(১)
পুরুষবাদ নাকি পিতৃতান্ত্রিকতা নিয়ে একটা পোস্টে কবি সরদার ফারুক মন্তব্যে লিখেছিলেন একবার যেন পুরুষবাদী নারীদের নিয়ে কিছু বলি। আজ বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তায় অত্যন্ত বাজে ট্রাফিক ছিলো, বসে বসে অনলাইনে এটা দেখি সেটা দেখি। প্রিয় ডট কম নামক একটা সাইটে দেখি যে হেডলাইন, 'সৌদি ফেরত নারীরা দেশে এসে গল্প ফাঁদছেন: সচিব'। ভেতরে গিয়ে দেখি এই সচিব হচ্ছেন আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব নমিতা হালদার।
তিনি বলেছেন ‘গত পরশু সৌদি থেকে ২১ জন দেশে এসেছে। তাদেরকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হতো না।’ অনেকে অভিযোগ করছেন তাদেরকে নির্যাতন করা হতো এ বিষয়ে সচিব বলেন, ‘আপনারা গিয়ে খবর নেন।’ ‘দেশে ফিরে দে জাস্ট মেক স্টোরি (তারা গল্প বানায়)। ভালো লাগে না, চলে যাও। কিন্তু এত বড় চুক্তির অধীনে যে তারা গেছে, যাওয়ার সময় দেশ থেকে এসব তাদের বলা হয় না। রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি শুধু তাদেরকে (নারীদের) বলে দেয়, তিন মাস তুই বেড়াই আয়’ ইত্যাদি।
না, নমিতা হালদারের নিন্দা করার জন্যে আমি এই পোস্ট লিখছি না। আমাদের দেশের সচিব এবং ওঁদের অধিনস্ত সকল সরকারী কর্মচারীদের এইটা স্বাভাবিক প্রত্যাশিত স্বতঃসিদ্ধ আচরণ। যে কোনো কিছুতেও ওঁরা বলবেন, 'না, এইরকম কিছু হয় নি' 'এই কথাটি সত্য নয়' ইত্যাদি। এইটা ওঁদের আচরণবিধিতে থাকে? নাকি প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয় জানি না, কিন্তু আপনি যখনই অভিযোগের সুরে কিছু বলবেন, ওঁরা প্রথমেই সেটা অস্বীকার করবেন, পরে অন্য কথা।
নমিতা হালদার একজন সচিব- তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন সচিব হিসাবেই, বায়লজিক্যালি তিনি নারী বটে- কিন্তু সচিব পদটা তো আর নারীর পদ না আরকি। পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারও পুরুষ, সরকারের মন্ত্রীরাও পুরুষ আর সচিবরাও পুরুষ। শারীরিকভাবে ওদের কেউ কেউ নারী বটে, কিন্তু চেতনায় পুরুষ না হলে এরা ঐসব পদে নিয়োগ পেতেন না।
এই সচিব মহোদয়ের কথা পড়ে মনে পড়লো কবি সরদার ফারুকের ফরমায়েশ। এদের কথাই তো সরদার কবি বলেছেন, নাকি? শরীরে নারী মগজে পুরুষ। সেই সাথে চলেন 'কল্যাণকামী' বা 'নারী দরদী' নারীদের কথাও বলি যারা নারীবাদের বিরোধিতা করেন।
(২)
তার আগে 'পুরুষ নির্যাতনকারী' নারীদের কথা এক লাইন বলে নিই।
নারীবাদ নিয়ে বা নারীদের পক্ষে বা নারী অধিকারের পক্ষে কিছু বললেই কয়েকজন দেখবেন দাঁড়িয়ে যায়- কেন ভাই, নারীরা যে পুরুষ নির্যাতন করে সেই কথা বলেন না কেনো? কেনো ভাই, স্ত্রীরা যে স্বামীকে মারে, কামড় দেয়, টাকা পয়সা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সেটা কি নির্যাতন না? ইত্যাদি বলতে থাকে। আমাদের এখানে কিছু লোক নানাসময় পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি জাতীয় জিনিসও তৈরি করেছিলো। এখনো খুঁজলে এইরকম সংগঠন পেলেও পেতে পারেন। তো এই 'পুরুষ নির্যাতন' ব্যাপারটা কি?
এটা নিয়ে খুব বেশী কথা আসলে বলার দরকার নাই। এটা সত্যি যে কখনো কখনো দেখবেন স্ত্রী তার স্বামী দেবতাটিকে কিঞ্চিৎ প্রহার ইত্যাদি করেছেন। আর প্রহার না করলেও এমনিতে বাচনিক অত্যাচার সম্ভবত অনেকেই করেন। স্বামীকে সন্দেহ করা, সন্দেহ থেকে নানারকম জটিলতা এইসব তো আছেই। আপনি কি কখনও ভেবেছেন আপনার বেগম সাহেবা বা আপনার প্রেমিকা আপনার সাথে এইরকম আচরণ কেনো করেন? কারণ তিনি আপনাকে দখলে রাখতে চান। দেখবেন যে এইটা নিয়ে বউ স্বাশুড়ীর মধ্যেও টানাপড়েন হয়। পুরুষটি কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে? স্ত্রীর? প্রেমিকার? নাকি মায়ের দখলে?
