জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

সনা রুম আপডেট

জিমের স্টিম রুমে অজস্র ছোট ছোট বিনুনির ঝাঁকড়া মাথার কালো লোকটি উঁচু গলায় বক্তৃতা দিয়ে চলেছে, শ্রোতা একজন সাদা লোক। সাদারা কত অভদ্র, কত অমানবিক, কত পাশবিক, কীভাবে তারা পুরো পৃথিবীকে শোষণ করেছে সেকথাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে কালো লোকটি। অন্যজন শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে, প্রতিবাদ করছে না মোটেই। কানে তালা লেগে যাচ্ছে, স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করলাম কিন্তু কালো লোকটার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। সে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্রে আগেই জেনেছি এই লোকটা ধর্ষনের আসামি, বাদী শেষ পর্যন্ত মামলা উঠিয়ে নেয়ায় তাকে জেলে যেতে হয়নি। আমাকেও সে একদিন বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলো, নারীবাদীরা চরিত্রহীন এই মর্মে। জিমে যাই রিলাক্স করতে, এসব বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা শুনতে বা করতে নয়। বেরিয়ে এলাম।

সনা রুমে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানে একজন বিশাল সাইজের কম বয়েসি ছেলে বক্তৃতা দিচ্ছে একজন শুকনা টিংটিঙ্গে লোককে। এক্সেন্ট শুনেই বোঝা যাচ্ছে ইস্ট ইউরোপিয়ান ইমিগ্রেন্ট- 'যত ইচ্ছে খাবা, কোনো চিন্তা করবা না। আমি দিনে সাতবার খাই। শুধু চিনিটা খাবা না তাইলেই ওজন কমবে।' শুকনা লোকটা, যাকে ইংরেজ বলেই মনে হলো, মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে, 'অবশ্যই, সন্দেহাতীত ভাবে সত্য। তোমার কথা একশ' ভাগ সঠিক'।

এখন আমি যাই কোথায়? আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ ডেক চেয়ারে শুয়ে কানটা হালকা করে নেই। এমন সময় এসে ঢুকল মেয়েটি। আগেও তাকে দেখেছি- আমার মতোই বয়স কিন্তু টানটান মেদহীন নিখুঁত শরীর। একে বরাবর ঈর্ষা করে এসেছি, কেমনে পারে সৌন্দর্য আর স্বাস্থ্য দুটোকেই এভাবে ধরে রাখতে? কিন্তু আজ যেন মেয়েটার মুখটা খুব মলিন মনে হচ্ছে, সাথে তার হ্যান্ডসাম সঙ্গীটিও নেই।

একটু পরে আবার সনায় গিয়ে ঢুকলাম, মেয়েটাও এসে ঢুকলো পেছন পেছন। সনা রুমের কাঠের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে বসে পড়লো। তার পাশের মেয়েটা ফিসফিস করে বললো, 'কিছু মনে করো না, তুমি ঠিক আছ? আমি মিন, সেদিন সনার ভেতরেই দেখলাম ঝগড়া করছো তোমরা'।

উত্তরে মেয়েটা উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো, 'আমি তার সাথে ব্রেক আপ করেছি। পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি তাকে।' তারপর নিজের হাত উঠিয়ে দেখালো অনেকগুলো কালশিটে দাগ, গলার কাছে হালকা আঙ্গুলের ছাপ। 'হি ওয়াজ গোয়িং টু কিল মি। বাট নট এনি মোর। আয়ভ গট এন ইঞ্জাংকশন। হি কান্ট কাম নিয়ার মি এনি মোর।'

মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই মেয়েটিকে দেখেছি তার সঙ্গীর হাত ধরে সনা রুমে বসে থাকতে, আর আজ শুনলাম এই ঘটনা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমার বিশ্বাস হয়, আমি এসব ঘটনা অনেক দেখেছি। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বিষয়টাই এরকম। তাসের ঘরটা ভেঙ্গে না পড়া পর্যন্ত নির্যাতক এবং নির্যাতিত উভয়েই একটা অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় সব ঠিকঠাক, কিন্তু ভেতরে চিচিং ফাঁক।

যেহেতু সে নিজেই উচ্চকন্ঠে কথা বলছিলো, আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
'তুমি ভিকটিম সাপোর্টের সাথে কথা বলেছ?' 
'সেটা আবার কী?' 
'তারা তোমাকে নানান রকম সাহায্য দেবে। পুলিশেরই তো তোমাকে তাদের কাছে পাঠানোর কথা।' 
'জানি না। আমি এসব কিছু চাই না। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু বি ফ্রি।'

আমি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভিকটিম অনেক বাঙ্গালি মহিলাকে দেখেছি, বিদেশিনী একজনকে এই প্রথম দেখলাম। কিন্তু এই মেয়ের মধ্যে আমাদের বাঙ্গালি মহিলাদের মতো অসহায় সর্বহারা ভাবটা নেই। গায়ে কালশিটে দাগ নিয়ে সে সনায় রিলাক্স করতে এসেছে, নির্দ্বিধায় নিজের সমস্যার কথা খোলামেলা আলোচনাও করছে। বাঙ্গালি কোনো মহিলা স্বামীর হাতে মার খেয়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে সনায় রিলাক্স করতে আসবে? সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠার সম্ভাবনা তার চেয়ে বেশি।

 

2247 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।