সীমিতা মুখোপাধ্যায

ভারতবর্ষের গরলগাছা গ্রামে জন্ম। বর্তমানে কোলকাতার বাসিন্দা। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। আপাতত দুটি বাংলা কবিতার বই, ভারতবর্ষ থেকেই প্রকাশিত— 'দশভুজা সার্কাস' (যাপনচিত্র প্রকাশন) এবং 'আমার অসময়গুলি' (অস্ট্রিক প্রকাশন)।

বিশের বিষ

আমি দক্ষিণ কোলকাতার এক সুখী-সুখী গৃহবধূ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝড় দেখি, বৃষ্টি দেখি, রোদ্দুর ওঠা দেখি ...শুনেছিলাম, মহাপ্রলয়ের আগে প্রকৃতি নাকি স্তম্ভিত হয়ে যায়। গত দু'মাস ধরে সেই থেমে থাকার বিষয়টা ছিলোই, বিশ্বব্যাপী মহামারীর কারণে জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়ে চলছিলো লকডাউন। অর্থাৎ, ধ্বংসের মুখড়াটা গাওয়া হয়ে গিয়েছিলো।

প্রথমেই আসি নাম বিভ্রাটে। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক যে পত্রিকাটি, যে পত্রিকা না পড়লে নাকি পিছিয়ে পড়তে হয়, সেই পত্রিকাতে ঝড়ের আগে একেকদিন একেক রকম নাম প্রকাশিত হতে লাগলো। প্রথমে 'আমফান', তারপর 'উম্ফান' হয়ে শেষে হলো 'উম্পুন'। আসলে ইংরিজিতে যাই লেখা হোক না কেনো, সব ইংরেজি শব্দের কিছু স্থানীয় উচ্চারণ থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলি, ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি ব্রাজিলের কারেন্সি real। বছর খানেক আগে ব্রাজিলবাসী বান্ধবীর মুখে শুনলাম পর্তুগিজ ভাষায় 'real'-এর উচ্চারণ নাকি 'হিয়াও'। সুতরাং, আলোচ্য ঝড়টির থাইল্যান্ডের দেওয়া নামের আসল উচ্চারণ কি হবে তাই নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে। গুগল করে যেহেতু দেখলাম, উচ্চারণ 'উম্পুন' তাই গোটা রচনাটিতে আমি 'উম্পুন'-ই লিখব।

বহুকাল ধরে বড় বড় ঝড়গুলো, সে ফণী হোক বা বুলবুল, কোলকাত্তাইয়াদের বেশ হতাশ করে এসেছে। সেই কবে ২০০৯ সালে আমরা আয়লার লেজের ঝাপট খেয়েছিলাম, সে স্মৃতি অনেকেরই ঝাপসা হয়ে গেছে। তাই যখন উম্পুনের জন্মের কথা শোনা গেলো, এ-বঙ্গের অনেকেই স্বার্থপরের মতো বলতে লাগলো, "আমাদের চিন্তার কিছু নেই। নয় বাংলাদেশ, নয় ওড়িশা কেউ একজন ঝড়টা নিয়ে নেবে।" তবে, সে-সব আশায় জল ঢেলে ঠিক আগের দিন রাতে আমরা জানলাম, এ-বারে আর রক্ষে নেই, তিনি লেজা-মুড়ো-ধর সব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়েই বয়ে যাবেন। windy.com নামে একটি অপূর্ব সাইটের সন্ধান পাওয়া গেলো, সারাদিন ধরে সেখান থেকে ঝড়ের অবস্থান ও গতিবেগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে।

বিশে মে, দুপুর ১টা। ছাদের ওপর থেকে অদ্ভুত হাড়হিম করা এক ঘটাং-ঘটাং শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। কোলকাতার এয়ারকন্ডিশন-শাসিত গরমে ছাদ ঠান্ডা রাখতে অনেক বাড়িতেই ছাদের ওপর আরেকটা টিনশেডের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, মানে ছাদের ওপর ছাদ। আমাদের ফ্ল্যাটেও তেমনি একটি টিনশেড ছিলো— হালকা-ফুলকা কিছু নয়, বেশ শক্তপোক্ত ছাউনি। ফ্ল্যাটের বিশাল ছাদের সেই টিনশেডের আয়তনও খুব একটা কম নয়। এত কালবৈশাখী বয়ে গেছে এই ছাদের ওপর দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর আওয়াজ কখনও তো শুনি নি। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল হাতড়ে উইন্ডির শরণাপন্ন হলাম। যা দেখলাম, তাতে প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে শিড়দাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। উম্পুন পশ্চিমবঙ্গের চৌকাঠের ওপারে বে অফ বেঙ্গলে দাঁড়িয়ে তখনও পা ঠুকছে, ল্যান্ডফল হয় নি। 'অ্যাকুওয়েদার'-এ হাওয়ার বেগ দেখাচ্ছে ঘন্টায় ৬৩ কিলোমিটার। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বান্ধবীকে ফোন করলাম, ফোন করে দেখি সেও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। কী হতে চলেছে, আমরা দুজনে তখনই বুঝে গিয়েছিলাম। 

