ছেলের বউ শাশুড়িকে ভক্তি করলে সেই বউ সকলের প্রণম্য হয় বা প্রশংসা পায় আর মেয়ের জামাই শাশুড়ির সেবা করলে সংসার, সমাজ এবং গণমাধ্যম তারে হাস্যষ্পদ করে উপস্থাপন করে। বউ এর মাকে সম্মান ভক্তি করা মানেই সেই পুরুষ "জরু কা গোলাম"। বউয়ের পালা পোষা। বউ এর পালা পোষা হওয়া খুবই লজ্জ্বার আর অপমানের বিষয়। "স্ত্রৈণ" একটা বিরাট গালি। কোনো পুরুষ যদি তা হয়েও থাকেন বুক ফুলিয়ে একথা লোকসমাজে বলেন না। অপরদিকে স্বামীর বাধ্য নারীরা সবার কাছে আদরনীয়া হন।
আবার বউকে ভয় পেয়ে চলা বিরাট লজ্জ্বার বিষয়। কোনো পুরুষ যদি বিশেষ কোনো কারণে বউকে ভয় পান তবে তাকে বন্ধু এবং আত্নীয়মহলে খুবই লজ্জ্বায় পড়তে হয়। "তোরে তো তোর বউ পাহারা দ্যায়"-এই কথা বলে খুব অপমান টপমান করা যায় পুরুষটারে। আর স্ত্রী যদি স্বামীকে ভয় পান তাহলে কোনো অসুবিধা নাই। এইটা সমাজে প্রচলিত। অথচ মানুষের সম্পর্কের জন্য "ভয়" বিষয়টাই যে অস্বাভাবিক এবং অবমাননাকর সেটা আলোয় আসে না।
নারী হলো দুর্বল। নারীর সাজপোশাকও তাই। সিমন দ্য বুঁভ্যেয়র এর দ্যা সেকেন্ড সেক্স অনুবাদক আমাদের এক নম্বর প্রথাবিরুদ্ধ লেখক শাড়ির বদনাম করেছিলেন এইভাবে যে, "বাঙালী মেয়েদের প্রধান পোশাক শাড়ি যা পরে কেবল শুয়ে থাকা যায়"। শাড়ি পরে বন্দুক নিয়ে মার্চপাস্ট করার স্মৃতি তার মনে ছিলো না। প্রীতিলতা শাড়ি পরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করে ফেলেছিলেন সেই স্মৃতিও তার মনে ছিলো না। শাড়ি অসুবিধাজনক পোশাক হতেই পারে কিন্তু সেইটার বদনাম করতে গিয়ে "শুয়ে থাকা"র যে তুলনা তিনি টানলেন তা লেখকের ভাষা এবং ভাবনার চমক অবশ্যই কিন্তু নারী হিসেবে কেনো জানি আমার একটু জ্বালাপোড়া করে আর কি! উনি জানতেন না যে কারো কারো বরং শাড়ি পরে শুইতেই অসুবিধা হইতে পারে!
নারীর প্রসাধনও পুরুষের জন্য অপমানজনক। যে কোনো অন্যায় বা অবীরোচিত কাজ করলে বলা হয়, হাতে চুড়ি পরে বসে থাকেন। কোনো পুরুষ ঠোঁটে একটু লিপিস্টক মাখলে তার জাত পুরাই যায়। চুড়ি হলো নারীর মানে দুর্বলের অলংকার সেইটা শুধু হীন পুরুষেরাই পরবেন।
কোনো পুরুষ নির্যাতনের শিকার হলেও সেটা নিয়ে হাসিঠাট্টা চলে। বউ এর দ্বারা নির্যাতিত পুরুষ মানেই ভেড়া। এই ভেড়াত্বর তকমা যাতে না লাগে শুধু এই কারণেই কত পুরুষ যে তার প্রতি ঘটা সত্যিকারের অন্যায়ের কথা মুখ ফুটে বলতেই পারেন না! কিন্তু বিভিন্ন নারীর সাথে নিজের পছন্দমতো সম্পর্কে যাওয়া পুরুষদের বউ বা পার্টনার যদি প্রতিবাদ করেন সেইটারেও পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে বলে চালায়ে দেন অনেকে। কি যে সার্কাস!
একজন যৌন নিপীড়ককে পেটানোর জন্য ধাওয়া করছেন একটা মেয়ে-এই ধরনের ছবি এবং সংবাদের নীচে হাহা রিঅ্যাক্ট পড়ে। যৌন নির্যাতন করে নারীর কাছে মার খাওয়াও একটা ঠাট্টার বিষয়। মানে যৌন নির্যাতন করেন অসুবিধা নাই, করলে আপনি হ্যাডমওয়ালা ব্যাডা, আর ধরা খাইলে তখন ব্যাডা না, ব্যাডাত্ব ঠিকঠাক মতো দেখাইতে পারলেন না, ধরা খাইলেন অতএব আপনার জন্য হাসি।
গণমাধ্যম বিশেষত বাংলার গণমাধ্যম নারীকে হয় খান্ডারনী না হয় বিপদগ্রস্ত অথবা ফুলের মতো কমনীয় দেখাতে অভ্যস্ত। সে জীবন মানে জি বাংলার গোপাল ভাঁড় এর বউই হোক অথবা শাকিব খানের নায়িকা বুবলি। এদিকে সংবাদমাধ্যমে মুন্নী সাহার ছোট চুল আর সাম্প্রতিক নিকোলের ইংরেজি উচ্চারণ-নারীকে হেয় দেখাতে যা যা দরকার সব মশলাই উপস্থিত।
"নারীই নারীর নির্যাতক, শাশুড়ির কাছে ছেলের বউ মার খায়"-এই অতিক্লিশে ধারণায় পুরুষেরা এখনও যেরকম বিমলানন্দ ভোগ করে তা দেখে আমার কেবল বিস্ময়ই জাগে।
তো এইরকম "নারীবান্ধব" সমাজে বসত করেও আমরা কি জন্য সারাক্ষণ নারীর অসুবিধা নিয়ে কথা বলি-এইটা অনেকে বুঝতেই পারেন না (তারা বিরক্ত হন এবং বলতে থাকেন সারাক্ষন আমরা একই প্যাঁচাল পারি, আমরা নারী-পুরুষে বিভক্তি তৈরি করি।) এত্ত ইনোসেন্ট আমাদের পুরুষকূল। আহা!