জাহানারা নুরী

কথা সাহিত্যিক জাহানারা নুরী একজন হিউম্যান রাইটস একটিভস্ট।

সংকর বিবাহের দায় শুধু অপুর একার?

বাংলা সিনেমার নায়ক শাকিব শুনলাম তার সহকর্মী এবং স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। পত্রিকামতে অপু যে তার স্ত্রী এবং তার সন্তান শাকিবেরই সন্তান এই সত্য কথাটা বাজারে চাউর হবার আগে তিনি অপুকে বিবাহ সম্পর্কে নিরব থাকতে সম্মত করিয়েছিলেন। ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা, ঘটন- অঘটন-নায়ক শাকিবের হাতে অপু কতোখানি সারেণ্ডার করে ছিলেন-সন্তান নিয়ে শাকিবের আচরণে তার কিছূ আঁচ পাওয়া যায়।

সন্তানকে অস্বীকার করার পূর্ব পর্যন্ত অপু নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে শাকিবের জীবনে থেকে গিয়েছেন। আপত্তি করেন নি। হয়তো ভেবেছেন তাতে শাকিবের এবং সাথে তারও ফিল্ম ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। একঅর্থে শাকিবকে কেন্দ্র করেই তো তার ফিলম্ ক্যারিয়ার গড়ে ওঠা। তাকে সিনেমায় নিজের পাশে নিয়েই শাকিবেরও উত্থান।

তবে শাকিব অপু যখন একের পর সিনেমা করে যাচ্ছে তখনও আমরা জানি তিনি অপুকে বিছানায় নিচ্ছেন, বিয়ে করুন বা না করুন, অপু তার চব্বিশ ঘন্টার ভেতর আটকে ছিলেন। অপু অন্য কোনও সিনেমায় অভিনয় করতে পারেন নি। করতেও চেয়েছেন কি না সে আলাদা কথা। একজন অভিনেত্রী শুধু একজনেরই ছবিতে সারা জীবন অভিনয় করেন না। সেটা তার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠার পক্ষে আদৌ মঙ্গলজনক নয়। তথাপি অপু শুধু শাকিবেরই ছবিতে অভিনয় করেছেন। কেনো? কারণ শাকিব। শাকিবের জবরদখল, আবদার থেকে উদ্ভূত জোর, মানসিক বল প্রয়োগও তার পেছনের কারণ। অপু পুরোপুরি শাকিবের হাতের মুঠোয় ছিলেন। আমি আর কোনও অভিনেত্রীকে নিজের ক্যারিয়ার এইভাবে সারেণ্ডার করে একজনের জীবন গড়তে এবং নিজের ক্যারিয়ার ও জীবন ধ্বংস করতে দেখি নি।

অপু ভিন্ন। তিনি আসলে ক্যারিয়ারিষ্ট হতে পারে নি। তিনি শাকিবের প্রেমিকা হয়েছিলেন। তার জীবন সঙ্গিনী হয়েছিলেন। স্বীকৃতি পান বা না পান তিনি শাকিবের সাথে থেকেছেন। আর তার এ ভালোবাসার ঔদার্য থেকে ফায়দা লুটেছেন শাকিব। তিনি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের একজনকে দিয়ে নিজের যৌন ক্ষিধে মিটিয়েছেন, সন্তানের ক্ষিধে মিটিয়েছেন, ইণ্ডাস্ট্রির ক্ষমতাশীল একজন হবার লোভ মিটিয়েছেন-যখন অপু তার ঘরের শান্তি রক্ষা করেছে। অপু প্রশ্নহীন তার ঘরে অধিষ্ঠিত থাকাতেই নিজের ক্যারিয়ার, ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির লীডারশিপ এইসব নিয়ে শাকিব দাপটের সাথে দাপিয়ে বেড়াতে পেরেছেন। এটা ইন্ডাস্ট্রিরই কালচার হয়তো। কিন্তু তাতে এর ভেতরের অন্যায়টা প্রতিষ্টা হয় না। হতে পারে না।

