পুষ্পিতা মন্ডল

বর্তমানে প্রবাসী পুষ্পিতা বাংলাদেশ সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন।

সবার কাছে সহজলভ্য হোক স্যানিটারী ন্যাপকিন

সেদিন অক্ষয়কুমার অভিনীত প্যাডম্যান মুভিটা দেখলাম। আমি এমনিতেই ইমোশনাল খুব। মুভি-নাটক এসব দেখে খুব কাঁদি। কিন্তু এই মুভি দেখে আমি আকুল হয়ে কেঁদেছি। আবার একই সাথে হেসেছিও। কেন কেঁদেছি তার সঠিক ব্যাখ্যা আমি দিতে পারবো না। এই মুভি পুরোটাই মেয়েদের মুভি। মেয়েদের জীবনের গল্প।

মুভির কাহিনী ভারতের তামিলনাড়ুতে ১৯৬২ সালে জন্ম নেয়া অরুনাচালাম মুরুগানান্থামকে নিয়ে। এই মানুষটা পুরুষ হয়েও কিভাবে মেয়েদের জীবনের গল্পে ঢুকে গেলেন তাই এই সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। বিয়ের পর নিজের স্ত্রীকে পিরিয়ডের সময় ময়লা কাপড় ব্যবহার করতে দেখে যিনি প্রথমবার মেয়েদের প্যাড ব্যবহার করার তাগিদ আর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।

কিভাবে স্বল্প খরচে স্যানিটারী ন্যাপকিন তৈরী করা যায় এটা তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেছিলো। যার জন্য তিনি নিজে পুরুষ হয়ে প্যাড ব্যবহার করেও দেখেছেন। পরবর্তীতে যিনি স্বল্প খরচে স্যানিটারী ন্যাপকিন তৈরি করার মেশিন আবিষ্কার করেন এবং সেটার পেটেন্টও নেন। যা বিক্রি করে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারতেন তা না করে তিনি সেই মেশিন তৈরি করে স্বল্পমূল্যে মহিলাদের মাঝে বিক্রি করছেন যাতে শুধু ওনার স্ত্রী বা বোনেরা নন, সকল দরিদ্র মেয়েরা স্বল্পমূল্যে প্যাড কিনে ব্যবহার করতে পারেন।

এই লোকটাকে কিভাবে শ্রদ্ধা জানাবো, সম্মান করবো আমি জানি না। পিরিয়ড প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের একটা সাধারন শারীরবৃত্তিয় ঘটনা। প্রত্যেক মেয়েই মাসে একবার করে এই দিনগুলোর ভিতর দিয়ে যায়। নানা রকম শারীরিক সমস্যা, মুড সুইং এগুলোতো আছেই। কারো কারো কাছে পিরিয়ড মানেই ভয়ংকর শারিরীক যন্ত্রণা। আর তার সাথেতো আছে পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু। যেটা আলাদা একটা মানসিক যন্ত্রনা তৈরি করে। সেখানে কয়টা পুরুষ মানুষ আছে যারা নিজেদের পরিবারের মহিলা সদস্য বা সঙ্গিনীর এই বিষয়টা নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাবেন? তার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই লোকটা কেবল ভেবেছেন তাই না, তা সমাধানের জন্য নিজের সর্বোচ্চটা করেছেন।

স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার না করলে কি কি শারিরীক সমস্যা হতে পারে সেটা কতো ভাগ নারী জানেন বা তা নিয়ে ভাবেন? ভারতে নাকি প্যাড ব্যবহার করা মেয়ের সংখ্যা ১২ পার্সেন্ট। বাংলাদেশে কতো? স্যানীটারী ন্যাপকিন ব্যবহার না করা সংক্রান্ত সমস্যায় আমাকে কখনও পড়তে হয় নি। কিন্তু আমি জানি এই সংখ্যাটা কতো কম। যখন গ্রামের স্কুলে পড়তাম একটা বা দুটো মেয়েই প্যাড ব্যবহার করতো। মনে হয় না সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে। খালি উচ্চমূল্য এরজন্য দায়ী তা সবসময় না। কাপড়ে তো চলছে, চলুক। কি দরকার অযথা খরচের এমন ভাবা লোকের সংখ্যা কম নয়। পরিবারের মেয়ের এমন একটা ফালতু বিষয়ে টাকা খরচ করতে চান না অনেকেই। এমনকি অনেক মাও মেয়ের এই প্রয়োজনটাকে অনর্থক খরচ মনে করেন।

