ধর্ষণ বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলো প্রায়শই ভুল এবং অতিকথনে ভরা। যদিও নারী শিক্ষা, নারী আন্দোলন ও এতদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের ফলে ধর্ষণ বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলামেলা কথা বলা হচ্ছে, তবে সেগুলোর বেশিরভাগটাই আবেগতাড়িত। আশার কথা হলো, ধর্ষণ বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে; গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্ষণ বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়; এমনকি আইনও পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও ধর্ষণ রয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে কম রিপোর্টিং হওয়া অপরাধের শীর্ষের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস-এর ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে মাত্র ৩৪.৮ শতাংশ ধর্ষণের রিপোর্ট হয়।১ বাংলাদেশে ধর্ষণের কোন সরকারী পরিসংখ্যন নেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেখানে ধর্ষণের সাথে ভয়াবহ ভিকটিম শেইমিং (shaming) জড়িত, সেখানে এ ধরণের অপরাধে না-হওয়া রিপোর্টের হার আরো অনেক বেশি।সরকারী পরিসংখ্যন না থাকলেও কোন কোন এনজিও বা আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে সংঘটিত যৌন অপরাধের ওপর কিছু জরিপ করে থাকে। জাতিসংঘের Multi-country Study on Men and Violence এর ২০১৩ সালে প্রকাশিত যৌন অপরাধ পরিসংখ্যন অনুযায়ী বাংলাদেশী যৌন অপরাধীদের ৪৭.৪% পুরুষ একবারের বেশি ধর্ষণ করেছে এবং ৬১.২% মনেই করে না যে তারা অপরাধ করেছে। ৮৯% অপরাধী মনে করে নারী যদি ধর্ষণের সময়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা (fight back) না করে, তবে তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত না।২ এই পরিসংখ্যন আমাদেরকে যে ভয়াবহ চিত্র দেয়, তাতে মনে হয় আমরা যেন একটি ধর্ষণপ্রিয় জাতিতে পরিণত হয়েছি।
ধর্ষণের কারণ ও ধর্ষকের মনঃস্তত্ব বিষয়ে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা-চেতনা এখনও কিছু বাঁধাধরা (stereotyped) ধারণায়ই সীমাবদ্ধ। এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী ধর্ষকের আচরণজনিত গবেষণার অপ্রাচুর্যতা। উন্নত বিশ্বে এ বিষয়ে কিছু গবেষণা হলেও তা ছিল অসম্পূর্ণ, কারণ গবেষকরা কেবল সেই সব অপরাধীর কাছেই পৌঁছাতে পারতেন যারা বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেইল মালামুথ (Neil Malamuth) এ বিষয়ে বলেন, “যাদের সাজা হয়েছে, তারা আসলে ‘জেনারেলিস্ট’। যারা অপরাধ করেও পার পেয়ে গিয়েছে, তারা এ বিষয়ে ‘স্পেশালিস্ট’।“ সম্প্রতি দু’একটি গবেষণায় গবেষকরা বেনামী সার্ভের মাধ্যমে এসব ‘স্পেশালিস্টদের’ কাছে পৌঁছেছেন এবং তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েছেন।
পশ্চিমা বিশ্বের সমাজ ও সমাজব্যবস্থার সাথে আমাদের সমাজের রয়েছে বিস্তর পার্থক্য, তাই সেখানকার অপরাধ-প্যাটার্ন ও অপরাধী-মনস্তত্ব আমাদের সাথে খুব কমই মিলবে। কিন্তু তাদের গবেষণার অনেকাংশ সব সমাজের ও সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ধর্ষণ সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা, অপরাধীর মনস্তত্ব বিষয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট।
ধর্ষণ কী?