এখন ঢালিউডের এই সুযোগসন্ধানী নব্য বখতিয়ার অন্য কোনও হিন্দুস্তান বা পাকিস্তান দখলের অভিযানে চলেছেন। নায়িকা হিসেবে অপুর দাম তার কাছে ফুরিয়েছে। সুতরাং জীবন থেকেও অপুকে এখন বের করে দিতে হবে। পুরোটাই একটা অবিশ্বাস্য ইমোশনাল, আর্থিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার ঘটনা।

অপু যদি এত অন্ধভাবে তাকে ভালো না বাসতেন, ও প্রথাগত স্ত্রীর মতো তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ না করতেন তবে শাকিবের পক্ষে তাকে ছাড়া আরো সহজ হতো। তিনি এটা মিউচুয়ালি সেটল করে ফেলতেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তিনি এখন ধর্মের দোহাই দিয়ে মাথায় টুপী এঁটে নিয়েছেন।  ঢালিউড এখন মুসলমান হয়ে যাবে। তার পক্ষ নেবে। শাকিবকে আমি একটা সাজেশন দেই..আপনি বরং এখন পাঞ্জাবী পায়জামা পরে বিবি খাদিজার জীবনী নিয়ে সিনেমা বানান আর শাবানাকে হিজাব পরিয়ে নাায়িকার রোল দিয়ে দেন। তাহলে অনন্ত জলিলকে পেছনে ফেলে আগামী ইলেকশনে জামাত ই ইসলামের নমিনেশনের রাস্তা ক্লীয়ার হয়ে যাবে। ঢালিউডকে “রাবাতে আল ইসলামিক ফিলম্ ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ” নাম পাল্টে দেয়া যেতে পারে। সব নষ্টের ‘সুন্নাহই একমাত্র আশ্রয়’।

বাংলার পুত্র-কন্যাগণ, আপনাদের মুসলিম পারিবারিক আইন ও বিবাহ নিয়ে ভাবতে বলি। যে ধর্মেরই হোন না আপনি- ভাবুন একটু।  না ঘাবড়াবেন না। ধর্ম পাল্টানোর কথা বলবো না। মানুষ হিসেবে আপনি আপনার বোনের, মায়ের, বন্ধুর, প্রেমিকার একটিমাত্র ন্যায্য অধিকারের কথা ভাবুন। একটি মেয়ে তার জীবনের সর্বস্ব দেবে, কোনও বিকল্পের দিকে কখনো তাকাবে না। তারপর একদিন সে তালাকি কিম্বা পরিত্যাক্তা হয়ে খালি হাতে প্রস্থান করবে- যখন তারই শ্রমে, দানে, ত্যাগে তিতিক্ষায় তার ও তার স্বামীর পরিবারের সব সম্পত্তি, আরাম-আয়েশ সৃষ্টি হয়েছে। বৈবাহিক কালে স্বামী যা আয় করবে তার অর্ধেক স্ত্রীর পাওনা হতে হবে।  এটা স্ত্রীদের দাবী করার সময় এসেছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটি একটা ন্যায্য ভাবনা।

আমি মনে করি অপুর ঘটনায় তার তিনটি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

প্রথমতঃ শাকিবের মুষ্ঠির ভেতর থাকায় সে স্বাধীনভাবে বিবাহের সময় তার ধর্ম বিষয়ে কথা বলতে পারে নি, প্রিয় মানুষটি যা বলেছে তাই করেছে, ধর্ম ত্যাগ করেছে। ধর্ম ত্যাগ না করার তার অধিকার ছিলো। শাকিব তাকে কোর্টে আইন মতে বিবাহ করতে পারতো-ধর্ম না পাল্টে। বিয়েতে একটা চালাকি হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি ও লোক জানাজানির কথা বলে নিরবে বিবাহ সারার চেষ্টা হয়েছে। যা কিছু নিরবে করা হয়, তার ভেতর সমস্যা থাকে, প্রবঞ্চনা থাকে। যে প্রেমিক প্রকাশ্যে বলতে পারে না সে ভালোবাসে, সে পৃথিবীর সেরা লোক হোক না কেনো, নারীদের তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসা উচিত। শাকিবের ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির কাছে অপুর সারল্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটাও প্রতারণা মাত্র।