আর পিরিয়ডকে ট্যাবু বানিয়ে অনর্থক যে ভোগান্তিগুলো মেয়েদের দেওয়া হয় তাতো আছেই। মেয়েরা নাকি অপবিত্র হয়ে যায় এসময়। সবগুলো ধর্মে মেয়েদের এসময়টায় ধর্মীয় আচার থেকে দূরে রাখা হয়েছে। অথচ এই পিরিয়ড হয় বলেই মেয়েরা মা হয়। সেই সময়টা কি করে অপবিত্র সময় হয় আমি জানি না।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ীতে এক সহকারী ছিলেন। আমি ওনাকে বৌদি বলতাম। তা দেখতাম উনি মাঝে মাঝে পূজার ঘরে যেতেন না। আমি তারে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি পূজার ঘরে যাও না কেনো? পিরিয়ড কি তা বোঝার বয়স আমার তখনও হয় নি। উনি উত্তর দিয়েছিলেন- বুনডি আমি এখন পঁচে গেছি। পঁচে যাওয়া শব্দটা আমার ভালো করেই মনে আছে। কারণ এরপর অনেকেই আমাকে এই কথা বলে প্রশ্নের উত্তর দিতো। আমি নিজেও অন্য কোনো মহিলা পূজা না দিলে বা রান্না ঘরে না গেলে বলতাম –“তুমি কি পঁচে গেছো?” মানুষ মরে গেলে পঁচে কিন্তু সেই ছোটবেলায় জেনেছিলাম মেয়েরাও পঁচে।

আর একটা জিনিস আমার খুব চোখে পড়ত। ওই সময় দেখতাম মহিলারা সিঁদুর পরতো না। কি অদ্ভুত বিষয়। যে মহিলারা রোজ বড় করে সিঁথিতে কপালে সিঁদুর দেয় তারা খালি কপালে ঘুরতো। কারণ সিঁদুর পবিত্র জিনিস। তা অপবিত্র শরীরে ছোঁয়াতে হয় না। এই নিয়মগুলো মনে হয় এখন একটু শিথিল হয়েছে। তবে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করতে হবে তা মনে হয় আজও আছে।

এই পিরিয়ড সংক্রান্ত ট্যাবুর কারনে অপ্রস্তুত হয় নি এমন মেয়ে মনে হয় নাই। যা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা বিষয় তারে আমরা কি জটিল করে রেখেছি। সহযোগিতা সহমর্মিতাতো নেই উল্টে হাসাহাসি করি। কতোজন ভাবি এই সময়গুলো মেয়েরা কিভাবে পার করে। এতোগুলো বছর ধরে!

যাইহোক ট্যাবু বা এসব নিয়ম ভাঙতেতো হবে তবে সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি তা হলো শতভাগ স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার নিশ্চিত করা। ওই বিভীষিকাময় দিনগুলো যেন আরো বিভীষিকাময় না হয়। মাত্র পিরিয়ড শুরু হলো যে মেয়েটার, যে বোন ইটের ভাটা বা মাঠে কাজ করে, অথবা অতি দরিদ্র মেয়েটা, সাধারন গৃহবধূ সবার কাছে সহজলভ্য হোক স্যানিটারী ন্যাপকিন। অস্বাস্থ্যকর পুরানো ময়লা কাপড় বা অন্য কিছু ব্যবহার করতে যেন না হয়। অরুনাচালামের মতো করে ভাবার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। পিরিয়ডকে কোনো লজ্জার বিষয় না ভেবে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখুক অন্তত মেয়েগুলো। নিজেদের প্রয়োজন, সুস্বাস্থ্য, শরীর নিয়ে নিজেরা সচেতন হোক। হ্যাপী ব্লিডিং গার্লস ..... 

1955 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।