অদিতি ফাল্গুনী

লেখক ও কলামিস্ট

স্পার্ম ব্যাংক : স্বাধীন নারীর সঙ্গমহীন একক মাতৃত্বের সুযোগ

‘যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে ভিখু ও পাঁচী সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল’...মাণিকের ‘প্রাগৈতিহাসিকে’র এই রোমকূপ দাঁড়িয়ে যাওয়া পংক্তিকে দারুণ ভাবে খন্ডন করেছেন ওপারের সাম্প্রতিক কালের লেখক সুবিমল মিশ্র। একটি বইয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘মাতৃগর্ভ থেকে ধারাবাহিক অন্ধকার কেউ কি সাথে করে নিয়ে আসে? কোথাও একটু ভুল হয়ে গেল নাকি মাণিক বাবু?’

গতকাল মাণিককে করা সুবিমলের এই প্রশ্ন মনে পড়ে গেলো যখন আমার ওয়ালে ভারতের এক ডাক্তার তরুণী স্পার্ম ব্যঙ্ক থেকে শুক্রাণু নেবার মাধ্যমে সিঙ্গেল মাদার হবার খবর পড়ে আশির দশকের গল্পকার (যিনি হয়তো খুব বেশি লেখেন নি- তবে ভালো লিখেছেন- সেই ‘মঘা অশ্লেষা’র লেখক) মুস্তাফা পান্না পর্যন্ত প্রশ্ন করেছেন যে স্পার্ম ব্যঙ্ক থেকে যদি প্রতারক-জুয়াচোর-খুনীর শুক্রাণু ঢোকে কোনো নারীর শরীরে? অপরাধতত্ত্বে যদিও অপরাধের পেছনে ব্যক্তির বেড়ে ওঠার সামাজিক শর্তাদিই মুখ্য, তবে বংশগতি বা জিনিওলজি হয়তো খুব সামান্যভাবে হলেও কাজ করে।

একই পরিবারে কোনো ভাই মেঘ দেখে কবিতা লেখা ভাবুক আর কোনো ভাই তুখোড় চার্টার্ড একাউন্টটেন্ট- এমনও তো’ হয়- একই পরিবেশে বড় হয়েও ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের মানুষ তো হয়। হয়তো দুই ভাই বা বোনের একজন মায়ের স্বভাব আবার একজন বাবার স্বভাব বা চেহারা পেয়েছে। কাজেই বংশগতি খানিকটা হয়তো আছে। তবু সত্যি কথা এটাই যে মাতৃগর্ভ থেকেই ধারাবাহিক অন্ধকার নিয়ে পৃথিবীতে কেউ আসে না। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তার সব সীমাবদ্ধতার পরেও পতিতাবৃত্তি-ভিক্ষাবৃত্তি-চুরির মতেো নানা বিষয় লক্ষ্যণীয় ভাবে কমে যায়।

হালের স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর কল্যাণমুখী অর্থনীতির কারণে নাস্তিক বহুল রাষ্ট্রগুলোয় জেলখানা ভরার মতো অপরাধী পাওয়া যাচ্ছে না যদিও ধর্ম-সর্বস্ব উপমহাদেশে খুন-চুরি-ঘুষ-ধর্ষণ-রাহাজানি লেগেই যে আছে- তা আমাদের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিপন্নতারই একটি ফলাফল। 

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি : স্পার্ম ব্যাংক থেকে শুক্রাণু নিয়ে মা হলে সেটা কি সমাজ-পরিবার-ধর্ম-নৈতিকতা সব রসাতলে নিয়ে যাবে? কেনো আজকের স্বাধীন নারী- ওপার বাংলার ৩৯ বছরের ডাক্তার শিউলি মুখার্জি- দিব্যি সুশ্রী ও সম্মানিত পেশাজীবী, দেখতেও বয়সের তুলনায় ঢের বেশি তরুণীদর্শনা এই মেয়েটি কেনো শুক্রাণু নিয়ে মা হলো? সে তো প্রথাগত পন্থায় বা সোজা বাংলায় প্রেম-বিয়ে করেই মা হতে পারতো! এর উত্তরটা এক কথায় বেশ কঠিন।

আমাদের মাতামহী থেকে মায়েদের প্রজন্ম পর্যন্ত একটি মেয়ের আর্থসামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য বা স্বচ্ছলতার জন্যও একটা বয়সের পর বিয়েটা খুব জরুরি বিষয় ছিলো। বাবা বা ভাইয়ের সংসার আর ক’দিন খাওয়াবে? কিন্ত বেগম রোকেয়ার ‘কন্যাগুলিকে শিক্ষিতা করিয়া ছাড়িয়া দাও। নিজের অন্ন-বস্ত্র নিজেরাই উপার্জ্জন করিয়া লউক’- কথাটি একটু একটু হলেও কতখানি যে ফলতে শুরু করেছে তা চারপাশে একবার তাকালে অসংখ্য ত্রিশ, মধ্য-ত্রিশ এমনকি চল্লিশ পার করেও সিঙ্গল নারী দেখলেই টের পাবেন। তবে? হেটেরো-সেক্স্যুয়াল নারীর জৈবিক চাহিদার কি হবে? এবার এই প্রশ্ন তুলবেন তো?

