেখা একটা কবিতা দেখালাম মিথিলাকে। সে আমাকে বুঝিয়ে দিলো আমার প্রাইভেট শিক্ষক আমার প্রেমে পড়েছেন, 'প্রেমে না পড়লে কারো খাতায় কবিতা লিখে দেয় কেউ? তুমি গ্রামের স্কুলের মেয়ে তাই কিছুই বুঝো না।' শুনে এমন মন খারাপ হলো আমার কিন্তু কিছু বললাম না।

এর কিছুদিন পর একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেলো। সেদিন মিথিলা স্কুলে আসেনি, তাই আমি একাই বারান্দার কোণায় বসে বাসা থেকে আনা আটার রুটি আর আটার হালুয়া খাচ্ছি। এমন সময় মিথিলার ছোটবোন প্রিসিলা ছুটে এলো, 'আপু কই?' আমি তো অবাক! 
'তোমার আপু তো আজ স্কুলে আসেনি।'
'মজা করছেন কেনো? বলেন না আপু কোথায়। আমার টিফিন আপুর ব্যাগে দিয়েছে মা। আপু কি ক্লাসে?'

আমি যতই বলি মিথিলা আজ স্কুলে আসেনি, প্রিসিলা ততই আমাকে বোঝায় তারা দু'জনে একসাথে স্কুলগেটের বাইরে গাড়ি থেকে নেমেছে। একসাথে স্কুলের ছোট গেটটা দিয়ে ঢুকেছেও। তারপর সে নিজের ক্লাসে চলে গেছে। এমন অদ্ভুত কথা আমার চৌদ্দ বছরের জীবনে আগে শুনিনি আমি। অন্য কোনো সম্ভাবনার কথা ভাবার মতো অভিজ্ঞতাও আমার ছিলো না তাই ধরেই নিলাম প্রিসিলা আমার সাথে ঠাট্টা করছে।

এমন সময় ঢং ঢং ঘন্টা বাজলো, টিফিনের ছুটি শেষ হয়ে গেলে আমি ক্লাসে চলে গেলাম। আমার প্রিয় শিক্ষিকা রওশন আরা ম্যাডাম চমৎকার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন একটা কবিতার, আমি তন্ময় হয়ে শুনছি। এমন সময় বুড়া বেয়ারা, যাকে আমরা দাদা ডাকতাম, এসে জানালো আমাকে প্রধান শিক্ষিকার কামরায় যেতে হবে। জরুরি তলব। বুকের ভেতরে লাফাতে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে কামরায় ঢুকে দেখি মিথিলার মাবাবা এবং একজন আরো একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। সবার চেহারা থমথমে।

প্রধান শিক্ষিকা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, 
'মিথিলা কোথায়?' 
'আমি জানি না আপা'। 
'ফাজলামো করো না, ভালয় ভালয় যা জানো বলে ফেলো নইলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।' 
'আমি সত্যিই জানি না আপা'। 
অপরিচিত ভদ্রলোকটি, যাকে দেখতে আর্মি বা পুলিশ অফিসারদের মতো, বললেন- 
'আমরা জেনেছি ও সবসময় ক্লাসে তোমার পাশে বসে, তোমরা একসাথে টিফিন খাও। তুমি ছাড়া আর কারো সাথে খুব একটা কথাই বলে না সে। তুমি নিশ্চয়ই জানো সে কোথায়।' 
ততক্ষণে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। আমার অস্বস্তিকর অথচ নির্ভেজাল স্কুল জীবনে এ কেমন উটকো ঝামেলা এসে উপস্থিত হলো? 
মিথিলার বাবা উঠে এসে আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিলেন- 
'তোমার এই আংকলকে দয়া করো মা। আমি বড় বেশি বিপদে পড়ে গেছি। বলে ফেলো ও কোথায় গেছে, তোমাকে পুরষ্কার দেবো।'

তার চোখে পানি, চেহারায় অসহায়ত্ব, আমাকে ধরে রাখা তার হাত দুটো কাঁপছে। আমি নিজেও ভীষণ অসহায় বোধ করছি, এর আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি কখনো। আরো কিছু সময় আমাকে জেরা করে তারা ছেড়ে দিলেন। ততক্ষণে প্রায় স্কুল ছুটির সময় হয়ে এসেছে। ক্লাসের মেয়েরা এসবের কিছুই জানলো না, তারা ভাবল আমি বোধ হয় কিছু একটা অপরাধ করে বিপদে পড়েছি। আমিও কাউকে কিছু বললাম না।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে আমাদের টিলাবাড়ির সামনের বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় টিলার পেটের ঢালু পথটা ধরে উপরে উঠে এলো বিরাট একটা জীপ। এই জীপ আমি আগেও বহুবার দেখেছি, স্কুলের সামনে মিথিলাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়। গাড়ি থেকে নেমে এলেন মিথিলার মা-বাবা এবং তার প্রাইভেট শিক্ষক যিনি আগের স্কুলে আমার শ্রেনীশিক্ষক ছিলেন।

আবার শুরু হলো জেরা। আমি যতই বলি আমি কিছু জানি না ততই আমাকে ঘটনার গুরুত্ব বোঝানো হয়, হুমকি দেয়া হয়, পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়। এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিথ্যা একটা কিছু বলে দেয়ার মতো কল্পনাশক্তিও আমার মধ্যে কাজ করে না। শেষ পর্যন্ত আমাকে বাঁচালেন আমার আব্বা, 'আমার মেয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারে না। জানলে এতোক্ষণে বলে দিতো। আপনারা দয়া করে পুলিশের কাছে যান।'

পরে জেনেছিলাম দুইদিন পর একটা হোটেলে মিথিলাকে খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। মায়ের গয়নাপত্র আর কিছু টাকা চুরি করে বাসার কাজের ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো সে। তাকে ফিরিয়ে আনা হয়, কিন্তু সে স্কুলে আসে না। তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো, নাকি অসম্মানের ভয়ে তার মাবাবাই তাকে আর এই স্কুলে পাঠাতে চান নি জানি না। তারও কিছুদিন পর জানলাম মিথিলার প্রাইভেট শিক্ষকের সহায়তায় আমার পুরোনো গ্রামের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তার মা গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যান, এবং স্কুল শেষ হওয়া পর্যন্ত গাড়িতেই বসে থাকেন।

জানি না মিথিলা এখন কোথায়, হয়তো আমার এই লেখা সে পড়বে, হয়তো সে অপরাধবোধে ভুগবে। যে মেয়ের প্রতিটা বিষয় নিয়ে সে সমালোচনা করতো, যাকে গ্রামের স্কুলের মেয়ে বলে সবসময় হেয় করতেো, যে মেয়ের গ্রামের স্কুলেই তাকে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয়েছিলো সেই মেয়েটি তার এই কলঙ্কের কথা কাউকে সেদিন তো বলেই নি, আজো গল্পটা লেখার সময় নামসহ সবধরনের আইডেন্টিফাইয়িং ডিটেলস গোপন করে গেলো। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো মিথিলা। তোমার মাবাবাকে এবং স্কুলের একজন ভোলাভালা বন্ধুকে যে বিপদে তুমি ফেলেছিলে, তেমন বিপদে যেন তোমার সন্তানরা তোমাকে না ফেলে।

 

2117 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।