একজন পুরুষ একজন নারীর যৌনতায় তিন ভাবে অভিগমন লাভ করতে পারেঃ সম্মতি, চাপ প্রয়োগ ও শক্তি প্রয়োগ। সম্মতিসূচক যৌনতায় উভয়ে আলোচনার মাধ্যমে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করে থাকে। চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যিনি চাপ প্রয়োগ করছেন তিনি অনিচ্ছুক ব্যক্তির অসহায়ত্ব বা অরক্ষিত অবস্থাকে কাজে লাগান—এ ক্ষেত্রে যাকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে যৌনকার্যে তার অসম্মতি সামাজিক, আর্থিক বা পেশাগত গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে। শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভিকটিম-এর রাজী হওয়ার প্রশ্ন নেই, রয়েছে তার শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা, এমনকি জীবননাশের হুমকিও।
ধর্ষনের সংজ্ঞা-সূচক হল অসম্মতি। অসম্মতিসূচক যৌনমিলন – সে চাপ প্রয়োগে হোক আর শক্তি প্রয়োগেই হোক, ভিকটিম-এর শারীরিক ক্ষতি হোক বা না হোক, যার অসম্মতিতে যৌনকার্য করা হচ্ছে সে বিবাহিত স্ত্রী হোক কী অন্য কোন নারী হোক – শারীরিক আক্রমন (physical assault) বলে বিবেচিত এবং তা ধর্ষণ।
ধর্ষণের আইনি সংজ্ঞা স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, শিশুদের সাথে সম্মতিসূচক যৌনতা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হলেও সম্মতির বয়সসীমা একেক দেশে একেকরকম। বাংলাদেশে এটা ১৬; ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ১৪-১৬ হলেও কিছু দেশে ১৮। কোন কোন দেশের আইনে সঙ্গীর বয়স যা-ই হোক এবং সম্মতিও থাকা সত্ত্বেও তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে যদি ভিকটিম অপরাধীর জিম্মায় থাকে। যেমন, বাবা-মা, আত্মীয়, পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, চাকুরীদাতা, ইত্যাদি। আবার অসচেতন, ঘুমন্ত, শারীরিকভাবে অক্ষম বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির সাথে যৌন কার্যও ধর্ষণ বলে বিবেচিত।
ধর্ষণঃ একটি ছদ্মযৌন কর্ম (Pseudosexual act)
ধর্ষক সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের একটি সাধারণ ধারণা যে ধর্ষক একজন কামুক পুরুষ যে ভিকটিমের উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি বা সাজ-পোশাকে উত্তেজিত হয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে থাকে, অথবা সে একজন হতাশ পুরুষ ধর্ষণের মাধ্যমে যার অবদমিত কাম প্রকাশিত হয়, অথবা সে একজন বিকৃত মানসিকতার (perverted) কামোন্মত্ত পুরুষ যে স্বাভাবিক যৌনতায় সন্তুষ্ট নয়। উপরোক্ত সবগুলো দৃষ্টিভঙ্গিতেই ধর্ষকের আচরণ সম্পর্কে যে সাধারণ ভুলটি করা হয় তা হল- ধর্ষক ‘যৌনতাড়িত’ হয়ে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের মাধ্যমে সে তার ‘যৌন চাহিদা’ পূরণ করে। কিন্তু ধর্ষণ সম্পর্কিত ক্লিনিক্যাল স্টাডি বলে যে, ধর্ষণের সাথে আর যা-ই থাকুক, যৌনতা তার প্রাথমিক বা প্রধান লক্ষ্য নয়। ধর্ষণ হলো শক্তি ও ক্রোধের যৌন বহিঃপ্রকাশ।
জবরদস্তিমূলক যৌনকার্যের প্ররোচনা কোনভাবেই যৌন চাহিদা থেকে আসে না, এটা আসে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা থেকে। ধর্ষণকে যৌনকামনার প্রকাশ হিসেবে দেখা কেবল অসঠিকই নয়, এটা এক প্রকার প্রতারণাও, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের দায় ধর্ষিতার ওপরে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা হয়।