“মেয়ে দুটো কী চায়?”
দরখাস্তটা হাতে নিয়ে বাঙালি এসডিও-কে জিজ্ঞেস করলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স সাহেব। ভ্রু কুঁচকে রয়েছে তাঁর। শীতের এই সকালে বাসায় এসে হাজির হয়েছে মেয়ে দুটো। শাড়ি পরা, তার উপরে সিল্কের চাদর জড়ানো। দেখলেই বোঝা যায় ভদ্র ঘরের মেয়ে এরা। অন্য কেউ হলে দর্শন দিতেন না তিনি। দু’টো তরুণী মেয়ে দেখা করতে চায়, এটা জানার পরে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি।
“কী কারণে আসা?” চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চা মেয়ে, কিন্তু শাড়ি পরে থাকায় দুজনকেই তরুণীর মতো লাগছে। আপনি না তুমি বলবে, এই দ্বিধা থেকে ভাববাচ্যে কথা বলে এসডিও।
মুখ খোলে শান্তি। যদিও সুনীতি আর সে একই বয়সের, কিন্তু লম্বা চওড়া হবার কারণে তাকেই বেশি বয়স্ক বলে মনে হয়। এ ছাড়া তার ব্যক্তিত্বও প্রবল, গুছিয়ে কথা বলতে জানে।
“আমার নাম ইলা সেন। আমার বাবা ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। আমি সাঁতারে পটু। তেরো ঘণ্টার সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। শুধু এটা না আমার আরো পুরস্কার রয়েছে সাঁতারে। বাংলার মেয়েদের সাঁতারে উৎসাহ দেবার জন্য মফস্বল জেলাগুলোতে ঘুরছি আমি। কিশোরগঞ্জে প্রদর্শনী করেছি, ময়মনসিংহে সুইমিং পুল প্রতিষ্ঠা করেছি। কুমিল্লা শহরেও সেরকম একটা সুইমিং পুল করার ইচ্ছা রয়েছে। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাহায্য চাই।”
শান্তির কথা অনুবাদ হয়ে পৌঁছে গেলো ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে।
“”ফয়জুন্নেসা স্কুলের হেড মিস্ট্রেস মিস বিশ্বাসকে চেনো?”
“জ্বী না, আমরা ঢাকার মেয়ে।” মিস বিশ্বাসকে না চেনার ভান করে শান্তি।
“উনার কাছে তোমাদের দরখাস্ত পাঠিয়ে দিচ্ছি। উনি এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন।”
এসডিও-কে নিয়ে ভিতরের রুমে চলে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব।
শান্তির কাছ ঘেঁষে আসে সুনীতি। ফিসফিস করে বলে,
“ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যদি আর না আসে? এপ্লিকেশন যদি আর্দালিকে দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়? পরিকল্পনাতো তাহলে সব ভেস্তে যাবে।
সুনীতির কথার কোনো উত্তর দেয় না শান্তি। চাদরের ভিতরে হাতটা নড়ে ব্লাউজের নিচে চলে যায়। সেখানে লুকোনো রিভলভারটাকে বের করে হাতে নিয়ে নেয়।
“খারাপ চিন্তা বাদ দিয়ে জিনিস বের করে হাতে নে। এখনই সুযোগ। পরে আর সময় পাবি না।” সুনীতিকে হুকুম করে শান্তি।
আজকের এই দিনের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। অখিল দার কথা মনে হলো শান্তির। যুগান্তরে সব ছেলে বিপ্লবী। তার মাথাতেই প্রথম এসেছিলো দেশটা শুধু ছেলেদের না, মেয়েদেরও। বিপ্লবে তাদেরও অংশ নেওয়া উচিত। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই তাকে, সুনীতিকে আর প্রফুল্লনলিনীকে অস্ত্র শিক্ষা দেবার আয়োজন করা হয়। ঘোড়ার গাড়িতে করে কোটবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের। পয়েন্ট ফোর্টি ফাইভের রিভলভার তুলে দেওয়া হয়েছিলো তার হাতে। সুনীতি ছোটখাটো বলে তাকে দেওয়া হয়েছিলো পয়েন্ট থার্টি টুর রিভলভার। রিভলভার হাতে পেয়ে সেকি আনন্দ আর রোমাঞ্চ তাদের তখন।
কোটবাড়ি জায়গাটা ছোট ছোট পাহাড় আর টিলায় ভরা। চারিদিকে জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এর মাঝে কোথাও কোথাও রয়েছে সমতলভূমি। অস্ত্র চালনা শেখানোর জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হলেন অখিল নন্দী এবং বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য। প্রফুল্লনলিনীর ভাই সুধীরও উপস্থিত রয়েছে সেখানে। এছাড়া রয়েছে সতীশ রায়। সতীশ রায় বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তর্জনী দিয়ে রিভলভারের ট্রিগার টানতে পারতো না দেখে, মধ্যমা ব্যবহার করতো সুনীতি।
ট্রেনিং শেষে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হলো শান্তি আর সুনীতিকে।
সকালে স্কুলে যাবার নাম করে বের হয়ে এসেছিলো বাড়ি থেকে। দু’জনেই নবাব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী। ক্লাস এইটে পড়ে। পথ থেকে তাদের ঘোড়ার গাড়িতে করে তুলে নিলো সতীশ রায়। ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠির সামনে নামিয়ে দিয়েই সরে পড়লো সে। শান্তি আর সুনীতি গিয়ে আর্দালিকে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে স্লিপ পাঠিয়েছিলো সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসাবে।
