সৌম্যজিৎ দত্ত

লেখক, ব্লগার, আইএসআই তে লেকচারার এবং গবেষণারত ছাত্র।

সমাজের সাথে বাংলা ভাষাও আজ অস্তগামী

“বাংলা আমার মনের ভাষা। বাংলা আমার কথার ভাষা। বাংলা আমার লেখার ভাষা, আমার প্রেমের ভাষা। বাংলা আমার উচ্চারণ। বাংলা আমার মাতৃভাষা।”

তোলপাড় চলছে চারিদিকে। খুন, ধর্ষণ তো রোজকার দিনে সংবাদমাধ্যমে দেখে দেখে জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা নারীকে ধর্ষণ করে, নারীকে নিজের খাদ্য ভাবে এবং দাস বানিয়ে রাখে। দশ দিনের বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে, সে দশ বছরের বাচ্চা হোক বা তিরিশের কোনো মহিলা, বা আশি বছরের বৃদ্ধা, কারোর নিস্তার নেই। কাঁটাতারের সীমানা ভারত ও বাংলাদেশকে আলাদা তো করেছে, কিন্তু রোজকার দিনের গল্প দুটো দেশেই একইরকম। ধর্ষণ, খুন, মানুষ বৈষম্যের রাজনীতি, দেশজুড়ে তোলপাড়, আলোড়ন, সমালোচনা, প্রতিবাদ, মিছিল। আর যেটা হয়, তা হলো ভাষার অপমান।

ভারতে কাশ্মীরের কাঠুয়াতে আট বছরের আসিফাকে মন্দিরে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনা, কলকাতার বুকে মেটিয়াব্রুজে বিনোদ দাসের নাবালিকা মেয়েকে গত দশ মাস আটকে রেখে রোজ ধর্ষণ, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র হয়ে ইশার অন্য ছাত্রদের ওপর অমানবিক অত্যাচার, এই ঘটনাগুলি বারেবারে প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র যতই ডিজিটাল পৃথিবীর দিকে অগ্রসর হোক, সমাজের কোনো অগ্রগতি নেই। ভারতজুড়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনায়। সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অসম যুদ্ধ বেঁধেছে।

ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এক নির্মম সত্য বাইরে চলে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ইশরাত জাহান ইশা হলের বাকি ছাত্রদের ওপর দিনের পর দিন নির্মম এবং অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে গেছে। ছাত্ররা অসহায় হয়ে ওঠে ওই অত্যাচারে। অবশেষে মিলিত হয়ে বিদ্রোহ করে। ছাত্রলীগের নেত্রী ইশাকে সম্মিলিতভাবে জুতোর মালা পরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়, আবার  নাটকীয়ভাবে একদিন পরই ফুলের মালা পরিয়ে তাকে সংবর্ধনা জানিয়ে, ফিরিয়ে আনা হয়, নেত্রী পদে পুনরায় বহাল করা হয়।

ইশা যা করেছে, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। অমানুষের মতো অমানবিক আচরণ করেছে। ছাত্রলীগের উচিৎ ছিলো ওকে ছাত্রলীগ থেকে সম্পূর্ণ বহিষ্কার করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেওয়া, যাতে তিন মাস পর ফেরত এসে অন্তত মানবিক শিক্ষার পাঠ নিতে পারে, শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরতে পারে মানুষ হওয়ার জন্য। একজন ছাত্রকে জুতোর মালা পরিয়ে প্রথমে বহিষ্কার করাকে মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক তেমনই, আগে জুতোর মালা পরিয়ে বহিষ্কার করা এবং একদিন পরই ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত পরিকাঠামোকে উদ্দেশ্যহীন করে তোলে, হাস্যকর করে তোলে। এরপর হয়তো ইশা অধিকতর আক্রমণাত্মক, অধিকতর অমানুষ হয়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কখনো "রাজনীতি করা বা রাজনীতিক গড়া" হওয়া উচিৎ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সবসময় "মানুষ গড়া" হওয়া উচিৎ।

এই রাজনীতি, এই প্রতিবাদ, এই বিশৃঙ্খলতা, উশৃঙ্খলতা সমাজকে বিভীষিকাময় অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সমালোচনা হচ্ছে। আর সমালোচনার উত্তরে, প্রতিবাদের ভাষাতে প্রকাশ পাচ্ছে ভাষার অপব্যবহার, অশ্লীলতা। ভাষাকে বিকৃত করে সমাজ তার গায়ের জ্বালা মেটাচ্ছে। ভাষার বিকৃতি ঘটিয়েই যেন গায়ের জোর দেখাতে চাইছে, ভাষার মধ্যে দিয়েই যেন ধর্ষণ করতে চাইছে।

আমি শঙ্কিত। যেভাবে ভাষার ব্যবহার মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে, একদিন এমন না হয় যে আমার বাংলা ভাষা আর প্রকৃত বাংলা ভাষা থাকলো না। বিকৃতির ধারাকে বজায় রেখে বাংলা ভাষার অর্থটাই হয়তো হয়ে উঠবে অশ্লীলতা।

বাংলা আমার প্রকাশ, বাংলা আমার চেতনা, বাংলা আমার ঐতিহ্য, বাংলা আমার গর্ব, বাংলা আমার অহংকার। অথচ এই বাংলাই হয়তো একদিন হয়ে উঠবে আমার লজ্জা। আমি একজন ছাত্র এবং একজন শিক্ষক হয়ে বর্তমান ছাত্রসমাজকে দেখে ভীত। ওদের ভাষা শুনে আমার ঘেন্না হয়। ওদের ভাষা শুনে আমার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ভয় হয় আমি হয়তো একদিন আমার সোনার বাংলাভাষাটাকে হারিয়ে ফেলবো চিরতরে!

ওদের মুখে বলার জন্য বাংলা ভাষা তো আছে, ভাষাতে কোনো ভালোবাসা নেই।

21571 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।