শৈলেন রায়

বাংলা বিভাগ অর্নাস চতুর্থ বর্ষ লালমনিরহাট সরকারী কলেজ

জীবনান্দিতা

নন্দিতা, ক্লাস ইলেভেন, আমার দুর্বলতা-আমাদের পাড়াতেই থাকে। আমি আপাতত স্নাতকপর্ব পার করে চাকরির চেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিকে-ওদিকে কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে বেড়াই। আর হ্যাঁ, অবসরে সময়-সুযোগ পেলেই আমি আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ এবং তাঁর কবিতায় ডুবে থাকি।

আমার “নন্দিতাপ্রেম”এর কথা নন্দিতা না জানলেও আমার বন্ধুরা জানতো। সেই বন্ধুরা, যারা সবাই একটা করে “নন্দিতা” জুটিয়ে ফেলেছে—তাদের ক্রমাগত “উৎসাহ” আর ভিতরের তাড়না থেকে তাই “চলো কিছু করে দেখাই” ভেবে মাঝে একদিন সাহস জুটিয়ে স্কুলফেরত নন্দিতাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলে ফেললাম, তোমার সঙ্গে ক’টা ব্যক্তিগত কথা আছে। আমাকে একটু সময় দেওয়া যাবে?

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই ভয় হচ্ছিলো, এবার না উল্টোদিক থেকে তেড়ে কিছু শব্দ এসে আমাকে স্রেফ উড়িয়ে দেয়। দেখলাম সে-সব কিছুই হলো না। নন্দিতা খুব ক্যাজুয়ালি বললো, এখন তো সময় নেই, পরে কখনও...দেখি। ব্যস! এরপর নন্দিতা উধাও।

সেদিনের সেই “দেখি”র প্রকৃত অর্থ অনুধাবন না করতে পেরে, সেই “দেখি” অনেকদিন হয়ে গেলো দেখে, একদিন ফের স্কুলফেরত নন্দিতাকে ধরবো বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, দেখা গেলো, সে পথ দিয়ে নন্দিতা নয়, নন্দিতার বোন, নবম শ্রেণি, ইপ্সিতা আসছে।সামান্য হতাশ আমি তবুও গলাটা যথাসাধ্য মোলায়েম এবং আন্তরিক করে ইপ্সিতাকে বললাম, আরে ইপ্সিতা, কেমন আছিস? আমার প্রশ্নের উত্তরে ইপ্সিতার একটুও ইতস্তত না করে “দারুণ আছি শৈলেনদা। তুমি কেমন আছো?” উত্তর শুনে কেনো জানি না মনে হলো, এমনকি ওকেও সম্ভবত এমন “হাই”, “হ্যালো”র মুখোমুখি মাঝে-মাঝেই হতে হয়। ফলে আমিও একটু নিশ্চিন্ত হয়ে এরপর ইপ্সিতার সঙ্গে আরও দু-চার মিনিট হাবিজাবি বকার পরেও নন্দিতার দেখা নেই দেখে ইপ্সিতাকে বলেই ফেললাম, কী ব্যাপার, তোর দিদিকে দেখছি না আজ। ইপ্সিতা ঠোঁটে একটা অর্থবোধক হাসি ঝুলিয়ে বললো, দিদির জ্বর হয়েছে, আজ স্কুলে যায় নি।

এরপর আর আমার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। তাই কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখিয়ে ইপ্সিতাকে বললাম, আমি চলি রে, পরে কথা হবে। ইপ্সিতাও হাত নেড়ে চলে গেলো।

ইপ্সিতার সঙ্গে দেখা হবার কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় তখন বাড়িতে আমি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ানোয় ব্যস্ত—দেখি, নন্দিতা-ইপ্সিতার বাবা শ্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মানে রবীনকাকু আমাদের বাড়িতে হাজির। রবীনকাকুকে দেখে প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম নন্দিতা তার বাবাকে কিছু বলেছে কিনা, ভয় পাচ্ছিলাম ইপ্সিতার কাছে নন্দিতার খোঁজ করেছি—সে জন্যেই রবীনকাকু এসেছেন কিনা। ভিতরে ভিতরে প্রবল ঘামছিলাম। তবু নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, কাকু, ভিতরে আসুন।

রবীনকাকু “ভিতরে” এলেন, চেয়ারে বসলেন—এবং প্রায় বিনা ভূমিকায় বললেন, শৈলেন, তুমি কি আমার মেয়ে ইপ্সিতাকে একটু ইংরেজিটা দেখিয়ে দিতে পারবে? মানে তোমার কি ওকে পড়ানোর মতো সময় হবে?