দ্বিতীয়তঃ অপুর কাজের মানবাধিকার মারাত্মকভাবে প্রতারিত ও  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ইন্ডাস্ট্রির অবস্থানকে অপমান করেছে শাকিব ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবস্থান থেকে। তার ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনও অধিকার শাকিবের নেই। এই ক্ষতির মূল্য শাকিবকে দিতে হবে। আমি আশা করি ঢালিউড শাকিবের পাশে না দাঁড়িয়ে অপুর ক্যারিয়ার পূণর্গঠনে তার পাশে দাঁড়াবে এবং পুত্রের বেড়ে ওঠার সুস্থ পারিবেশ রক্ষার্থে শকিবকে পিতার পূর্ণ দাায়িত্ব পালন করতে চাপ প্রদান করবে।

তৃতীয়তঃ শাকিব পিতা হিসেবে তার পুত্রকে অপমান ও অপদস্ত করেছে। অপুর সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। কিন্তু সেই সম্পর্কের অবনতির ভার সে কেনো শিশু পুত্রের ও তার মায়ের ওপর চাপিয়ে দেবে? কেনো তার পুত্রকে এর বেদনা বহন করতে সে বাধ্য করবে? অপুর সাথে তার এমন একটা বোঝাপড়া করা উচিত ছিলো যেন অপু কাজ করতে গেলে শাকিব নিজে পুত্রকে দেখাশুনা করতে পারে। শাকিব সেই কাজটি কেনো করে নি? অপুকে তালাক দিয়ে দিলেও পুত্রের প্রতি পিতা হিসেবে তার দায়িত্ব তাকে পূর্ণভাবে পালন করতে হবে। অপুর ক্যারিয়ার বন্ধ করে সেটা করার চেষ্টা করলে হবে না। কিন্তু সে করেছে এবং কাজটি করে  শাকিব ও তার ফিল্ম দেখে উল্লসিত হওয়া স্ত্রী পেটানো অন্য দশটা অপরিণত-মনষ্ক পুরুষ-যারা তার ছবি দেখে যৌন সুড়সুড়ি পায়- তাদের সমপর্যায়ে তিনি নিজেকে নামিয়ে এনেছেন। সিনেমার সস্তা টিকেটের দর্শকরা গ্রহণ করলেও কেনো শিল্পী সমাজে এই শাকিবকে গ্রহণ করতে হবে? কেনো আইনের সামনে মানবাধিকারের ন্যায্যতার সামনে সে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না? 

ঢালিউডে শিল্প বা আর্ট বলতে যা বোঝায় সে নন্দন কাননে এই চরিত্র একটা নগণ্য ঘুনপোকা ব্যতীত আর কিছুই নয়। ঢালিউডের তাকে না হলেও চলবে।

আমি চাই না অপু নিরবে এই ডিভোর্স  লেটার হাতে নিয়ে কাঁদুক।

আমি চাই অপু লড়াই করুক।

আমি চাই অপু মাথা তুলে দাঁড়াক।

আমি চাই শাকিব তার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত কি কি করেছে সে সব পাবলিক করুক।

আমি চাই সে বলুক কিভাবে সে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। কিভাবে সে সুদীর্ঘকাল শাকিবের স্ত্রী হওয়া স্বত্ত্বেও সে দেশের সামনে নিরব ছিলো।

অপু তুমি লড়াই করলেই তোমার ভক্তদের পাশে পাবে। মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করলে তুমি একা হয়ে যাবে। একা হয়ো না। লড়ো।

2857 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।