ড. সীনা আক্তার

সমাজবিদ এবং প্যারেন্টিং পেশাজীবি

স্তন ক্যান্সার এবং নারী দেহে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব

স্তন ক্যান্সার এক মরনব্যাধি এবং নারীরাই মূলত এর শিকার হয়। ইদানিং পরিচিত কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা মারা গেছেন, অথচ গত দুই দশক আগেও আমাদের দেশে স্তন ক্যান্সারের বিস্তার এমন ভয়াবহ ছিলো না। সময়মতো সঠিক চিকিৎসায় অনেকে টিকে থাকেন বটে কিন্তু এই ব্যাধি রোগী এবং তার স্বজনদের শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যন্ত ও সর্বসান্ত করে দেয়। সারা বিশ্বেই এই ঘাতক রোগের বিস্তার ঘটেছে কিন্তু উন্নত দেশে সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবায় স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। সে তুলনায় আমাদের দেশে নারীদের অবস্থা দুর্ভাগ্যজনক;  সঠিক তথ্য, সময়মতো সুলভে চিকিৎসা, আর্থিক এবং মানসিক সহযোগিতা সবকিছুর অভাবে অধিকাংশ নারীই তীব্র অসহায় বোধ করেন। বলা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পরলে সম্পূর্ণ সুস্থতার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ রোগের আগমন সম্পর্কে নারীদের সচেতন থাকাটা জরুরি। তবে সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যে সব কারণে ক্যান্সার হতে পারে তা থেকে নিরাপদ দূরে থাকা।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না স্তন ক্যান্সার ঠিক কি কারণে হয়, কিন্তু তাঁরা এর জন্য দায়ী কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। যেমন: ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র মধ্যে এ রোগের ইতিহাস, স্থুলতা, ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রতিস্থাপন (Hormone Replacement Therapy) থেরাপি, অধিক বয়স বিশেষ করে ৫০ উর্ধ্ব বয়স, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং এক্স-রে ও সিটি স্ক্যানের রেডিয়েশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী অনুষদের অধ্যাপক, ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ এর এক লেখায় আরো জানা যায় যে, ''যেসব মহিলার স্বাভাবিক সময়ের আগে এবং স্বাভাবিক সময়ের পর ঋতুস্রাব শুরু ও বন্ধ হয়, তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ তাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন (Estrogen) অনেক বেশি সময় ধরে সক্রিয় থাকে। ইস্ট্রোজেন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থূল মহিলারা স্বাভাবিক ওজনের মহিলাদের চেয়ে স্তন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়। স্থূল মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন বেশি থাকে বলে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেশি।'' ইস্ট্রোজেন (Estrogen/ oestrogen) হচ্ছে নারীর সেক্স হরমোন (female sex hormones)। এই ইস্ট্রোজেন হচ্ছে হরমোন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মূল উপাদান। হরমোন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো যেমন: জন্ম বিরতিকরণ খাবার বড়ি (Oral contraceptives), ইনজেকশান (Contraceptive injections ), প্যাচ (Contraceptive Patch),  ভার্জিনাল রিং (Vaginal Ring/NuvaRing) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ইস্ট্রোজেন (oestrogen) এবং প্রজেস্টোজেন (progestogen) নামক দুই ধরনের হরমোন মেশানো গর্ভনিরোধক খাবার বড়িতে (The combined oral contraceptive pill-COCP) থাকা ইস্ট্রোজেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষগুলোকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেনের জন্য সম্ভাব্য স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা অনেক নারীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। এ ছাড়াও, ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৫৪টি সমীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টোজেন মেশানো জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণকারীরা যারা ১০ বছরের মধ্যে বড়ি গ্রহণ বন্ধ করেছেন তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ''সামান্য উচ্চ ঝুঁকি'' দেখা গেছে। এই কারণে উন্নত দেশে যে সব নারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণে অনুমোদন করা হয় না, অন্য কোনো পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। শুধুমাত্র প্রজেস্টোজেন উপাদানে তৈরি বড়িও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় কিন্তু তা তুলনামূলকভাবে কম।

