“পুড়ল কন্যা উড়ল ছাই
তবেই কন্যার গীত গাই”
প্রিয় একটি বইয়ে এই উক্তি দেখে জানতে পেরেছিলাম নারী তার জীবনকাল দিয়ে তার ভালত্ব প্রমাণ করে যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে ভাল বলা যায় না। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত নারীজীবন সংস্কারের শেকলে বাঁধা। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে, এখনও নারীশিশু মানে পরিবারে ৫০ ওয়াটের বাল্ব আর পুত্র সন্তান ১০০ ওয়াটের আনন্দ আলো। পাশের বাড়িতে বাচ্চা হওয়ার মিষ্টি আসলে, মিষ্টির বাহার দেখা মানে, ছেলে বাচ্চা আর ২/৩ টা মিষ্টি মানে মেয়ে বাচ্চা। ছেলে বাচ্চাকে সবার সামনে ন্যাংটো করে রাখা আর মেয়ে এক মাসের হলেও সব সময় আব্রুতে রাখা। ছেলে মানে শৈশব, কৈশোর মাঠ দাপিয়ে খেলার স্বাধীনতা, আর মেয়ে মানে ১০/১১ বছরেই অদৃশ্য শেকলের টানে অন্দরমহলে বন্দী। ছেলে চাকরিতে ঢুকবে সে স্বপ্ন দেখি, আর মেয়েকে বিয়ের, এর বাইরে আমাদের ভাবনাই নেই।
মেয়ে কিভাবে চলবে, বুক কতটুক ওড়না দিয়ে ঢাকবে, মাথায় ঘোমটা, হিজাব দেবে নাকি বোরখা পরবে সেটা আমরা ভাল করে ঠিক করে দেই। কিন্তু পুরুষদের ঠিক কত শতাংশ তাদের পোশাক পরিবর্তন করেছেন?
আমরা সেই নীতি মেনে চলি যে ছেলেরা অমনই। কিন্তু নারী-পুরুষ দুজনেরই ৪৬টা ক্রোমোজোম আর রক্তের রং ও লাল। পুরুষ যত রকম দৃষ্টিতে একজন নারীকে দেখতে পারে, নারীও তত রকমভাবে দেখতে পারে পুরুষকে। কিন্তু নারীদের জন্ম থেকে শেখানো পাঠ তা প্রকাশ করতে দেয় না, বা সংযত রাখে। সেই সংযত আর অবনত দৃষ্টি নারী যেকোন সময় ভাঙতে পারে চাইলে। সুতরাং পোশাকের ব্যাপারটা পুরুষও ভাবতে পারত!
বিয়ের জন্য ‘মেয়ে দেখা’ ব্যাপারটা কোরবানির গরু দেখার মতোই। মেয়ের গায়ের রং, “একটু হেঁটে দেখাও তো মা”, চুলের দৈর্ঘ্য, মেয়ে কতটা বাধ্য, অনুগত, পুরুষস্পর্শহীন, রন্ধন শৈলী বা বাড়ির কাজে কতটা পটু, এসবের মধ্যে নিহিত অশ্লীলতা আমরা ভান করি যে বুঝি না। আর মেয়েটির ভেতরের লজ্জা অপমান, প্রত্যাখ্যাত হবার যন্ত্রণা আপন মা’ও কি অনুভব করে সবসময়? পুরুষকে কিন্তু এত যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না। সে বিচারকের আসনে বসে তার যা পছন্দ সে রায় দিয়ে হয় গ্রহণ করে নয় পিঠ ঘোরায়।
যাই হোক, বিয়ে শাদী করলে, মেয়ের উপর নানা সংস্কার চাপানো হয়। স্বামীর খাওয়ার পর তার এঁটো পাতে খাওয়া, হাতে গলায়, নাকে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য গহনা পরা,ডান পা আগে ফেলা ইত্যাদি। আর, সিঁদুর, শাঁখা, মঙ্গল সূত্র, ব্রত, রোজা এগূলো তো ধর্মারোপিত। আমি এখনো জানি না, বিয়ের পর পুরুষদের কি সংস্কার পালন করতে হয়?
খাদ্য গ্রহণ প্রাণী মাত্রই প্রয়োজন, কিন্তু খাদ্য প্রস্তুত শুধুই নারীর কর্তব্য। সন্তান প্রতিপালনও তাই। এক্ষেত্রে পুরুষের সহায়তা পুরুষের জন্য মর্যাদাহানিকর। কেউ যদি একটু সাহায্য করে ফেলে তার স্ত্রী গলা ফোলা পায়রার মতো সেই কথা ডগমগ করে আজীবন বলেই যাবে, অথবা সেই পুরুষের আমরা নাম দেব “বউ ভারুয়া”। নারীর দৈহিক চাহিদা ভাবা হয় না, কিন্তু পুরুষটিকে নারীর সন্তুষ্ট করতে হয়। নারীর ইচ্ছে না থাকলে, ম্যারিটাল রেপ কোনো ব্যাপার না। পুরুষের ইচ্ছাই সব। এদেশে রোজ হচ্ছে। আর ম্যারিটাল রেপ বিষয়টা আমাদের মেয়েরাই বোঝে না। তারা ভাবে, “স্বামীই তো রেপ করবে!”
এদেশে একটা মেয়েকে রেপ করলে রেপিষ্ট আজীবন রেপ করার লাইসেন্স পায় বিয়ের মাধ্যমে। কারণ মেয়েটি রেপিষ্টের স্ত্রী হয়ে ফিরে পায় ‘হৃত সম্মান’!
নিজের নাম পরিবর্তন করে স্বামীর মালিকানাধীন হওয়ার ব্যাপারটা মেয়েরা আগ্রহ নিয়েই করে। পুরুষ কি কখনো স্ত্রীর পদবী গ্রহণ করে? বিয়ের পর পড়াশোনা, শখ, পোশাক, চাকরি, ব্যবসা সবগুলোয় থাবা বসায় পুরুষ। আচ্ছা, কোনো মেয়ে কি পেরেছে পুরুষের জীবন থেকে পড়াশোনায় যতি টানতে, তার ইচ্ছেগুলো পূরণে বাধা হতে?
সন্তানহীনতায় প্রথম আর প্রধান আঙ্গুল নারীর দিকেই ওঠে। নারী শিশু জন্ম দিলেও। অজ্ঞানতার কারণে নারীকে কত দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা লিখে শেষ করা যাবে না। সন্তানহীনটায় নারীর দোষ থাকুক বা না থাকুক, স্বামী সে অজুহাতে করতে পারেন দ্বিতীয় বিয়ে।
সম্পত্তির অর্ধেক নারী পায়, পুরুষ পুরো পায়। ধর্ম, সমাজ স্বীকৃত এই বিষয়গুলোর যৌক্তিকতা অনেকেই বড় গলায় প্রচার করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নারী আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত, শোষিত। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয়, নারীর প্রয়োজন আছে কিন্তু তাকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই সকল সংস্কার নারীকে দিয়ে পুরুষ উপভোগ করে পৃথিবীকে।