সাইফুল বাতেন টিটো

লেখক ও গণমাধ্যম কর্মী।

সকল দিবসটিবস দূরে ঠেলে দিয়ে নারীকে বুকের আঁচল কষে কোমরে বাঁধতে হবে

গত কাল এক লেখক বন্ধুর সাথে সাক্ষাত শেষে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন রামপুরার দক্ষিন বনশ্রীগামী টেম্পু স্ট্যান্ড থেকে এক গ্লাস অ্যালোভেরার জুস/বনাজী সরবত খেতে থামলাম। আমি প্রায়ই খাই এখান থেকে। শরবত ওয়ালা ২৩/২৪ বছরের এক ছোকরা। বাড়ী হবিগঞ্জ।

যেহেতু আমি প্রায় প্রতিদিন ওর ওখান থেকে শরবত খাই সেহেতু ওর সাথে একটা ’কেমন আছো’ টাইপের রিলেশন তৈরি হয়েছে। সপ্তাহ খানেক আগে এক বাকি খাওয়া টেম্পু ড্রাইভারের কাছে টাকা চাইতে গেলে ওকে যখন থাপ্পড় মেরেছিলো তখন আমি ঐ স্টান্ডে ছিলাম, এবং বিষয়টির কড়া প্রতিবাদ ও বিচার চেয়েছিলাম লোকজন ডেকে। কেউ ফিরেও তাকায় নি। ও বসে বসে গাল ডলেছে। তখন থেকে ওর সাথে হায় হ্যালোর পরিমাণ আরো বেড়েছে।

আমার খাওয়া যখন শেষ ঠিক তখন হঠাৎ করে বিক্রেতা ছোকরা তার সামনে থেকে যাওয়া একটা কাপল দেখিয়ে গলার স্বর একটু নামিয়ে আমাকে বললো - ‘এই চুতমারানি পত্তেক দিন এই ছ্যাড়ার লগে ঠাপ খাইতে যায়।’

আমি তব্দা খায়া গেলোম! কয় কি? আমি মগটা রাখতে রাখতে খুব শান্ত কন্ঠে বললাম
-তুমি মেয়েটাকে এতো নোংরা কথা বলছো কেনো? ও যদি তোমার বোন হতো? 
এবার ছেলেটা তব্দা খেয়ে খেলো। এবার আমি কন্ঠটা আরেক ধাপ চড়িয়ে বললাম
-ও তোমার খায় না পরে? তুমি ওকে এমন কথাটা কি দোষে বললে? 
ও বলল 'একদিন আমি এখানে কাজ করছিলাম আর আমার এখান থেকে ওর বয়ফ্রেন্ডের গায়ে পানি লাগছিলো, সাথে সাথে মাইয়াডা খেই খেই করে উঠলো। আমার মেজাজটা সেই থাইক্কা ওর উপর ভীষণ ক্ষেইপ্পা আছে। 'কথা গুলো বলার সময় চোখমুখ এমন করছে দেখে মনে হচ্ছে ঐ অপরাধে মেয়েটাকে সাজা হিসেবে রেপটেপ করার কথাও ভাবতে পারে। আমি যথারীতি শান্ত কন্ঠে আবার বললাম 'তোমার বোনের সাথে রাস্তায় যদি কারো এমন হতো আর সে যদি তোমার বোনকে নিয়ে এইসব কথা বলতো? কি করতে তুমি?' 
'আমার বোইন এমন করবো না'
এবার আমার রাগ হলো খুব। তারপরও শান্ত হয়ে বললাম 'তুমি এখন ঢাকার রামপুরায়, আমার তোমার বোন হবিগঞ্জের কোনো এক গ্রামে। সে সেখানে কি করছে বা না করছে সেটা তো তুমি জানো না, তাই না?' ও মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো 'হ তা ঠিক, কেউ তো কাউরে ২৪ ঘন্টা পাহারা দিয়া রাখতারে না'।

আমি ওর কাছ থেকে খুচরা টাকা ফেরৎ নিতে নিতে বলাম 'তুমি যে এইখানে বসে ব্যবসা করছো, এই যায়গাটা কার জানো? যে মেয়েটা তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে হেঁটে গেলো আর তুমি গালি দিলে, এই যায়গাটা আসলে ওর এবং ওর মতো হাজারো পথচরীর নিরাপদে হাঁটার জন্য। তুমি সেই যায়গাটা দখল করে ব্যাবসা করছো, ও হাঁটার সময় ওর গায়ে পানি যাচ্ছে, ওর তো তোমার নামে অভিযোগ করা উচিৎ! উল্টা তুমি ওকে গালাগাল করছো? সেদিন যে তোমাকে ঐ টেম্পু ড্রাইভার ধইরা থাপ্রাইলো তুমি তো তার বালটাও ছিড়তে পারলে না, ওকে এমন গালাগাল করছো কেনো? ও মেয়ে বলে? 