জৈবিক চাহিদার পরিমাণ কিন্ত ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তারতম্য আছে। নারীতে নারীতে তো বটেই, পুরুষে পুরুষেও জৈবিক চাহিদার তারতম্য আছে। এ সমাজে আজো বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতা ট্যাবু বলে বিয়ের জন্য অকপটে ছটফট করা তরুণী যেমন দেখেছি আবার কঠোর মধ্যবিত্ত শুচিতাবোধের ট্যাবুতে বড় হওয়া উচ্চশিক্ষিত, বয়ষ্ক নারীর বিয়ে মানে প্রায় ‘ধর্ষণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাওয়ার মতো ত্রস্ত মানসিকতাও দেখেছি। সবাইকে এবং সবকিছুকে একই ছকে তো বাঁধা যাবে না। খোদ কেট মিলেট বা সিমন দ্য ব্যুঁভোয়া অব্দি যেখানে নারীর প্রথম যৌন অভিজ্ঞতাকে ‘অপবিত্র হওয়ার বোধ, যন্ত্রণাবিদ্ধ হওয়া’ এভাবে আখ্যায়িত করেন, সেক্ষেত্রে আমাদের মতো যৌনতা বিষয়ক ট্যাবুগ্রস্থ দেশে অবিবাহিত প্রতিটি মেয়েই গোপনে সারাক্ষণ কারো না কারো সাথে ঘুমোতে চাইছে, এটা খুব সুস্থ ধারণা না!

তারপরও আজো আমাদের সমাজে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক সম্মানবোধ এবং সর্বোপরি মাতৃত্ব লাভ- ইত্যাদি নানা কারণে বিয়েকেই নারী জীবনের সর্বোচ্চ মাপকাঠি মনে করা হয়। আপনি ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা বা কল্পনা চাওলার মতো নভোচারী নাকি উম্মে কুলসুম বা লতা মঙ্গেশকরের মত শিল্পী- এসবের কিছুতেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু যায় আসে না যতক্ষণ না আপনি বিয়ে করছেন এবং মা হচ্ছেন।

এখন এই যে সো-কলড মধ্যবিত্ত পিউরিটানিটিতে আমরা যারা বড় হয়েছি, যদিও হিন্দু বা ইসলাম ধর্মে শরীর নিয়ে পাপবোধ নেই- কিন্ত ইংরেজি শিক্ষায় ঔপনিবেশিক শিক্ষালাভের সময় ভিক্টোরীয় সেই যুগের যে শুচিতাবোধ বা ব্রাম্ম ধর্মের মাধ্যমে ক্রিশ্চিয়ানিটিই যে খানিকটা পরিমার্জ্জিত হয়ে আমাদের দেহে গত প্রায় আট দশক অন্তত: ইনজেক্ট করার কাজটি সবচেয়ে সফল ভাবে একা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই করে গেছেন, তাঁর অসংখ্য কবিতা-গান-গল্প-নাটকে, তার প্রভাব থেকে মুক্তি মিলবে কিভাবে? পশ্চিম তো দেহ নিয়ে আর ট্যাবুবোধে আটকে নেই। কিন্ত আমাদের ঘাড়ে সেই ‘কর্তার ভুত’ আজো আছে।

তারপরও বিষয় আছে। এমা গোল্ডম্যানের মতো তাত্ত্বিক যিনি বিয়ের বদলে স্বাধীন ও একক মাতৃত্বের কথা বলে গেছেন বহু আগে, সেই তিনিও বলছেন যে খোদ পশ্চিমী সমাজেও তাঁর সময় অবধি, আমাদের সমাজের মতোই প্রতিটি মধ্যবিত্ত মেয়েকে দু’টো ভিন্নমুখী মন্ত্রে বড় করা হয়। একটি মন্ত্র হলো বিয়েই নারী জীবনের লক্ষ্য আর একটি মন্ত্র হলো যৌনতা ও পুরুষদেহ ভারি ঘৃণ্য, নিন্দনীয়।

তা’ পশ্চিমে এখন দু’টো বড় যুদ্ধের পর সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। কিন্ত আমাদের সমাজে? মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাসরঘরে ঢোকানো অব্দি পরিবার প্রতি মূহুর্তে ভয়ে থাকে তার ‘কুমারীত্ব’ নিয়ে আর বাসরঘরে ঢুকিয়েই বাবা-মা আশা করতে থাকে যে আগামীকাল সকালেই তারা মাতামহ-মাতামহী হবার সংবাদ পাবে। আশার বলিহারি! যে ‘কুমারী’কে ঢোকানো হলো বাসরঘরে, যৌনশিক্ষাহীন সেই মেয়েটি যে মন্ত্র-কলেমা এসব পড়ে-টড়েই একটি ‘ধর্ষণ অভিজ্ঞতা’ লাভ করতে যাচ্ছে, তা কি আমরা জানি না?