বলাই বাহুল্য এমন একটা দুরন্ত প্রস্তাবের জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তবু রবীনকাকুর অমন প্রস্তাব শুনে আমি সে মুহূর্তেই মনে মনে দেখলাম, আমি ইপ্সিতাকে ইংরেজি পড়াচ্ছি... লোডশেডিং... হ্যারিকেনের আলো... চায়ের কাপ হাতে নন্দিতার প্রবেশ... হ্যারিকেনের লাল আলো... নন্দিতার উজ্জ্বল মুখে স্বর্গীয় আভা...।

হয়তো আরও অনেক কিছু ভাবতাম—সংবিৎ ফিরলো রবীনকাকুর কথায়, কী হলো শৈলেন, তোমার কি সময় হবে না? 
—হ্যাঁ, হ্যাঁ কাকু, হবে, সময় হবে। আমি তাড়াতাড়ি উত্তর দিলাম।
—তুমি কি কাল থেকেই পড়াতে পারবে? ফের রবীনকাকুর স্পষ্ট প্রশ্ন।
রবীনকাকুর প্রশ্ন শুনে মনে মনে বললাম, কাকু, পারলে তো আজ থেকেই পড়াই... মুখে বললাম, ঠিক আছে কাল থেকেই যাবো। কাল সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা নাগাদ ইপ্সিতাকে তৈরি থাকতে বলবেন। সপ্তাহে তিনদিন পড়াব। তাতে হবে তো?

এবার রবীনকাকু আমাকে হতাশ করে বললেন, তিন দিন হবে না হে, ওটা তুমি দু-দিন করো। অন্যান্য সাবজেক্টেরও তো পড়ার চাপ আছে।

রবীনকাকুর উত্তরে সামান্য ঝিমিয়ে পড়া আমি বললাম, ঠিক আছে কাকু, সপ্তাহে দু-দিন। বুধবার আর শুক্রবার। ভালোই হলো কাল শুক্রবার পড়েছে...

—আর ইয়ে, ওই টাকা-পয়সার ব্যাপারটা...। রবীনকাকু থেমে থেমে বলেন।
—আরে ওটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না কাকু। আপনি বাড়ি যান।
—না, না, তবুও...
—বললাম তো, আমি ঠিক সময় বলে দেবো।

রবীনকাকু নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। আনন্দে সে রাতে আমার ভালো করে ঘুম হলো না।

পরদিন সন্ধ্যায় “ভট্টাচার্য” বাড়ির সদর দরজার মাথার উপরে বসানো কলিং বেলটা চেপে ধরার দেড় মিনিটের মধ্যে এলোমেলো পোশাকের উপর একটা চাদর জড়ানো যে এসে হাজির হলো, তাকে আমি সে মুহূর্তে সেখানে আশা করি নি। আমাকে বাড়ির দোরগোড়ায় দেখেই নন্দিতার ভুরুজোড়া সোজা উপর দিকে উঠে গেলো এবং তারপর সে কোনওরকম ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার, কাকে চাই?

ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে গিয়ে কোনও বাড়িতে প্রথম দিন এমন অভিজ্ঞতা হলে, আমি আর সে বাড়িমুখো হতাম কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু এখানে আমার আপাত প্রতিপক্ষ যেহেতু নন্দিতা, তাই যেন ঝড়ের শব্দেও আমি টের পেলাম বসন্ত রাগ। তারপর গলায় যথাসম্ভব শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্য এনে বললাম, কাউকে চাই না। আমি ইপ্সিতাকে পড়াতে এসেছি। ইংরেজি।

আমার এমনতর উত্তরের জন্য যে নন্দিতা “সম্ভবত” নয় “নিশ্চিতভাবেই” প্রস্তুত ছিলো না সেটা বোঝা গেলো উল্টোদিক থেকে ফের ধেয়ে আসা প্রশ্নে, বাবা কি তাহলে কাল রাতে তোমাদের বাড়িতেই গিয়েছিলো?