প্রতি বছর অক্টোবর মাসে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচী পালন করা হয়। এর মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার কি, কেনো হয়,  কিভাবে মোকাবেলা করে সুস্থ থাকা যায় ইত্যাদি বিষয়ে নারী এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হরমোন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, বিশেষ করে বহুল ব্যবহুত গর্ভনিরোধক বড়ির সাথে যে স্তন ক্যান্সারের ঝুকি আছে তা প্রায়ই শোনা যায় না। ডাক্তার, স্বাস্থ্য কর্মী এবং ঔষধ কম্পানীগুলো এ বিষয়ে উচ্যবাচ্য করেন না। আমাদের দেশে যেসব নারী হরমোন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যেমন খাবার বড়ি, ইনজেকশান, প্যাচ ব্যবহার করেন তাদের অধিকাংশ স্বল্প শিক্ষিত এবং অনেকে অশিক্ষিত। এসব পদ্ধতি বিশেষ করে গর্ভনিরোধক বড়ি সেবনে কড়া নিয়ম মেনে চলতে হয়, আমাদের নারীরা সঠিকভাবে সে নিয়ম মেনে চলেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অধিকাংশ নারী হয়তো জন্মনিয়ন্ত্রনের এসব পদ্ধতি থেকে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকির বিষয়টি জানেন না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকাটা জরুরি কারণ তথ্য মানে ক্ষমতা। সহায়ক তথ্যে একজন নারী অন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিবেচনায় নিতে পারেন। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে নারীর সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা এবং সঙ্গী থেকে সহযোগিতা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকৃতপক্ষে নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবকিছুই পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শে চালিত হয়। এ অবস্থায় নারী-পুরুষের একান্ত বিশেষ সম্পর্ক পুরুষ কর্তৃত্বের বাইরে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। মানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পছন্দের ক্ষেত্রেও পুরুষের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের চর্চা দেখা যায়। নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছি অনেক নারী (দেশী-বিদেশী) বড়ি খেতে পছন্দ করেন না, অনেকে এতে যৌন ক্ষমতা হ্রাস বোধ করেন কিন্তু বাধ্য হয়েই তাদের বড়ি খেতে হয় কারণ তাদের স্বামীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিতে বা কনডম ব্যবহারে রাজি নয়। রাষ্ট্রের নীতি এবং সমাজ ব্যবস্থাও জনসংখ্যা রোধ করতে নারীকেই প্রথম টার্গেট করে। মন ভোলানো বিজ্ঞাপন এবং বর্ণিল প্রচারের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নারীর উপর চাপায়। কূটকৌশলে নারীকে মহিমান্বিত করা হয় যেমন, সুখী পরিবার গড়া এবং রক্ষা করা নারীর দায়িত্ব এবং এর জন্য নারীর দরকার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা ইনজেকশান! অন্যদিকে যৌনতা উপভোগ করবে পুরুষ এবং এর জন্য তার দরকার কনডম! এমন পুরুষতান্ত্রিক বার্তাই প্রচারিত হয়ে আসছে! অথচ হরমোন নির্ভর পদ্ধতি, খাবার বড়িতে নারীর স্তন ক্যান্সারের 'সামান্য উচ্চ ঝুঁকি'র পাশাপাশি নারী-পুরুষ দুজনেরই যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে পুরুষের কনডম ব্যবহার জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং যৌনবাহিত রোগ থেকে দুজনকেই সুরক্ষা দিতে পারে। এটা ঠিক যে বিশ্বে বিপুল সংখ্যক নারী হরমোন নির্ভর পদ্ধতি ব্যবহারে সুস্থ আছেন। তবে উন্নত দেশে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নারীদের সুস্থতার জন্য সহায়ক। অন্যদিকে, আমাদের অধিকাংশ নারী অপুষ্টিতে ভোগেন এবং অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবায় টিকে থাকেন। তাই ঐসব দেশের গবেষণায় জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়িতে স্তন ক্যান্সারের 'সামান্য উচ্চ ঝুঁকি' পাওয়া গেলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা 'উচ্চ ঝুঁকি' হতে পারে। আমার অনুমান (Hypothesis) আমাদের দেশে স্তন ক্যান্সার বিস্তারের জন্য মূলত দায়ী এই হরমোন ভিত্তিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, ইনজেকশান, প্যাচ প্রভৃতি। স্বল্প মেয়াদে এর নেতিবাচক পরিণতি দেখা যায় না কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হিসাবে আমাদের নারীরা হয়তো স্তন ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। নারীর সুস্থতা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখবে, আশা করি।

পরিশেষে, এ লেখা পড়ে হরমোন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী, খাবার বড়ি সেবনকারী কেউ হঠাৎ করে যেন তা বন্ধ না করেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যাইহোক, নারীর সুস্থতা মানে পরিবারের সুস্থতা এবং এর জন্য পুরুষের/স্বামীর সংবেদনশীলতা ও সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের উপর একটা বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা জরুরী মনে করি, কারণ এই গবেষণার ফলাফল দেশে স্তন ক্যান্সার রোধে পরিকল্পনায় সহায়ক হবে। সুস্থতার জন্য সঠিক চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। তাই সচেতনা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে সুলভ মূল্যে স্তন ক্যান্সারের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।

তথ্যসূত্রঃ

- http://www.breastcancer.org/research-news/study-questions-birth-control-and-risk

- http://www.nhs.uk/news/2014/08August/Pages/Contraceptive-pills-may-double-breast-cancer-risk.aspx

- http://www.bupa.co.uk/health-information/directory/h/hormonal-contraception

2157 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।