আপনাকে দখলে রাখার জন্যে আপনার স্ত্রীর কেনো এতো কাতরতা? কেনো তিনি আপনার জীবনের উপর, আপনার আয়ের উপর এবং আপনার ভালোবাসার উপর একছত্র দখল চান? ভালোবাসা তো একটা কারণ আরকি। কিন্তু ভালোবাসার চেয়ে বড় যেটা, আমরা পুরুষরা নারীদেরকে ঐ অবস্থায় নিয়ে গেছি যে একজন নারী স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নিজের জীবন যাতে নিজে যাপন করতে না পারে। একটি শিশুকে নারী বানানোর প্রক্রিয়ায় আমরা তাকে শিখাই যে তুমি শেষ পর্যন্ত একজন পুরুষের জরু হবে। এই জরুর মর্যাদা গরুর চেয়ে বেশী বটে কিন্তু পতির সমান নয়। পতি হচ্ছেন নাথ আর তুমি হবে তার অংশ।
এখন নারীটি যখন বিবাহ করে, তখন যে এইটা জেনেই আসে যে এই পতিটিই হচ্ছে তার আশ্রয়, তার সহায়, তার পরিচয় তার সবকিছুই হচ্ছে এই পুরুষটি। এই পুরুষটি হচ্ছে তার মালিক। নারীটির মগজে রক্ষিত এই ধারনার সাথে যুক্ত হয় বাস্তবতা, যে এই পুরুষটি যদি তাকে ত্যাগ করে তাইলে হয়তো তার মাথার উপর ছাদ থাকবে না, দু’বেলা খাবার জুটবে না। স্বামী যদি তাকে ত্যাগ করে তাইলে তাকে অপর পুরুষের মুখাপেক্ষী হতে হবে, সেটা হোক ভাই বা বাপ বা পুত্র। তাইলে নারীটি কি করবে? তিনি তো ছলে বলে কৌশলে অনুনয়ে সবভাবেই চেষ্টা করবেন এই পুরুষটি যেন তাকে ত্যাগ না করেন।
আর নারীর এই সহজাত নিরাপত্তাহীনতা থেকেই নারী চায় পুরুষটি যেন তার নিয়ন্ত্রণেই থাকে- আর এই নিয়ন্ত্রণ রাখার কিছু কায়দার অংশই হচ্ছে ঐসব, যেগুলিকে আপনারা পুরুষ নির্যাতন বলেন।
(৩)
আর এই যে চেতনাটা, যে পুরুষই হচ্ছে মালিক, পুরুষই মানুষ, নারীরা হচ্ছে পুরুষের দাসী মাত্র, নারীরা পুর্নাঙ্গ মানুষ নয়- সমাজের প্রায় সবাই এই কথাটা সত্য জানেন। অল্প কিছু ব্যাতিক্রম আছে নারীদের মধ্যে যারা প্রকৃতই মনে করেন যে নারীরাও মানুষ এবং পুরুষের সমান মানুষ, পুরুষদের মধ্যে ব্যতিক্রম নাই বললেই চলে।
এই যে বিপুল সংখ্যক পুরুষ যারা প্রচলিত এই বিশ্বাস, যে নারী একটু কম মানুষ বা ঊন-মানুষ, এইটা মেনে নিয়েই বড় হয়েছেন এরা সকলেই যে নারীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তাতো আর নয়। এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক আছেন যারা এইটাকে সত্য মেনেই নারীর জন্যে 'ভালো কিছু' করতে চান। কথাটা এরকম যে, আহা, মেয়েমানুষ দুর্বল, ওদের তো কিছু কল্যাণ করা দরকার। এরা কিন্তু নারীকে পুরুষের সমান পুরোপুরি মানুষ মনে করেন না, কিন্তু নারীকে অসহায় জেনে ওদের ভালো করতে চান এরা। ভালোটা কি? মেয়েদেরকে শিক্ষা দাও, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করো, চাকরী করতে দাও, নিরাপত্তা দাও এইসব। এইসবই ভালো, মন্দ কিছু না।
মন্দ হচ্ছে ওদের রাজনৈতিক অবস্থানটা। ওরা নারীর অধিকারটা স্বীকার করেন না, কেবল নারীর জন্যে কল্যাণ করতে চান। এরা হচ্ছে সেই দল যারা বলেন যে 'আমি তো আমার স্ত্রীকে চাকরী করতে দিই' বা 'আমি তো মেয়েদেরকে বাইরে যাওয়ার অধিকার দিয়েছি' ইত্যাদি। লক্ষ্য করবেন যে ইনি নারীকে অধিকার 'দিতে' চান। ওরে ব্যাটা, তুই অধিকার দেওয়ার কে? তুই কি মালিক? আর নারী হচ্ছে দাস? এইটাই মন্দটা, যে এরা নারীকে পুর্নাঙ্গ মানুষ স্বীকার করেন না।
