সৌম্যজিৎ দত্ত

লেখক, ব্লগার, আইএসআই তে লেকচারার এবং গবেষণারত ছাত্র।

“শরিয়া" সংশোধন করো, নতুবা ছুঁড়ে ফেলে দাও

"নিকাহ্ হালালা মানব না: নাসিমা

এত দিন থেকেছেন অন্তঃপুরে। অন্তর্মুখী সেই মহিলাই এখন ধর্মীয় সালিশি সভার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন।

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে রঞ্জিতপুর গ্রাম এখন তোলপাড় হচ্ছে দুই সন্তানের মা, বছর আটত্রিশের নাসিমা বিবির বিদ্রোহে। স্বামী তাঁকে তিন তালাক দিয়েছিলেন। এখন মিটমাট করে আবার একত্রে থাকতে চান। কিন্তু শরিয়তের বিধান, স্বামীর কাছে ফিরতে হলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করে তিন মাস কাটিয়ে ফের তালাক নিয়ে ফিরতে হবে, যাকে বলে ‘নিকাহ্ হালালা’। তাতেই বেঁকে বসেছেন নাসিমা বিবি।

বছর দেড়েক আগে পারিবারিক অশান্তির সময়ে গ্রামের রাস্তায় গিয়ে ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে দেন নাসিমার স্বামী রবিউল। নাসিমা তখন ধারে-পাশে ছিলেন না। পরে গ্রামের লোকের কাছে তিনি বিষয়টি শোনেন। তবু তাঁকে বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়। সঙ্গে যায় চৌদ্দো বছরের ছেলে আর বারো বছরের মেয়ে।

সেই সন্তানদের মুখ চেয়ে এখন সংসারে ফিরতে চাইছেন রবিউল-নাসিমা। বাদ সেঁধেছে সালিশি সভা। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সভা বসিয়ে ধর্মীয় সমাজের মাথারা রায় দিয়েছেন, রবিউলের ঘরে ফিরতে গেলে নাসিমাকে ‘নিকাহ্ হালালা’ করতে হবে। এই নিয়ম অমান্য করলে তাঁদের গ্রাম ছাড়তে হতে পারে।

রঞ্জিতপুরে বাপের বাড়িতে বসে দৃঢ় গলায় নাসিমা বলেন, ‘‘প্রথম কথা, আমার স্বামী যে তালাক কথাটা বলেছেন, তা নিজে শুনি নি। দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের তালাকটাই তো অবৈধ। সেটা শোধরাতে অন্য পুরুষকে নিকাহ্ করতে হবে কেনো! এখন ছেলেমেয়েকে ডেকে গাঁয়ের লোকে বলছে— তোর মায়ের বিয়ে, নেমন্তন্ন করবি তো! আমি কি খেলার পুতুল?’’

একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা নাসিমা ভুল বলছেন না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে তিন তালাক (তালাক-এ-বিদ্দত) নাকচ করতে আইন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সভার প্রধান আখতার হোসেন অবশ্য বলেন, ‘‘এত সাহস ওই মেয়ে‌র! সুপ্রিম কোর্ট নিষিদ্ধ করেছে তো কী? ওকে নিকাহ্ হালালা করতেই হবে। তবেই সে হালাল (পবিত্র) হয়ে রবিউলের ঘর করার যোগ্য হবে। আর কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা বিয়ে করে নেয়। তিন মাস পরে তালাক পেতে অসুবিধা হয় না।’’ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা রবিউলও বলছেন, ‘‘শরিয়তে যা আছে আর গ্রামের মাথারা যা বলছেন, আমি তাতেই রাজি।’’

নাসিমা কিন্তু লড়াই ছাড়ছেন না। তাঁর পাশে রয়েছেন একটি সংগঠনের সভানেত্রী খাদিজা বানু ও শমসেরগঞ্জের মৌলবি আব্দুল লতিফ। লতিফও বলছেন, ‘‘ওঁদের তালাকই তো বৈধ নয়। কাজেই হালালার প্রশ্ন ওঠে না।’’ আর নাসিমার কথায়, ‘‘শরিয়তের নিয়মের ভুল ব্যাখ্যা করে সমাজের মাথারা আমাকে ধর্ষিতা হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’"

আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত এই খবরটি দেখে আমি এতটুকু অবাক হই নি। এমন বহুসহু উদাহরণ রোজকার দিনে আমাদের চোখে উঠে আসে। আমরা দেখি, আলোচনা – সমালোচনা করি, আবার ভুলে গিয়ে নতুন খবর নিয়ে মনোরঞ্জন করি রসিয়ে কষিয়ে।

