“আমরা নারী আমরাই পারি পেইজে” এ সমকামিতা বিষয়ে আমরা মাঝে মাঝেই মেসেজ পাই। এডমিনরা সাধ্যমত তাদের সাহায্য করার চেষ্ট করে।
মাস তিনেক আগে একটা মেয়ে পেইজে মেসেজ পাঠালো। সে আমার সাথে কথা বলতে চায়। জানতে চাইলাম কি বিষয়ে কথা বলতে চান? সে বললো আপু প্লিজ আপনি আপনার ইনবক্স চেক করুন। আপনি যদি কোনো উত্তর না দেন আমার আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমি চমকে গেলাম, মেয়েটার ছবি দেখে মনে হলো তার বয়স ২৮-২৯ এর কম না। তার মানে সে মোটেও বাচ্চা মেয়ে না। দেখে শিক্ষিতই মনে হলো। আইডিটাও তার ফেইক না। এমন কি হলো, সে আত্মহত্যা করতে চায়!
আউটবক্সে থেকে মেসেজ ওপেন করে পড়তে শুরু করলাম। মেয়েটার অনুমতি নিয়ে মেসেজের কিছু অংশ তুলে দিলাম। মেয়েটা লিখেছে,
আপু,
আপনাকে বিশ্বাস করি। জীবনে কাউকে কে না কাউকে বিশ্বাস করে সত্যিটা বলতে হয়। আমার মনে হয়েছে আপনাকে বলা যায়। আজকে চার বছর ধরে একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক। আমরা একে অন্য কে ভালবাসি। আপু এটা বন্ধুত্ব নয় এটা প্রেম। আমি বিশ্বাস করি আপনি আমাকে অন্যদের মতো নোংরা ভাববেন না। আপু প্রথম যখন বুঝতে পারলাম আমি একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি তখন মনে হইছে আমি পাগল হয়ে গেছি। আপু নামাজ পড়ে শুধু কাঁদতাম। আল্লাহ্ কে বলতাম কেনো আমার এই রোগ হলো। কিন্তু মন কে বুঝাবার ক্ষমতা আমার ছিলো না। মেয়েটিও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়তাম। গতবছর আমার পরিবার আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়। সমাজের কথা ভেবে, আব্বা আম্মার ভালোর জন্য আমি বিয়েতে রাজি হই। কিন্তু আমি আমার স্বামীকে মেনে নিতে পারি নাই। তার সাথে আমার যতবার শারীরিক সম্পর্ক হইছে ততবার আমার আনিচ্ছায় হইছে। আপু আমার স্বামী বারবার জিগ্যেস করে আমার কি হইছে? আমি তাকে কীভাবে বলবো যে আমি তাকে ভালোবাসি না। আমি কোনো পুরুষ কেই ভালোবাসতে পারবো না। আমার ভালোবাসার মানুষটাও ভাল নাই। তাকে তার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সে বলেছে সে আত্মহত্যা করবে।
আপু আমরা এখন কি করব আপনি বলে দেন?
মেয়েটির মেসেজ পড়ে ধাক্কা খেলাম। মেয়েটি বিজ্ঞানমনস্ক নয় যে তার এই বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা সে দাড় করাবে। সে খুব সাধারণ বাঙালি পরিবারে জন্ম নেয়া বিশ্বাসী মেয়ে।
প্রশ্ন হলো সমকামী হওয়ার জন্য তার কি আত্মহত্যা করা উচিৎ?
যে কম্পিউটারটা দিয়ে আজ লিখছি এই আধুনিক কম্পিউটারের জনক অ্যালান টুরিং এর আবিষ্কার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলো। এই মানুষটি আত্মহত্যা করেছিলেন কারণ সমাজ তার সমকামী হওয়া কে মেনে নিতে পারে নি। অথচ তার অর্জনের সুফল আমরা সবাই ভোগ করছি। প্রাণী জগতে প্রায় ৫০০ প্রজাতি আছে যারা সমকামী। সমাকামীতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ হলে অনেক আগেই এসব প্রাণীরা ধ্বংস হয়ে যেতো। মানুষের মধ্যে সমকামী সেই আদিম কাল থেকেই ছিল। তবুও সমকামীর সংখ্যা স্বাভাবিক মানুষের থেকে অনেক কম কারণ প্রজনের বিষয়টা কে প্রকৃতি চমৎকার ভাবেই ব্যালেন্স করে। তাই সব কিংবা অধিক মানুষের সমকামী হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
যদি ধরে নেই এই সমাকামীতা একটা রোগ তাহলেও সমকামী মানুষটা কে আপনি ততক্ষণ অপছন্দ করতে পারবেন না যতক্ষণ সে আপনার কোনো ক্ষতির কারণ হয়। এটা ছোঁয়াচে রোগ না যে আপনারও হবে। আপনি এটাকে পাগলামি বলতে পারেন, অনেকের কাছে প্রেমটা পাগলামি, অনেকের কাছে চিৎকার করে গান গাওয়া পাগলামি, জোরে হাসা পাগলামি, বৃষ্টিতে ভেজা পাগলামি, কিন্তু এই পাগলামিটা কোনো দোষের কিছু না যতক্ষণ না এটা আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করছে।
সমকামী মানেই সারা দিন সেক্স করা না। তারা আমাদের মতোই স্বাভাবিক ভাবে সব কাজ কর্ম করে, খায় দায়, ঘুরে বেড়ায়, যারা ধার্মিক তারা ধর্ম পালন করে।
শুধু তাদের ভালোবাসার ভাষাটা আমাদের থেকে ভিন্ন। আপনি আমি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি তারা সম লিঙ্গের প্রতি করে।
তাও সবার প্রতি না শুধু যে মানুষটি কে ভালোবাসে তার প্রতি এবং সেই ভালোবাসার মানুষটিও তার মতোই সমকামী হয়। তাই সমকামীদের নিয়ে ভয় বা ঘৃণার কিছুই নেই। এই মানুষগুলো প্রচণ্ড দুঃখী। তাদের সমকামী হবার জন্য তাদের কোনো দোষ নেই। কিন্তু এর দায় তাদের বহন করতে হয়।
যে মেয়েটি আমাকে চিঠি লিখেছে ওর কষ্টটা হয়তো আমি বুঝব না কিন্তু এটা বুঝি মেয়েটি রোজ রেপ হচ্ছে। সে তার জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে ফেলেছে। সে প্রচণ্ড দুঃখী একটা মেয়ে।
আমি এই দুঃখী মেয়েটির পাশে আছি। সে আমার বোন, আমার মতোই তার ভালোবাসার অধিকার আছে। আমি তার ভালোবাসা কে সম্মান করি।