আমি বিদায় নিতে নিতে বললাম 'শোনো, দিন বদলাইছে। মেয়েরা এখন নিজেদের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা 'ক্রাভ মাগা' শিখছে। বিচিটিচি গলাইয়া জ্যুস বানাইয়া খাওয়াইয়া দিবো। সুস্থ চিন্তা করতে শেখো। সরকার আমারেও ক্রাভ মাগা শিখাইছে কিন্তু। আর যদি কোনোদিন এমন কথা শুনি- সত্যি তোমাকে মারবো।’ আমি জানি এই কথায় ওর কোনো কিছু যায় আসে না।

আমি যখন ছেলেদের মধ্যে থাকি তখন পাশ থেকে যাওয়া মেয়েটা সম্পর্কে মন্তব্য শুনে মনে হয় এরা সুযোগ পেলেই রেপ করবে।

মেয়েদের এরচেয়েও নোংরা কথা বলতে শুনছি প্রতিদিন, কিন্তু কাউকে কখনও একটুও প্রতিবাদ করতে শুনি নি।

প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসের সামনে কখনও নারী ড্রাইভার পরলে কারের ড্রাইভার যা বলে তা শুনলে তখনই খুন করতে ইচ্ছে করে।

আমার বাসায় একদিন সকালে আমাকে নেয়ার জন্য স্যুটিং ইউনিটের গাড়ী এসেছে। ড্রাইভার নিজেই গাড়ীর মালিক, তার দুইটা বাড়ী আছে সাতটা মাইক্রো আছে। তার অন্য তিনভাইও তার গাড়ী চালায়। সে ১৭ বছর ধরে মিডিয়ার ড্রাইভার, আমি তাকে আগে কখনও দেখি নি কেনো তা নিয়ে সে বেশ কিছু সময় বললেঅ।

১৯৯৭ সালে মিডিয়ায় পা রেখেও আমাকে শুনতে হলো আমি মিডিয়ায় নতুন তাই তাকে চিনি না। গাড়ি চলছে। এক সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলো আর কাকে কাকে তুলতে হবে? আমি বললাম। ঐ দিন কোনো একটা কারণে আমাদের স্যুটিং-এ কোনো নারী চরিত্র ছিলো না। ড্রাইভার আমার দিকে ফিরে বললো 'আরে বস এইডা কি কইলেন? মাগি নাই একটাও? মাগি মুগি না থাকলে ভাল্লাগে ভোদা?' বলে সে মুখে পান ঠেসে দিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরাতে লাগলো। আমার ইচ্ছে করছিলো একটা লাথি দিয়ে ওকে ড্রাইভিং সিট থেকে ফেলে দেই।

কিন্তু বাস্তবে আমি তাকে কিছুই করতে পারবো না, কাউকে অভিযোগও করতে পারবো না। কাউকে বললে হাসবে।

আমরা বিভিন্ন দিবস পালন করি নারী দিবস, মা দিবস। তখন আমার খুব হাসি পায়। চারপাশে যখন এরকম ঘটনা দেখি আর চেনা বিপ্লবীদের চুপচাপ থাকতে দেখি তখন মনে মনে ভাবি আমরা কত্ত ভন্ড! নারীর অবর্তমানে ধর্ম শাসিত পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের পুরুষদের একটা বৃহৎ অংশ নারীকে খুবই অবজ্ঞা আর অশ্রদ্ধা করে, প্রাণী মনে করে, মনে করে শুধুই যৌনদাসী। এখনও ৯৫% বিয়ের সময় ছেলেপক্ষ জানতে চায় মেয়ে ঘরের কাজকর্ম কেমন পারে। সে সন্তান উৎপাদন করবে, ঘরের কাজকর্ম করবে রাতের বেলা স্বামী যখন চাইবে দুই পা ফাঁক করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়বে। সে মহলে থাকবে। ব্যাস! মহিলা সে!

সকল দিবসটিবস দূরে ঠেলে দিয়ে নারীকে বুকের আঁচল কষে কোমরে বাঁধতে হবে। এটা ভাবলে কোনো ভাবেই চলবে না যে এই পৃথিবীর পুরুষ কোনোদিন ভালো হবে, সে পুরুষতান্ত্রিকতা ত্যাগ করবে, সমতা আসবে। না, এমনটা কখনওই হবে না। বরং শিশু কাল থেকে যেভাবে মা তার শিশুক মেরে ধরে শেখায় প্রয়োজনে সেভাবে শেখাতে হবে কিভাবে মানুষকে সম্মান দিতে হয়। আর সে কাজটা অবশ্যই তোমাকে করতে হবে নারী! পৃথিবীর সকল নারীকে মা দিবসের শুভেচ্ছা আর নারী জাতীর কাছে কৃতজ্ঞতা আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন বলে।

1504 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।