শীলা মোস্তফা

নব্বই-এর সেই উত্তাল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে যাত্রা শুরু। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাহসী এক অভিযাত্রিক। সাংগঠনিক চর্চায় এবং আবৃত্তি আন্দোলনের একটি উজ্জ্বলতর নাম। নব্বই-এর দশকে স্রোত আবৃত্তি সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অর্ধযুগেরও বেশি সময়। সংগঠনকে সুগঠিক করএছেন এবং যুক্ত থেকেছেন সে সময়ের সব ক'টি সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে। কবিতা লেখার কলমটিও বেশ ধারালো।

শশুর শাশুড়িকে সেবা করে কোনো পুরুষকে ভালো স্বামী হবার পরীক্ষা দিতে হয় না

আমার এক বন্ধু (নামটা অপ্রকাশিত রাখলাম) প্রেম করে বিয়ে করেছে, দু’জনেই কর্মজীবী। বাসর রাতে স্বামী গদ গদ হয়ে বললো, “আমার মা আমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে, তোমার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, শুধু রাতে আমার মা ঘুমুতে গেলে তার মশারিটা টাঙিয়ে দিও।” আমার বন্ধু নতুন স্বামীকে খুব আস্তে করে বললো, তিনি তো তোমাকে অনেক যত্ন করে বড় করেছেন আমাকে নয়। মশারি টানানোর দায়িত্বটা তো তাহলে তোমার। আমাকে যারা কষ্ট করে বড় করেছেন তাঁদের দায়িত্ব আমি তোমাকে দেবো না, আমিই ভাববো।” আমার বন্ধুর মতো সব মেয়ের আত্মসম্মান বোধতো সবার নেই তাই প্রথম রাতে বেড়াল মারতে পারে না। পরে যখন মশারি টানানো থেকে কাপড় কাঁচা সব মাথায় এসে পরে তখন হঠাৎ একদিন অগ্নুৎপাত ঘটে।

মেয়েদের দোষের শেষ নেই! ইদানীং শুরু হয়েছে সেই মেজিষ্ট্রেট বউয়ের যন্ত্রনার জন্য বি সি এস অফিসারের মাকে রেলস্টেশনে ফেলে আসার কাহিনী! কি কষ্ট! কি কষ্ট! চোখে দেখা যায় না! বাংলা সিনেমা কাহাকে বলে! ঘটনাটা সত্যি কি মিথ্যে জানি না তবে এসব কাহিনী ঘন ঘন ঘটলে মানুষের (ছেলেদের) একটু টনক নড়তো!

এই ঘটনার সূত্রে আজ একজন পোস্ট দিয়েছেন "হে আল্লাহ তুমি মেয়ে জাতিকে আরো নরম মনের অধিকারী করে গড়ে তুলো।" সত্যি? আরও নরম?

আরে বাবা শাশুড়িকে বউ রাখতে চায় নি তাঁতে কি? ছেলে রাখছে না কেনো? তার তো মা, সে কি করে তার মাকে রেললাইনের পাশে রেখে এলো? ভাবা যায়? কিন্তু না সব দোষ বউমার। কেনো রাখতে চাইছে না?

এখানে দুজনে কর্মজীবী, অর্থাৎ দুজনেই বাইরে কাজ করেন, কিন্তু বাসায় এসে স্ত্রী রান্না ঘরে ধুঁকে রান্না করেন, ছেলে মেয়েদের লালন পালন করেন, বাড়ির প্রতিটি কাজ সমাধা করেন ঘুমতে যাবার আগে, সাথে শাশুড়িরও সেবা গোদের ওপর বিষফোঁড়া। আর স্বামী কাজ থেকে এসে চা নিয়ে টিভি দেখেন, টক শোর রাজনীতি আলোচনা শুনেন, টেবিলে স্ত্রীর পরিবেশনায় মাকে নিয়ে গরম গরম ডিনার করেন তার পর রাতে ক্লান্ত স্ত্রীর উপর স্বামিত্ব প্রয়োগ করেন। অন্যদিকে স্ত্রী সকালে উঠে আবার নাস্তার ব্যবস্তা করেন, ছেলেমেয়েদের টিফিন, স্বামীর দুপুরের খাবার, শাশুড়ির দায়িত্ব শেষ করেন কর্মস্তলে যাবার আগে। একদিন দু’দিন তিনদিন নয়… প্রতিদিন।

সময় বদলে যাচ্ছে, আফিমের নেশা ফিকে হয়ে আসে… ক্লান্ত অবসন্ন শরীর, মন প্রতিবাদ করতে শিখে যায়।

বাবা- মা তার সন্তানকে অনেক যত্ন করে লালন পালন করেন, তাই সন্তানেরও দায়িত্ব তার বাবা মাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখবেন আর এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়মটা ব্যাখ্যা করা যাক। ছেলেরা রাখবে বাবা মাকে নিজেদের কাছে, "রাখেন" মানে কি দাঁড়ালো? ছেলের বউ তার দেখাশুনা করবেন কিন্তু credit goes to ছেলে। কিন্তু মেয়েদের নিজের বাবা মা? সেটা মেয়েদের দায়িত্ব নয়? কেন? বাবা মা তাঁদের মানুষ করেন নি? ছোট বাচ্চা লালন পালন করা যেমন full time job তেমনি বৃদ্ধ বাবা মাকে লালন পালন করাও full time job.

যেহেতু আমাদের বাঙ্গালি সমাজ আর ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়াল মেয়েদের কানের কাছে মন্ত্র পড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত তাই মেয়েদের মাথায় ঢুকে গেছে শ্বশুর শাশুড়ি মানেই বাবা মা, কিন্তু সেটা শুধু মেয়েদের বেলায়। ছেলেদের শ্বশুর শাশুড়িকে বাবা মা ভাবতে হয় না, সেবা করে ভালো স্বামী হবার পরীক্ষা দিতে হয় না। বিয়ে নামক আফিং খেয়ে মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে যেয়ে স্বামীর বাবা মাকে সেবা করে বেস্ট বউমা হওয়ার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে থাকে নিজের বাবা মার অবস্থা বেমালুম ভুলে। যেন নিজের বাবা মা তাঁদের দায়িত্ব নয়। স্বামীর অনুমতি পেলে বাবা মা কে কয়েকটা দিন এনে রাখতে পারে হয়তো কিছুদিন। তাতেই আহ্লাদে আটখানা!

যার যার মা বাবা তার তার দায়িত্ব, ছেলেরা যে দিন বৌয়ের মা বাবা কে রান্না করে খাওয়াবে, দেখা শুনার দায়িত্ব নিবে সেদিন থেকে মেয়েদের কাছ থেকে সমান আশা করা যায়।

বিয়ের পর সমাজ, পরিবার, ধর্ম মেয়েদেরকে নিজের বাবা মা কে ভুলে যেতে বলে আর অপরিচিত একজন মানুষের বাবা মাকে নিজের করে নিতে বলে, বোকা মেয়েরা তাঁতেই খুশি। বিয়ে মানেই মেয়েটার সব হারানোর পালা।  ছেলেটা হারায় না কিছু , উপরি পাওনা বাবা মা এবং নিজের কেয়ার টেকারে! সেই সব দিন শেষ, মেয়েরাও এক্ষণ কর্মজীবী! ওই সব ধর্ম আর সামাজিকতার দোহাই দিয়ে অশিক্ষিত, পরজীবী মেয়েদের বাঁধা যাবে, শিক্ষিত, স্বনির্ভর মেয়েদের নয়. সময় বদলেছে , আপনারাও বদলান!

7088 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।