চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

সন্তানের উপর মায়ের নিরঙ্কুশ অধিকার চাই!

(লেখাটি ২০১৫’র মা দিবসে লিখেছিলাম। আজ ফেসবুক সামনে এনে দিলো, নারী’র পাঠকদের জন্য দিলাম প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায়)

সবাই এতো মা.. মা... করছে কেনো? মানব সন্তানেরা কি অনেকদিন মাতৃহীন ছিলো? হঠাৎ তারা আজ পৃথিবীর পথে পেয়ে গেছে মায়ের দেখা। মা’তো জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নিজের নাড়ীর সাথে সলতে বেঁধে পুড়তে থাকা এক সলতে। এই সলতের আলোতে যারা পথ চলে তাদের বলে সন্তান! যে একবার এই সলতের আগুনে পুড়তে থাকে তার কি নিস্কৃতি আছে অনন্ত জন্মে? আজ তবে বিশেষ কি?

আমার সন্তান যখন পেটে ছিলো কী এক অস্বস্তি, এতোদিন জানতাম প্রসুতিকে হাঁটতে হয় প্রচুর, আমার হাঁটা নিষেধ, বসে থাকতে পারি না, শুয়ে পড়ি ডান কাত হয়ে, বাচ্চা নড়ে উঠে, ভাবি ব্যথা পাচ্ছে, বাঁ কাত হয়ে শুই বাচ্চাতো আর নড়ে না! উঠে বসি আহা নড়ে না কেনো! আবার ডানপাশে ফিরি, নাহ কোনো সাড়া নেই, মনে মনে ডাকি
-মি মি মি নাহ কোনো সাড়া নেই সাথে সাথে মোবাইল হাতে নিয়ে ডাক্তারকে কল করি
-পারভিন আপা বাচ্চাতো…. ওমনি সে মারলো একটা কিক পেটের ভেতরে, বল নাগালে থাকলে বল ছাঁদ ফুড়ে আকাশে উঠে যেতো। ডাক্তারের কাছে লজ্জায় পড়ে যাই, তিনি বলেন 
-কি খবর বলেন কেমন আছেন? 
-না অনেকক্ষণ নড়ছিলো নাতো তাই 
-বাচ্চারও তো রেস্ট দরকার, মায়ের সাথে সারাদিনতো সে ভলিবল খেলতে পারবে না। আপনি খাওয়াটা একটু বুঝে খেয়েন, ওয়েট বেশি হয়ে গেছে, আপনার প্রেশারও খুব আপডাউন করছে। 
-জ্বী এই সময়তো সবাই বেশি খেতে বলে 
-হ্যাঁ বলে, সে আপনাদের জন্য নয়, এই দেশের অধিকাংশ নারী- তিনবেলা পেট পুরে খেতে পায় না, যখন সন্তান ধারণ করে তখন অপুষ্টি আর রক্ত শুন্যতায় ভোগে অধিকাংশ নারী, গ্রামে গঞ্জে অনেক নারীকে পরিবার থেকেই এই সময় প্রয়োজনীয় খাবারও কম দেয়া হয়, যাতে প্রসুতির পেট বড় হয়ে না যায়, এটা একদমই ঠিক নয়, এর ফলে জন্ম নেয় অপুষ্ট সন্তান। তাদের জন্যই এটা কমন এডভাইস।
-আমিতো শুতে পারছি না, ডান বাম কোনো দিকেই না, শোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লে আমার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। 
-এ সময় এমন একটু হবেই। সহ্য করতে হবে। আজ একবার এসে প্রেশারটা চেক করে যান। 
-ঠিক আছে আসবো। 
-শোনেন সমস্যা মনে হলে অবশ্যই কল দেবেন। 
-জ্বী, এটা কি ডাক্তার না কি মা! উনার শত ব্যস্ততার মধ্যেও উনি আমার সাথে অনেক গল্প করেন, ফোনেই নিউজ পেপার থেকে মজার কোনো নিউজ পড়ে শোনান, বেশি ভাবলে বলেন,
-এতো দুঃশ্চিন্তা করবেন নাতো, আমিতো আছি, তারপর বেশ মিষ্টি করে হাসেন। প্রথম তো তাই এমন হচ্ছে, তাছাড়া আপনি একদম একা, বাচ্চাটা এসে গেলে দেখবেন আর একা নন। ফোন রেখে আমার মনে হয় আমি এই মাত্র আমার ঈশ্বরের সাথে কথা শেষ করলাম। একা বিরান প্রান্তরে ডাক্তারকে আমার ঈশ্বরই মনে হয়। 