আমি টের পাচ্ছিলাম যে, নন্দিতার প্রশ্ন করার ধরনটা আমাকে উত্তেজিত করে তুলছে। কী বলতে, কী বলতাম কে জানে। বাঁচিয়ে দিলেন রবীনকাকু এসে। নন্দিতাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে রবীনকাকু আমাকে বললেন, আরে শৈলেন, এসো, এসো। তারপর নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, নন্দিতা, ওকে পড়ার ঘরে নিয়ে যা।রবীনকাকুর কথায় আমি স্পষ্ট দেখলাম নন্দিতার নাকের পাটা-দুটো, লাল হয়ে গেছে। তবু মাস্টারমশাই বলে কথা। নন্দিতা, মুখটা ব্যাজার করে রেখেই বললো, এসো।

ভট্টাচার্য বাড়ির কোণার দিকে একটা ঘরে আমাকে বসানো হলো। দেখলাম সে ঘরে রয়েছে একটা পড়ার টেবিল আর তিনটে চেয়ার। চেয়ারগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো যে, ওগুলো বাতিল ডাইনিং টেবিলের সেট থেকে আমদানী করা। টেবিলের একদিকে একটা চেয়ার রাখা ছিলো, যেটাতে আমি বসলাম। অন্যদিকে ছিলো দু’টো চেয়ার, যার একটাতে ইপ্সিতা বসলো। নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে প্রথমেই মনে হলো, আহা, যদি এমন হতো—ওদিকে নন্দিতা, এদিকে আমি...!

আমার চিন্তার মধ্যবর্তী সময়ে টেবিলের ও-প্রান্তে বসা ইপ্সিতা উসখুস করছে দেখে “মুখোমুখি বসিবার” কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরলাম দ্রুত। পড়ানোর প্রথম দিন, তাই সব গার্জিয়ানরা ইংরেজি সাহিত্যের যে “বেস”এর খোঁজ করেন, সেটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে ইপ্সিতাকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম “টেন্স”এর চত্বরে। বারোটা টেন্সের মধ্যে ব্যবহারিক জীবনে দশটার সঠিক ব্যবহার বুঝিয়ে যখন উঠবো-উঠবো করছি, ঘড়িতে সময় দেখলাম সাড়ে ন’টা। বুঝতে পারলাম প্রায় ঘন্টা তিনেক একটা ঘোরের মধ্যে পড়িয়ে গেছি। এরই মধ্যে বারবার আমার চোখ খুঁজেছে “তাকে”। এরই মধ্যে চা-বিস্কুট এসেছে, জল এসেছে, কিন্তু নন্দিতা আসে নি। একবারও আসে নি। তবে এর মধ্যেও একটা ভালো লাগার ক্ষণ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন নন্দিতা-ইপ্সিতার মা। কাকিমা নিজের হাতে চা-বিস্কুট, জল পৌঁছে দিয়ে সেদিন বলেছিলেন, শৈলেন একদম “নিজের জন” মনে করে পড়াবে। আহা, কাকিমা না জেনেই কী সুন্দর আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছিলেন সেদিন!

ইপ্সিতাকে মাসখানেক পড়ানোর পরই টের পেতে শুরু করলাম বুধবারের পর শুক্রবারটা খুব তাড়াতাড়ি আসে, কিন্তু শুক্র থেকে বুধ বড্ড দূরে। এর মধ্যে পড়াতে গিয়ে যতবার মুখোমুখি হয়েছি নন্দিতার, দেখেছি আপোষহীন এক জোড়া চোখ একরাশ অপছন্দ নিয়ে আমাকে মেপে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হতো, আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করি নি। আমি ওকে ভালোবাসি—এটা কি কোনও অপরাধ? তবে কেনো...?

বন্ধু-বান্ধবদের নন্দিতার সেই “দৃষ্টি”র কথা বলাতে ওরা বললো, দেখ, এমনটা হয়, হয়ে থাকে, অত চিন্তার কিছু নেই। ওদের কথায় ফের উৎসাহিত হয়ে নন্দিতায় আনন্দিত থাকার চেষ্টা করা শুরু করলাম আমি। শুধু একটা ব্যাপার তাও আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, এই অপছন্দ ব্যাপারটা পার্মানেন্ট কিনা। মনে হতো, যদি তেমনটা হয়, তাহলে আর এত ঝামেলা করে আলেয়ার পিছনে দৌড়ে বেড়ানো কেনো!

3043 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।