আমার পিতৃগৃহ হুগলী জেলার উত্তরপাড়ায়, কোলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়, তবে উত্তরপাড়ার অবস্থান কোলকাতা থেকে উত্তরের দিকে। বাড়িতে ফোন করে সাবধান করলাম। তারপর থেকে আমি বারান্দায়, দরজায় ঠেস দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, বলা যায় ওখানেই স্ট্যাচু হয়ে গেছি। আমাদের বারান্দাটা ঘুপচি মতো, উত্তরমুখী, সামনেই আরেকটা বাড়ি আছে, তাছাড়া ঝড়-বৃষ্টির দাপট তখন পূর্ব দিক থেকে আসছে, তাই অসুবিধে তেমন হয় নি। এমন সময় হঠাৎ আমাদের ঘরের পূর্ব দিকের বন্ধ জানলার কাঁচ হাওয়ার চাপে ঝনঝন করে ভেঙে পড়লো। কোনো রকমে  পিচবোর্ড আটকে সামাল দেওয়া হলো। ঝড়ের গতি ও ছাদের রাক্ষুসে আওয়াজ ক্রমবর্ধমান। একটাও পাখি দেখতে পাচ্ছি না, রাস্তার কুকুরগুলোই বা কোথায় চলে গিয়েছিলো কে জানে! গাছপালা যে-ভাবে নড়ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি ভেঙে পড়লো। বাড়ির পাশের পার্কে এক প্রাচীন বৃক্ষ ছিলো, আমাদের চারতলা ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে সে উঠে গিয়েছিলো হয়তো আরও দু'তলা। ওই গাছটিকে দেখে যেন আরও ভয় লাগছে।

বিকেল ৪টে, হলদিয়া দিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন, অর্থাৎ ল্যান্ডফল হলো। কোলকাতায় বাতাসের বেগ তখন ঘন্টায় ৮৩ কিলোমিটার। এরপর যা ঘটল তা বলতে গিয়ে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! বিকট শব্দ করে ছাদের টিনশেড টিনগুলো একটা একটা করে ভেঙে বেরিয়ে আসতে লাগলো। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, একের পর এক বোমাবর্ষণ চলছে। এই অবস্থায় ঘরে ঢুকে আসাই শ্রেয়, কিন্তু পারলাম না। সে এক আজব দৃশ্য— টিনগুলো ভেঙে এসে পাড়াময় উড়ে বেড়াচ্ছে। একটি টিনের বিশাল পাত পাশের গাছে এমন ভাবে গিয়ে আটকালো যেন সেটা নেহাত একটা কাপড়ের টুকরো। আমার সব অনুভূতি লোপ পাচ্ছে। ঠিক দেখছি তো! 'এক্স-মেন' মুভিতে দেখা 'ম্যাগনিটো' যেন পাড়ায় এসে উপস্থিত, তার হাতের ইঙ্গিতে টিনের পাতগুলো যেন বনবন বনবন করে বাতাসে ঘুরছে। হিসেব মতো আমাদের এলাকায় অর্থাৎ যাদবপুরে উম্পুন পদার্পণ করবে সন্ধ্যে ৬টা- সাড়ে ৬টা নাগাদ। ফেসবুক মারফত খবর পেলাম সোনারপুর হয়ে সে অনতিবিলম্বকাল পরেই যাদবপুরে ঢুকছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৬টা থেকে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো। বাইরে তখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই দরজা বন্ধ করে ঘরে এলাম। ঘরে একটি মোমবাতিও নেই। মোবাইলের আলো আর একটি ছোট টর্চ ভরসা। 

তারপর যাকে বলে একটা দুঃস্বপ্ন। কী যে ভয়ানক শব্দ সে আর বলার কথা নয়। সেই সময় কোলকাতায় বাতাসের সর্বোচ্চ বেগ ছিলো ঘন্টা প্রতি ১৩৩ কিলোমিটার।

সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ, সব স্তদ্ধ হয়ে গেলো, তখন বাইরে শুধুই বৃষ্টির আওয়াজ। মানে তখন আমরা সাইক্লোনের 'আই'-তে অবস্থান করছি। 'আই' অঞ্চল সব সময় শান্ত হয়, এরপর আসে উল্টো ঝড় বা লেজ। এই ভীতির সন্ধ্যাটা কেটেছে বারবার উত্তরপাড়ায় ফোন করে। চরম বিপদের মুখে মানুষ বোধহয় শুধু নিজের লোকেদেরই খোঁজে। যাইহোক, ঝড় শান্ত হতে আবার বারান্দায় অবস্থান নিলাম। তাছাড়া আর করবটাই বা কী এই অন্ধকারে? প্রথমেই পার্কের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কী রকম যেন একটা লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। যা আশঙ্কা করেছিলাম তবে কি তাই হলো— সেই বিশাল বপু গাছটা শেষ? 'আই' পেরিয়ে যাওয়ার পর উল্টো ঝড় বইতে শুরু করলো, হাওয়ার গতিপথ এখন উল্টোমুখী— পশ্চিম থেকে পূর্বে। ততক্ষণে টিনশেডে আর একটি টিনের পাতও বোধহয় আর অবশিষ্ট নেই, ফলত ভীতিকর আওয়াজটাও অনুপস্থিত। এভাবে চলতে চলতে রাত বারটার মধ্যে উৎপাত মিটলো। উইন্ডি খুলে দেখলাম উম্পুন তখন নদিয়ায়। সাড়ে বারটা নাগাদ বিদ্যুৎ পরিষেবা ফেরত পেলাম। কিন্তু, সে রাত্রে ঘুম আর এলো না, বালিশে মাথা রাখলেই যেন সেই ভয়াবহ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সকাল হতেই ছুটলাম ছাদে, টিনশেডের কাঠামোটা কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, টিনগুলো নেই, আসেপাশের অনেক বাড়িরই টিনশেড উম্পুনের সঙ্গে কোথাও একটা চলে গেছে, পার্কের সেই আদিম গাছ মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ে আছে, অন্যপাশে রাস্তার ওপর একটা ল্যাম্পপোস্ট তার যতরাজ্যের তারের সম্ভার নিয়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে পড়েছে, CESC-র গাড়ি এসে ঘুরে দেখে-টেখে চলে গেলো।

ঘরে এসে ফেসবুক খুলে দেখি, বিভৎস অবস্থা। অনেকের বাড়িতে এক কোমর জল। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে শতাধিক গাছ ভেঙে পড়েছে। গাছ পড়ে ইউনিভার্সিটির মূর্তি ভেঙে গেছে। শোনা যাচ্ছে দশ হাত পর পর নাকি একটা করে গাছ পড়েছে। খবর পেলাম, উত্তরপাড়ার স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সামনে যে শতাব্দী প্রাচীন বটগাছ ছিলো সেটি গোড়া থেকে উপড়ে মাঠে শুয়ে আছে। ছোটবেলার কত স্মৃতি ওই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে। লক্ষ লক্ষ পাখির বাসস্থান ছিলো ওই গাছটি। শেষ।

তারপর শুরু হলো, জল এবং বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। দিকে দিকে বিক্ষোভ, বিদ্যুৎকর্মীদের মারধোরের খবর আসতে শুরু করলো। মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবাও বসে গেছে। এরই মধ্যে হৃদয় বিদারক খবর, কলেজস্ট্রিটের অগনিত বই জলে ভাসছে, বই-ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত!

এ তো গেলো শহরের কথা। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা চিন্তার বাইরে। ২০ তারিখ রাতেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, দুটো ২৪ পরগনা কার্যত আর নেই। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় তিনটি বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে গেছে। আমার পরিচারিকা আসতো দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণ বারাশত থেকে। দু'দিন বাদে তাকে ফোনে পেলাম, বললো, তার মাটির বাড়ি, টিনের চাল, বাড়ির জিনিস কিছুই আর নেই, ঝড় আর জলে তোড়ে সব নিশ্চিহ্ন। সবাই মিলে গাদাগাদি করে একটা স্কুল বাড়িতে থাকছে। সোশাল ডিসটেন্সিং এখন সবার মাথায় উঠেছে। পরিচারিকা বললো, গ্রামের বাজারে একটা ত্রিপলও দুর্লভ হয়ে উঠেছে, ওরা আর নিজেদের গ্রামটাকে নিজেরাই চিনতে পারছে না, সব যেন তালগোল পেকে আছে। লকডাউন গরিব মানুষের অন্ন কেড়েছিলো, উম্পুন বাসস্থানটুকুও ছিনিয়ে নিলো।

অনেকগুলো উম্পুন রিলিফ ফান্ড গড়ে উঠেছে। করোনার সময় থেকেই দেখছি সাধারণ মানুষ মানুষের জন্য অনেক করছে। এবারও তার অন্যথা হবে না। তবে, পশ্চিমবঙ্গের এই বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে এখনও সময় লাগবে।

উম্পুনের আতঙ্ক থেকে এখনও মুক্ত হতে পারি নি, একটু ঝোড়ো বাতাস বা আকাশে মেঘ দেখলেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে, রাতের পর রাত ঘুমোতে পারছি না।

2275 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।