ওর জন্মের পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর, মনে হয় এই সাত বছর আমি তৃপ্তিতে গোসল করতে পারি নি। বাথরুমে ঢোকার এক দুই মিনিটের মধ্যেই দরজায় দুদ্দাড় লাথি, উগ্বিগ্ন হয়ে দরজা খুলি 
-কি হয়েছে?
-এমনি তোমাকে দেখলাম, কি করো? 
-গোসল করি
-আচ্ছা, বলে ও ওর বারবির চুল ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে চলে যায়। হয়তো মাত্র শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়েছি ওমনি আবার
-কি হলো? 
-আমি আসবো
-না আসতে হবে না ভিজে যাবে আমিতো শাওয়ার নিচ্ছি
-দরজা লাগাবে না, আমি তোমাকে দেখতে পাই না
-সারাক্ষণ দেখতে হবে কেনো? 
-আমার দেখা লাগবে, কারণ তুমি আমার মা
-হ্যাঁ তো তোমারইতো মা!
-না, দরজা বন্ধ করে দিলে আমার মনে হয় তুমি মা না, আমার মনে হয় আমার মনে হয় আমার মনে হয় ও খেই হারিয়ে ফেলে
-কি মনে হয় তাড়াতাড়ি বলো, আমাকে স্নান শেষ করতে হবে তো
-মনে হয় মনে হয় তুমি হারিয়ে যাবে। 
-আমি হারাবো না
-প্রমিজ
-প্রমিজ 
-তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। এ হলো আমার সন্তানের সাথে আমার প্রতিদিনের কথোপকথন। হঠাৎ একদিনের নয়।

বেঁচে থাকাটা, পৃথিবীটা আমাদের জন্য সহজ নয়, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি খানাখন্দ পেরোনো মা আমি। ও সারাক্ষণ যখন মা মা বলে ডাকতে থাকে তখন বিরক্ত হয়ে বলি
-শোনো আজ তুমি কিন্তু আমাকে পাঁচবার এর বেশি মা বলে ডাকবে না, সেদিন মনে হয় ওর মা ডাকের সংখ্যা পাঁচ’শ ছাড়িয়ে যায়। আবার যখন বেশ কিছুক্ষণ ওর ডাক শুনতে পাই না তখন হাতের কাজ গুটিয়ে রেখে ওকে খুঁজতে যাই, মেধা…. মেধা… সাড়া নেই কোথায় তুমি? সাড়া নেই, খুঁজে খুঁজে পেয়ে যাই খাটের পেছনে গুটিশুটি হয়ে লুকিয়ে আছে, আমি জানতে চাই 
-কেনো?
-তুমি আমার মনে কষ্ট দিয়েছো আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। 
-কি কষ্ট দিয়েছি?
-মা ডাকতে নিষেধ করেছো।
-সেতো যখন কাজে থাকি তখন
-না তুমি কাজ করবে না
-কাজ করতে হবেতো 
-না আমার মা কাজ করবে না, আমার মাকে না দেখলে ভালো লাগে না।

