জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

কথা সাহিত্যিক

ধর্ম বলতে সবাই বুঝবে -শুধু মানুষ

একটা অসাধারণ ঘটনা বলি। ক্লাস ওয়ানে থাকতে বিরাট সাইজের এক পুতুল কিনে আনলাম। তুলার পুতুল, পুতুলের হাত গলার সাথে বেঁধে নিয়ে ঘোরা যায়। দামও ভালো, আমার দরিদ্র পিতার জন্য বেশ ভালো! তবুও আমার প্যানপ্যানের ঠ্যালায় সেই পুতুল খরিদ করা হলো। সেই পুতুলের নাম দিলাম পারুল। যেইই পারুলকে দেখে সেইই মুগ্ধ, এতো বড় পুতুল! কেবল আমাদের বাসায় যে মেয়েটি কাজ করতো সে বলল

-কি করছ! তোমারে এই পুতুল কিন্না দেছে কে? বললাম

-বাবা। পুতুলে কি সমস্যা? সে বলল

-সব্বনাশ করছিন। তোমার আব্বা তো পাঁচবেলা নামাজ পড়ে জানতাম, এই পুতুল কিন্না দিয়া সব নেকী কাটা হই গেলো! আল্লা গুণা দিবোতো!

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম

-কে বলেছে? পুতুল তো খেলছি আমি, বাবা তো আর খেলছে না! তাহলে আল্লা তাকে কেন গুনা দেবে? সে বলল

-পুতুল খেলা হিন্দু মেয়েদের কাজ, মুসলমান মেয়েরা পুতুল খেলে না। আমপারা নিয়ে সূরা কুনুত মুখস্ত করে! 


আমি হাত ধুয়ে ফেললাম। পুতুলকে ফেলে রাখলাম বসার ঘরের এক কোণায়। পুতুলকে বললাম

-তোমার জন্য আর কারোর গুণা হতে দিচ্ছিনা, কাজেই দূর হও। 

কিন্তু দুদিন পরেই পুতুলের বিরাট বিরাট মায়া মায়া চোখের দিকে তাকিয়ে বড় কষ্ট হলো। তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

-পুতুল, তুমি হিন্দু হয়েছো কেন? মুসলমান হতে পারোনি?

ক্লাস ফাইভে ইসলাম ধর্মে হাইয়েস্ট পেলাম। যার প্ররোচনায় হাইয়েস্ট পেলাম তিনি আমাদের হিন্দু ম্যাডাম, তাঁর নাম তুলসি দাশ। তুলসি ম্যাডাম জানিয়েছিলেন -উনি ইন্টারমিডিয়েটে খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে হাইয়েস্ট পেয়েছিলেন! বাইবেল তাঁর নখের ডগায়। তিনি বললেন

-হিন্দু হয়ে খ্রিষ্টধর্মে এতো নম্বর পেলাম, কিন্তু মুসলিম হয়ে তুমি ইসলাম ধর্মে এতো কম নম্বর পাচ্ছ কেন?

কয়েক বছর আগে এক বাচ্চার রক্তের দরকার ছিল, বাচ্চার আছে থ্যালাসেমিয়া। মাসে মাসে রক্ত দিতে হয়, কারণ তার শরীরে একবিন্দু রক্তও তৈরি হয়না। রক্তের গ্রুপ ‘বি নেগেটিভ’, খুবই রেয়ার রক্ত। বাচ্চার বাবা ইনবক্সে জানিয়েছিল রক্ত লাগবে। যার রক্ত ম্যানেজ করে দিলাম সে হিন্দু। বাচ্চার বাবা নিয়মিত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, সাদকা দেয়, যাকাত দেয়...সে গাইগুই করে বলল

-ইয়ে, মুসলিম কাউকে পাওনি? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম

-আমি এটাই পেয়েছি। 
সে ফোন কেটে দিলো। কিন্তু বাচ্চার যখন খিঁচুনি উঠলো তখন এই হিন্দু লোকটিকে ফোন দিতেই তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে রাত একটায় হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। আর কয়েক মিনিট দেরী হলে কি হতো কে জানে!

আমি যখন ফোন দিলাম তখন বাচ্চার বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন --প্রীতি তোমাকে আল্লা বাঁচায়ে রাখুক, আমার মেয়েটা আরেকটু দেরী হলেই হয়তো আর বাঁচতো না!আমি বললাম

-কিন্তু উনিতো হিন্দু...
তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন

-রক্তের রঙে কি হিন্দু লেখা থাকে? রক্তের রঙে কেবল ‘মানুষ’ লেখাই থাকে! তুমি একদিন বাসায় আইসো, ট্রিট দেবো!

আমি আর ট্রিট নিতে যাইনি, কারণ ততক্ষণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ট্রিট আমি পেয়ে গিয়েছি একজন মানুষের রক্তের দামে, মনুষ্যত্ব নামের ভালবাসার খামে! আমার কেবল গাইতে ইচ্ছে হয়েছে

-আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ,
আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু...

 

1769 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।