ধর্ষণের সাথে যে যৌনতার প্রাথমিক কোন সম্পর্ক নেই, সেটা আরো স্পষ্ট হয় ভিকটিমকে শারীরিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা কিংবা হত্যা থেকে। অনেকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের আলোকে ধর্ষণের সাথে যৌনতার সম্পর্ক খুঁজে পান, কারণ এর মাধ্যমে পুরুষটি পরবর্তী প্রজন্মে তার জিন রেখে যেতে পারে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন ঐ প্রজাতির স্ত্রী প্রাণীটি ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়। যেসব প্রাণীর পুরুষগুলো এভাবে পরবর্তী প্রজন্মে তার জিনের প্রবাহ রাখতে চায়, তারা কেবল মাত্র তখনই স্ত্রী প্রাণীটির সাথে মিলিত হয় বা ধর্ষণ করে যখন স্ত্রী প্রাণীটি প্রজননের জন্য একেবারেই তৈরি এবং তাদের যৌনমিলন স্ত্রীটিকে গর্ভবর্তী করবে। এখানে যে বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত তা হলো, ঐ প্রাণীগুলো স্ত্রী প্রাণীটিকে মেরে ফেলে না, বা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে না। পুরুষটির এই বিবেচনাবোধ থাকে যে, স্ত্রী প্রাণীটি তার সন্তানকে ধারণ করতে যাচ্ছে। মানুষ প্রজাতির পুরুষটির চিন্তায় আদৌ সেরকম কিছু থাকে না বলেই সে যার সাথে যৌনকর্ম করেছে, তাকে ক্ষত-বিক্ষত কিংবা হত্যা করতেও পিছপা হয় না। দ্বিতীয়ত, পশু প্রজাতির পুরুষটির মতো মানুষ প্রজাতির পুরুষটি জানে না যে, নারীটি তার ঋতুচক্রের পরিক্রমায় তখনই সন্তান ধারণ করতে সক্ষম কিনা। তৃতীয়ত, সভ্যতা মানুষকে আজ এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, ধর্ষণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে জিন-প্রবাহের সম্ভাব্যতা প্রায় শূন্য। যুদ্ধকালীন ধর্ষণ এবং বিশেষ দু’একটি জরুরী অবস্থা ছাড়া কোন নারী ধর্ষণে গর্ভবতী হলে, গর্ভপাতের মাধ্যমে তিনি অথবা তাঁর পরিবার ভ্রুণটিকে নষ্ট করে দিবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ধর্ষণ যৌন উত্তেজনার ফল এবং যার ভিত্তি হতাশা অথবা অবদমিত কাম – এই জনপ্রিয় কিন্তু ভুল বিশ্বাস ধর্ষণ, ধর্ষক এবং ভিকটিম – এই সম্পর্কিত সকল বিষয়গুলোতেই ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে এবং তা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
ভিকটিম সম্পর্কিত ভুল ধারণা ও ভিকটিম দোষারোপ (Misconceptions and Victim Blaming)
ধর্ষণ সম্পর্কে সবচয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা হলো ভিকটিমের ধর্ষককে প্ররোচিত করা। ভাবটা এমন যে, নারীটি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তার অঙ্গভঙ্গি বা এরকম কিছুর মাধ্যমে পুরুষটির যৌনতাকে জাগিয়ে তুলেছিল বলেই পুরুষটি ধর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছে।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রলোভন (seduction) বা প্ররোচনা (provocation) খুবই হাস্যকর, কারণ ধর্ষকের শিকারের তালিকায় কেবল নারী থাকে না, থাকে বালক এবং শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের নারী। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে যে সকল শিশু ধর্ষণের খবর এসেছে, তাদের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল বালক। আর সর্বনিম্ন বালিকাটির বয়স ছিল দেড় বছর। শিশু ধর্ষনের খবর আজকাল এতোই নিয়মিত যে, এগুলো এখন আর মানুষের নজর কাড়ে না। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আলোচিত নান ধর্ষণ কেসটি উল্লেখ করার দাবি রাখে। রানাঘাটের সেই হতভাগ্য নানের বয়স ছিল ৭২ বছর। একটি দেড় বছরের শিশু কিংবা একজন ৭২ বছরের বৃদ্ধাকে দেখে কোন পুরুষ যৌন উত্তেজনা লাভ করতে পারে, এটা কেবল একজন উন্মাদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব।