একজন তরুণ কবি, ওকে আমি চিনি বেশিদিন হয় নি, কবিকে সুন্দরী বলতে ইচ্ছে করে না, এই ইচ্ছের বাইরেও ও সুন্দরী, একদিন রাতে কথা হলো ইনবক্সে- একটা প্রবল প্রমত্ত নদীকে কেউ যেনো বেঁধে রেখেছিলো, ও লিখে কথা বলছে, অথচ আমি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছি, ঠিক কান্না নয় আছড়ে আছড়ে পড়ছে কোনো জলোচ্ছাস-
-আপু আমার আমার দু’দু’টো বাচ্চা কতদিন ওদের আমি দেখি না, কতদিন ওদের ছুঁয়ে দেখি না। ওরা আমাকে দেখতে দেয় না। 
-কার বাচ্চা কিসের বাচ্চা
-আমার বাচ্চা আপু আমি পেটে ধরেছি
-তোমার বাচ্চা মানে? তোমার বিয়ে হলো কবে আর বাচ্চাইবা হলো কবে? 
আমি পাগল হয়ে যাই ওর কথা শুনে, কে আমার সন্তানকে আমাকে দেখতে দেবে না! কার এতো শক্তি? আমার মাথার ভেতর ভেঙে যাচ্ছে পৃথিবীর সব প্রতিরক্ষা বাঁধ। অনেক দিন আগে কোথায় পড়েছিলাম মনিহারা ফণি…আমার নিজেকে মানবী মনে হয় না আর মনে হয় ফণি, কে আমার আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে দুরে রাখে, কোন সে শক্তি? কে যেনো বলে
-আইন
-আইন? 

ছোবলে ছোবলে আমি তছনছ করে দেবো পৃথিবী, আমার বুকের আশ্রয় ছাড়া আমার সন্তান আর কোথাও নিরাপদ নয়। আমার সন্তানকে আমার কোল ছাড়া করবে বলে আমার কপালে বেশ্যার সীল মেরে দিচ্ছো? আইনের পরছা ছুঁড়ে দিচ্ছো আমার মুখের উপর? তাহলে বলবো –এ তোমাদের স্বেচ্ছাচারিতা, এ কিছুতেই আইন নয়, আইনের ব্যভিচার, মানি না। আমি প্রতি লহমা গুণে গুণে আমার অস্থি মজ্জা গুড়ো করে করে ওর শরীর দিয়েছি, আমি আমার মমতার নহর সেঁচে সেঁচে জঠর নিংড়ে ওকে জন্ম দিয়েছি, কারা আমার কোল শুন্য করে ওকে কেড়ে নিয়ে যায়?
-আপু কতদিন ওদের দেখি না আপু...... 
-সেকি... যাও তুমি ওদের কাছে, তুমি ওদের মা.... 
-দেয় না আপু, দেখতে দেয় না, ওদের অনেক ক্ষমতা
আমি দেখতে পাই ও কান্নায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমি আরো শুনতে পাই ওর বাচ্চারা একই ভাবে ওর জন্য রাতে ঘুম ভেঙে কাঁদছে
-মা… মা…..মা…

শুনলাম আজ মা দিবস, আমার খুব লজ্জা লাগছে শুনে, তরুণ কবি মা’টির কাছে খুব অপরাধী লাগছে, কেনো আজ মা দিবস? এই মা দিবস নিশ্চয় তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করছে! যে সভ্যতা যে আইন আজও মায়ের অধিকারকে নিরঙ্কুশ করতে পারে নি একসুতোও সেই সভ্যতা পালন করছে আজ মা দিবস।

হতে পারতো আজ সব মায়েরা পথে নেমেছে পুরুষ প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে। “মা সে যেমনই হোক যেই হোক একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মায়ের কোল খালি করা যাবে না। সন্তানকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মায়ের বুক থেকে আলাদা করা যাবে না। মা সে ম ‘ই যেমনই হোক যেই হোক!
“আঁধো হাতে আঁধো বোলে মাকে প্যাস্টেল কিংবা জলরঙে ভালোবাসা জানিয়ে মায়ের মমতার দায়সারা ঋণ শোধের কসমেটিক প্রবণতা বন্ধ হোক” 

মাকে সন্তানের সাথে সন্তানকে মায়ের সাথে থাকতে দেয়ার নি:শর্ত আইন প্রণীত হোক! এই দাবী যারা মাকে ভালোবাসো আজ তাদের সকলের দাবী হোক!

2026 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।