খবর যখন পড়লাম, তখন সেটার পর্যালোচনা করা যাক কিছু! “শরিয়া আইন” শব্দটি পড়তেই আমার একটি কথা মনে এসে গেলো। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে, লেখক তসলিমা নাসরিন ভারতের একটি সংবাদপত্রে সবেমাত্র শিক্ষাধীন এক সাংবাদিককে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে শরিয়া আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো, কারণ লেখকের “নির্বাচিত কলাম” বাঙালি সমাজে নারীর মনে প্রভাব ফেলছিলো, এবং তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। লেখক সেই সাক্ষাৎকারে “শরিয়া আইন” প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “শরিয়া আইন নারী স্বাধীনতার অন্যতম এবং সবথেকে বড় অন্তরায়। এই আইন নারীকে প্রতিবন্ধী করে রাখতে চায়। নারীকে মুক্ত হতে গেলে শরিয়া আইনে সংশোধন প্রয়োজন।” যদিও সবেমাত্র শিক্ষাধীন সেই সাংবাদিক এই “শরিয়া আইন” কথাটি আত্মস্থ করতে পারেন নি। এবং যথারীতি “কুরআন”-এর সাথে গুলিয়ে, সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেন, “তসলিমা নাসরিন বলেছেন কুরআনের সংশোধন প্রয়োজন।” বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ এই ভাষাটি মেনে নিতে পারে নি। ফলাফল! লেখক তসলিমা নাসরিন ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে যান। এবং “লজ্জা” প্রকাশের সাথে সাথেই তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়, মাথার দাম ঘোষণা হয়, লেখককে অন্তর্ধানেও থাকতে হয়, এবং সর্বশেষ পরিণতি আজীবন “নির্বাসন।”

“নিকাহ্ হালালা”- শরিয়া আইনের তেমনই একটি ধারা, যার লক্ষ্য নারীকে পুরুষের ভোগ্য বস্তু করে তোলা। ঠিক যেমন “তিন তালাক” পুরুষতান্ত্রিক মর্জিতে চলে, পুরুষ ইচ্ছা করলেই তিনবার “তালাক” কথাটি উচ্চারণ করেই স্ত্রীর সাথে তাৎক্ষণিক বিচ্ছেদ ঘোষণা দিতে পারে। শরিয়া আইনের এইসমস্ত ধারাগুলিতে নারীর কোনো স্বাধীনতা থাকতে নেই, যেন নারী “শেকলবন্দী কোনো পশু” যা কেবল “পুরুষ” নামে মালিকের ইচ্ছার দাস মাত্র। পুরুষ ইচ্ছা করলেই “তিন তালাক” বলে নারীকে তালাক দিয়ে দেবে, আবার যদি সেই নারীকে একই ঘরে কখনো ফিরে আসতে হয়, তবে তাকে “নিকাহ্ হালালা” প্রথাটির মাধ্যমে অন্য একটি পুরুষের “ভোগের বস্তু” হয়ে শুদ্ধ হতে হবে। তবেই যদি সেই নারী আবার আগের সংসার ফিরে পেতে পারে!

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সর্বদা নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে, নারীকে দাস বানাতে, ভোগের বস্তু বানাতে, নারীকে শৃঙ্খলবদ্ধ করতে পুরুশাসিত “ধর্ম এবং আইন” প্রয়োগ করে সেগুলিকেই সমাজের নিয়ম করে তুলেছে। সমাজ এইসব নিয়মে এমনভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, “ইহাই সত্য এবং ইহাই ধর্ম।” অথচ পুরুষের জন্য এমন কোনো শৃঙ্খল কিন্তু সমাজে প্রচলিত হয় নি। হয় নি, কারণ পুরুষ মানেই মালিক, সে নিজের ইচ্ছাতে যা’খুশি তাই করতে পারে। নারী মানেই পুরুষের সম্পত্তি। যত নিয়ম, শুধু নারীর জন্য। পুরুষ যেমন চায়, তেমনভাবেই তার নারীসম্পত্তির পরিচালনা করবে।

যা কিছু লিখলাম, শরিয়া আইনের বিভিন্ন নিয়মগুলির সারসংক্ষেপ। বিচার আপনাদের হাতে। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ হয়ে নারীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ভোগ করবেন! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অভ্যস্ত হয়ে, কেবল নারী দাস হয়েই পুরুষের দাসত্ব করবেন! নাকি মানুষ হয়ে এমনসব কড়া পুরুষতান্ত্রিক “শরিয়া” আইনকে ছিন্ন করে, পায়ের জুতোর তলায় মাড়িয়ে, ফুটবলের মতো লাথি মেরে আবর্জনা স্তূপে ছুঁড়ে ফেলবেন। মনুষ্যত্বকে তুলে ধরবেন, নাকি মনুষ্যত্বকে ভরা বাজারে নিলাম করে, ঘরে ঘরে নারীকে কাপড় খুলে পুরুষতন্ত্রের ভোগ বানাবেন!

“ছিন্ন করো হে জাতি তুমি, ছিন্ন করো লজ্জার বাধ,

ছিন্ন করো পুরুষতন্ত্র, ছিন্ন করো পরাধীনতা,

মনুষ্যত্বকে তুমি প্রকাশ করো।”

1875 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।