পশ্চিমা বা শহুরে সভ্যতায় এরকম দু’একটা কেস হতে পারে যে, নারীটি সত্যিই প্রলোভনমূলক (seductive) আচরণ করেছিলো। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ভিকটিমকে দোষারোপ করার কোন জায়গা নেই। নারীটি যদি প্রলোভনমূলক আচরণ করেও থাকে, এমনকি পুরুষটিকে যৌনকার্যে আহ্বানও করে থাকে, তবুও যে কোন মুহূর্তে তার ‘না’ বলার অধিকার রয়েছে এবং তার ‘না’-কে অগ্রাহ্য করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারীদের পোশাককেও ধর্ষনের জন্য দায়ী করা হয়। বাংলাদেশে যারা পোশাকের নামে ধর্ষণের দায় ভিকটিমের ওপর চাপাতে চায়, তারা ইদানিং এক নতুন এজেন্ডা নিয়ে এসেছে—বোরকা/হিজাব পরলে নারীটি ধর্ষণের শিকার হতো না। নব্য ধর্মান্ধ এইসব পুরুষেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা জানে না মাত্র পনের বছর পূর্বেও বাংলাদেশের শহরগুলোর রাস্তায় কালে-ভদ্রে দু’একটা বোরকার দেখা মিলতো, আর হিজাব বলতে যে কিছু আছে তা বাংলাদেশের মানুষ জানতোই না। তখন পত্রিকার পাতায় আমরা এতোটা ধর্ষণের খবর দেখতাম না। শিশু ধর্ষণ, বালক ধর্ষণ বলতে কিছু আছে, তা মানুষ জানতোই না। যারা ধর্ষণের জন্য পোশাকের দোহাই দেয়, তাদেরকে তাহলে বলতে হয় যে, ধর্ষণের জন্য হিজাব/বোরকাই দায়ী। আমি তা বলতে চাই না, কারণ সেটা যেমন সত্য নয়, তারা যেটা বলে সেটাও সত্য নয়।সম্প্রতি চ্যানেল ২৪-এর একটি অনুষ্ঠানে নারীদের পোশাক নিয়ে টেলিভিশন তারকা মোশাররফ করিম বেশ স্পষ্ট কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “একটা মেয়ে তার পছন্দমতো পোশাক পরবে না? পোশাক পরলেই যদি সমস্যা হয়, তাহলে ওই সাত বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে কী যুক্তি দেব আমরা? যিনি বোরকা পরেছিলেন তার ক্ষেত্রেই বা কী যুক্তি দেব? আপনার মনের মধ্যেই সাপ, সেই সাপকে থামান না!“ দুর্ভাগ্যের বিষয়, মোশাররফ করিমকে এই সাধারণ সত্য বাক্যগুলোর জন্যও ক্ষমা চাইতে হয়েছে।
মোশাররফ করিম ঠিকই বলেছেন- ধর্ষণের জন্য দায়ী ‘মনের মধ্যে থাকা সাপ’। তবে সেই সাপটা কী, সে সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমাদের প্রচলিত ধারণা হলো ঐ ‘সাপ’টা যৌনতা। কিন্তু সত্যিকারার্থে ধর্ষণ আদৌ যৌনতার প্রকাশ নয়। ধর্ষণের মাধ্যমে ধর্ষক যৌনতৃপ্তি পায় না, কারণ যৌনতৃপ্তির জন্য দুজন সঙ্গিরই সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যা অকল্পনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের এক পরিসংখ্যনে দেখা গেছে, ধর্ষণজনিত অপরাধীদের তিন ভাগের এক ভাগ বিবাহিত এবং যৌনসক্রিয়। বাকিদের অধিকাংশই অপরাধকালীন সময়ে কোন না কোন যৌন সম্পর্কে জড়িত। যেখানে পুরুষটি চাইলেই সঙ্গীর সাথে সম্মতিসূচক ও অংশগ্রহণমূলক যৌনতায় অংশগ্রহণ করতে পারছে, সেখানে জোরপূর্বক যৌনতা যে আদৌ যৌনতৃপ্তির লক্ষ্যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্ষণের মাধ্যমে ধর্ষক পায় এক প্রকারের শান্তি- শক্তি প্রদর্শনের বিকৃত শান্তি, যার বীজ লুকিয়ে আছে ধর্ষকের অশিক্ষায় অথবা তার বিকৃত মস্তিষ্কে।
আরেকটি উদ্ভট অথচ জনপ্রিয় কথা প্রায়শই শোনা যায়, ‘খোলা পাত্রে মিষ্টি রাখলে মাছি বসবেই’। নারী কোন দ্রব্য নয়; নারী একজন মানুষ। যে পুরুষটি এমন কথা বলছে, তার মাকেও কি সে দ্রব্য মনে করছে? তাঁকেও কি সে মিষ্টি মনে করছে? তার মায়ের শরীরের মিষ্টত্বও কি তার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে? নারী মিষ্টি না হলেও যে পুরুষ এমন তুলনা দিচ্ছে, সে সত্যিই মাছি। অত্যন্ত তার মস্তিষ্কের চিন্তা-ক্ষমতা মাছির মতোই ক্ষুদ্র। হয় তার মস্তিষ্ক বিকশিত হয়নি, অথবা তা এমন বিকৃত যে এর বাইরে সে চিন্তা করতে পারছে না।
হ্যাঁ, যারা ধর্ষণের জন্য নারীর সাজ-পোশাক, অঙ্গভঙ্গি বা চলাফেরাকে দায়ী করেন, তারাও ধর্ষকের মতোই অশিক্ষিত এবং বিকৃত-মস্তিষ্ক। তারাও তাদের অভ্যন্তরে ধর্ষকের মতোই ‘সাপ’ বহন করে চলেন এবং সুযোগ পেলে তারাও ছোবল মারবেন। আমরা পরবর্তীতে দেখবো যে, মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, সত্যিকারার্থেই প্রতিটি ধর্ষক এক প্রকার মানসিক অস্বাভাবিকতা (mental dysfunction) নিয়ে চলে। যারা ধর্ষণের জন্য নারীকে দোষারোপ করে, ধর্ষকদের সাথে তাদেরও মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন, কারণ তারা প্রত্যেকেই একেকজন সম্ভাব্য ধর্ষক (sexually dangerous person).