দম বন্ধ করে অপেক্ষায় রয়েছে এখন তারা দু’জনে। দু’জনের উৎকণ্ঠাকে উড়িয়ে দিয়ে দরখাস্ত হাতে করে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ফিরে এলেন।
“এই যে তোমাদের দরখাস্ত, আমি সুপারিশ করে দিয়েছি।”
ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ানো হাত থেকে দরখাস্ত নেবার কোনো আগ্রহই দেখা গেলো না তাদের মধ্যে। এর পরিবর্তে সিল্কের চাদর ভেদ করে সশব্দে বেরিয়ে এলো ঘাতক বুলেট। দুটোরই লক্ষ্যস্থল ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স। গুলি খেয়ে ঘরের ভিতরের দিকে দৌড় দিলেন তিনি। এসডিও ছুটলো তাঁর পিছু পিছু। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করছে সে।
“পাকড়ো, পাকড়ো।”
গুলি আর এসডিও-র তারস্বর চেঁচামেচিতে ছুটে আসে লোকজন। রিভলভার দুটো ছিনিয়ে নেয় তাদের দু’জনের কাছ থেকে। দু’জনকেই দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। তারপর শুরু হয় ব্যাপক মারধোর। কিল, চড়, লাথি, ঘুষি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় তারা তাকে। এগুলো করেও আশ মেটে না তাদের। দেহতল্লাশি করার অজুহাতে দুজনের পরনের শাড়িও খুলে নেয় তারা।
মার খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে দু’জনে। নিজেদের কী হবে, সেটার পরিবর্তে মিশন সফল হয়েছে কিনা সেটা নিয়েই চিন্তিত তারা। গুলি খেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দৌড়ে ভিতরের দিকে গিয়েছেন। ধপাস করে কিছু একটা পড়ার শব্দও শুনেছে তারা। কিন্তু, তিনি মারা গেছেন কিনা বুঝতে পারছে না। ফলে পাহারারত পুলিশকেই জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিলো সুনীতি। ‘আমাদের ত্রিপুরা’ নামের একটা পত্রিকায় স্মৃতিচারণ লিখেছিলেন সুনীতি চৌধুরী। সেখান থেকেই তুলে দেই।
“তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করে চলেছি বাড়ির সকলের চলাফেরা, কথাবার্তা, ঘটনা কি ঘটল বুঝতে হবে তো। যখন দরজার ভারী পর্দাটা একটু উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পাশের ঘরে কেউ যেন শুয়ে আছে চাদর গায়ে। লোকজনও ঘরে আসছে যাচ্ছে, বড় ধীর পদক্ষেপে, চারদিকে যেন স্তব্ধ ভাব।
ভাবছি তবে কি সফলকাম, না বিফল? আহত হলে ডাক্তার আসা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির একটা ব্যস্ততা থাকতো। জানি, এই কার্যের সফলতার সঙ্গে জড়িত শুধু আমাদের ব্যক্তিগত সফলতা নয়, সমগ্র বিপ্লবী গোষ্ঠীর সাফল্য, সমগ্র নারী জাতির মর্যাদা। আমরা যে ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে এসেছি - মেয়েরাও পারে সফলতার সঙ্গে দৃঢ়হস্তে অস্ত্র ধারণ করতে, কম্পিত না তাদের হৃদয়, তাদের হস্ত। পুরুষেরই শুধু একচেটিয়া অধিকার নয় অস্ত্র ধারণে। পাহারারত পুলিশকে জিজ্ঞাসা করি না কেনো? জিজ্ঞাসা করতেই মুখ খিঁচিয়ে উঠলো …. একদম মার ডালা, ফিন পুছতা হ্যায়?”
১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার অভিযোগে পরের মাসেই শান্তিসুধা ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরীর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়ে যায়। বয়স কম দেখে ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা পান তাঁরা দুজনেই। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসের আটাশ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকা এই মামলার রায়ের উপরে একটা সংবাদ পরিবেশন করে। সেটার শিরোনাম ছিলো, ‘শান্তি ও সুনীতির যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।’ মূল খবরে যা লেখা হয়, সেটা তুলে দিচ্ছি এখানে,
“গত ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ স্টিভেন্স তাঁহার নিজ বাংলোয় পিস্তলের গুলিতে নিহত হন। পুলিশ এই সম্পর্কে শান্তিসুধা ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী নাম্নী দুইটি বালিকাকে গ্রেফতার করে। উহারা উভয়েই স্থানীয় ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
উহাদের বিচারের জন্য কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মিঃ পিয়ার্সন, বিচারপতি মিঃ পি মল্লিক এবং বিচারপতি মিঃ এস, কে, ঘোষকে লইয়া একটি বিশেষ আদালত গঠিত হয়। গতকল্য বুধবার বিশেষ আদালত এই মামলার রায় প্রদান করেন। বিচারে শান্তি ও সুনীতি উভয়েই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতা হন।
বিচারকগণ আসামীদ্বয়কে স্বেচ্ছায় ও মিলিতভাবে মিঃ স্টিভেন্সকে হত্যা করিবার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করিয়াছেন।”