তা’ এতকিছুর পরও মেয়েরা আগে বিয়েকেই জীবনের মূলমন্ত্র জ্ঞান করতো। ভারতীয় এক নারীকবি যেমন ‘স্বামী’কে বলেছিলেন এক দল নেকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা এক ‘ক্রুদ্ধ নেকড়ে’ হিসেবে (Husband is an angry wolf, who saves you from other wolves), তেমন এক ক্রুদ্ধ নেকড়ের হাতে নিজেকে সঁপে আজীবনের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থাকেই জীবনের পরমগতি হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে আমাদের আগের প্রজন্ম অবধি। কিন্ত আমার আয় যদি হয় আমার ছেলে-বন্ধুর সমান বা বেশি? যখন কোনোভাবেই আমি তার উপর নির্ভরশীল নই? তখন বিয়ের নামে প্রতি রাতে ‘ধর্ষণ’ (যদি আমি হই টিপিক্যাল উপমহাদেশীয় যৌনশিক্ষাহীন ও ফলত: ফ্রিজিড নারী) যদি আমার মন মানতে রাজি না থাকে? কিম্বা আমি জানি প্রথম মিলনে ‘রক্তপাত’ হবে। ক্ষমা চাইছি ভাষার জন্য। তবে বই পড়ে আমি জানি যে প্রথম মিলনে ‘রক্তপাত’ হবে। আমি সেটা মানতে রাজি যদি আমার ছেলে-বন্ধু বিশ্বস্ত হয়, দায়িত্বশীল হয়- সে তার চালচুলো না-ই থাকুক! কিন্ত যখন তা-ও পাওয়া যায় না?

আগের প্রজন্মে আমাদের বাবারা মা’দের তর্জন-গর্জন করলেও বেচারীরা জানতেন যে পুরুষ হিসেবে মাসের বাজার খরচ-বাড়ি ভাড়া-গ্যাস বিল-বাচ্চার স্কুলের খরচের কঠিন ভারটা তারই ঘাড়ে। আজকের রোজগেরে নারী যখন সেসব নিজেই মিটাতে পারে, অনেক সময় সে চায় মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মানটুকু। আজকের যুবক প্রেমিকা বা বউয়ের রোজগারে খেতে আপত্তি না করলেও রোজগেরে প্রেমিকা বা বউ যখন চাকরি করতে অফিস যায়, তখন মেয়েটির সহকর্মী/বন্ধু বা পরিচিত নানাজনকে নিয়ে তার নিয়ন্ত্রণকামী প্রবণতা, সন্দেহ, মন্দ ব্যবহার, অশালীন কথা-বার্তা বলা আমাদের পিতা-পিতামহদের প্রজন্মের চেয়ে কম হয় না। আবার এত কিছুর বদলে সে যে সবসময় একগামী থাকে তা-ও না।

এবার বলুন তো- এত হ্যাপা সামলে একটি মেয়ে কেনো বিয়ে করবে? তার দায় কিসের? বিশেষত: সে যদি হয় খানিকটা শীতল বা ফ্রিজিড? যদি হয় উচ্চাকাঙ্খী? ব্যক্তি ভেদে উচ্চাকাঙ্খাও ভিন্নতর হয়। কেউ পড়া শেষ না করেই সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী হয়, কোনো নারী আবার পিএইচডি করতে চান, পাহাড়ে ট্রেকিং করতে চান বা ভরত নাট্যম নাচতে চান। সেক্ষেত্রে কি হবে?

এবার মাতৃত্বের প্রশ্ন। এত কিছুর পরও একটা বয়সের পর মানুষ নিজ বংশগতির উত্তরাধিকার চায়। মা বা বাবা হতে চায়। তবে অনেক পুরুষই ‘ভালোবাসা’র নামে যেভাবে তাদের সঙ্গীনীকে সবসময় সন্দেহ করা, অপমান করা বা ছোট করার কাজটি করে থাকেন, তাতে অনেক উচ্চশিক্ষিতা ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মেয়ের সেটা সহ্য করতে পারার কথা না। বিজ্ঞান এখানেই এনে দিলো একক, স্বাধীন মাতৃত্বের সুযোগ। চাইলে যৌন সঙ্গমহীন মাতৃত্বের সুযোগ। কুমারী মায়ের যে আখ্যান বাইবেল বা ‘মহাভারতে’র কুন্তীর কাহিনীতে আমরা পাই-আজকের বিজ্ঞান তা’ সফল করে তুলতে যাচ্ছে।

3007 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।