অনেকে এটা মনে করেন যে, নারীরা যদি সত্যিই চায়, তাহলে ধর্ষিত হওয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। যারা এমনটা বলেন, তারা এটা ভেবে দেখেন না যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণ করা হয় অস্ত্রের মুখে ভীতি প্রদর্শন করে, শারীরিক ক্ষতির হুমকি দিয়ে অথবা দানবিক শক্তি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করতে চাওয়া তাকে আরো আক্রমনাত্মক করতে তুলতে পারে। ভিকটিমের প্রতিরোধ হয় তো দু’একজনকে ফিরাতে পারে, কিন্তু বিপরীতটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তার চিৎকারে একজন হয় তো পালাবে, কিন্তু অন্যজন যে তার গলায় ছুরি বসাবে না এমন নিশ্চয়তা নেই।কলঙ্ক বা ভিকটিম শেমিং (Victim Shaming)
যৌন অপরাধের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো ধর্ষন-পরবর্তী কলঙ্ক বা শেমিং-এর ভয়। ধর্ষণের পরে ভিকটিম এক ভয়ংকর শারীরিক ও মানসিক আঘাত (trauma) পান। তাঁর এই ট্রমা আরো বাড়িয়ে দেয় শেমিং-এর ভয়। ভিকটিমের জন্য যখন প্রয়োজন সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, তখন মানুষ কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে তাঁর কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ভিকটিম শেমিং কেবল বাইরের মানুষদের থেকে আসে না, নিজ পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনও এতে সমানতালে অংশগ্রহণ করে। ভিকটিম যদি বিবাহিত হন কিংবা বাগদত্তা হন, তবে ভয় থাকে স্বামী কর্তৃক পরিত্যাগ বা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার। আর অবিবাহিত হলে অনিশ্চিৎ হয়ে পড়ে ভবিষ্যতে ভাল কোথাও বিয়ে হওয়া। এবং ভিকটিম যদি পারিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয়দের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হন, তবে শেমিং-এর ভয়ে মুখ খুলতেই সাহস পান না।
যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়াদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থার নাম Laura’s House. লরা’স হাউজের সিইও ও নির্বাহী পরিচালক মার্গারেট বেস্টন (Margaret Bayston) বলেন, “ভিকটিম শেমিং এর একমাত্র কারণ অজ্ঞতা। আর এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, ভিকটিম মনে করে যে, কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। তাই সে কাউকে জানায় না। আর পরবর্তীতে এই না-জানানোর জন্যও তাকে দোষ দেয়া হয়।“৩
ভিকটিম শেমিং-এ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘পতিতা বা বেশ্যা’—নারীটি পতিতার মতো আচরণ করেছেন বলেই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। পতিতা-কলঙ্কের ভয়ে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ঘটা অধিকাংশ যৌন অপরাধই অপ্রকাশিত থেকে যায়। ধর্ষনের অপরাধীরা ঠিক এই সুযোগটাই নেয় এবং তাদের অপকর্ম চালিয়ে যায়। বেশিরভাগ অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় নিতে না পারার কারণও এটি। আর যে সকল ঘটনা প্রকাশিত হয়ে যায়, কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে তাদের মধ্যে অনেকই বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
ভিকটিম শেমিং-এর ভয়াবহ রূপ দেখা যায় আদালতেও। বিপক্ষ উকিলের প্রচেষ্টা থাকে নারীটিকে ‘দুশ্চরিত্রা’ প্রমাণ করানোর, যেন ভিকটিমকে বহুগামী প্রমাণ করতে পারলেই অপরাধীটি ধর্ষণের অপরাধ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। ধর্ষণ বিষয়ক বাস্তবতা এমন নয়। নারীটি বহুগামী হোক কী পতিতা হোক, তাতে ধর্ষকের অপরাধ একটুও কমে না, কারণ পতিতারাও ধর্ষণের শিকার হন।