আর আমাদের নারীদের মধ্যে যারা চাকরীতে রাজনীতিতে ব্যবসায় বা অন্যত্র সফল হয়েছেন এদের মধ্যেও একটা বড় অংশ হচ্ছে যারা এইরকম 'কল্যাণপন্থী'। মানে কি? মানে এইসব সফল নারীরা আসলেই মনে করেন যে নারী হচ্ছে পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ, কিন্তু 'সুযোগ' পেলে নারী অনেক কিছু করতে পারে ইত্যাদি। এদের মনের মধ্যে এই ধারনাটা একদম দৃঢ় থাকে যে নারী পুরুষের সমান মানুষ না। এইটা যদি না থাকে তাইলে পুরুষবাদী রাষ্ট্রে এরা ক্ষমতা বা সাফল্য পাবেন না। কাজে কাজেই যেসকল নারী বৈষয়িক বা রাজনৈতিকভাবে সফল এবং ক্ষমতাধর এরা প্রায় সকলেই চেতনার দিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে অধিক পুরুষ।
ঐ যে দেখেছেন হয়তো কিছুদিন আগে, আপনারা যখন চিল্লাচ্ছেন যে ধর্ষণের জন্যে নারীর পোশাক দায়ী নয়, তখন সরকারের মন্ত্রী এমপি কয়েকজন কি বক্তৃতা দিলেন? যে নারীর পোশাক আর চালচলন এইসব ঠিক নাই বলে নারীরা নির্যাতিতা হন ইত্যাদি।
(৪)
এইজন্যেই দেখবেন যে নারীদের মধ্যে বেশীরভাগই পিতৃতান্ত্রিকতা বা পুরুষবাদ সমর্থন করেন। বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে আপনার ডানে বামে আগে পিছে প্রায় সকল নারীই দেখবেন কোনো না কোনোভাবে পুরুষবাদী আর কেউ কেউ দেখবেন পুরুষের চেয়ে বেশী পুরুষবাদী। দেখবেন যে এরা এমনিতে নারীর প্রতি বৈষম্য নারীর জন্যে কল্যাণ নারীর জন্যে নিরাপত্তা এইসব ইস্যুতে তো আপনার সাথে হয়তো অনেকটা এক সুরেই কথা বলবেন, কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি নারীর সমতার কথা বলবেন, নারীর অধিকারের কথা বলবেন, দেখবেন যে ওরা কেমন মিইয়ে যাবে।
এটা তো বললাম নারীর কল্যাণকামী কিন্তু পুরুষবাদী নারীদের কথা। এদের সাথে নারীবাদী নারীদের পার্থক্যটা তো বুঝতেই পারছেন- কল্যাণ আর অধিকারের যে পার্থক্য- সেটা। দান আর অধিকারের যে পার্থক্য- সেটা। এই কল্যাণকামীরা ছাড়াও কিন্তু পুরুষবাদী নারী আছে। ওরা বড় ভয়ংকর। কেননা এই দলের পুরুষবাদী নারীরা এরা পুরুষের চেয়েও নারী বিদ্বেষী। এরা কারা?
এরা প্রধানত ধার্মিকেরা। ধর্মগুলি যেহেতু সব কয়টাই নারীকে ঊন-মানুষ বিবেচনা করে এবং নারীকে পুরুষের ভোগের বস্তু মনে করে, ধার্মিকদের তো আর এটা নিয়ে বিবাদ করার কোনো সুযোগ নাই। কাজে কাজেই যে যত ধার্মিক হবে সে ততো বড় নারী বিদ্বেষী হবে। এটা পুরুষ নারী সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ধার্মিক নারীরা বিনা বাক্যে দাসত্ব মেনে নেয়, মেনে নেয় যে ওদের নারীজন্ম হয়েছেই পুরুষের সেবা আর ঈশ্বরের গুণগান করার জন্যে। ওরা মেনেই নেয় যে মানুষ নামক প্রজাতির মধ্যে পুরুষরা হচ্ছে উত্তম আর নারীরা হচ্ছে অধম। ওদের কাছে স্বামী হচ্ছে ওদের মালিক, ওদের দেহের মালিক, রূপের মালিক, কণ্ঠের মালিক সবকিছু। এমনকি নিজের যৌনতাটুকুর উপরেও এরা নিজেদের অধিকার ভাবতে পারে না। এরা কেবল পা ফাঁক করে দেয় পুরুষের প্রবেশের জন্যে আর পুরুষের বীজ গ্রহণ করার জন্যে। বীজ গ্রহণ করে আর প্রার্থনা করে যেন সেই বীজ থেকে আরেকটা পুরুষ উৎপন্ন হয়।
না, পুরুষবাদী নারীরা যে প্রেম ভালোবাসা করেন না সেটা না। কিন্তু ওদের প্রেম ভালোবাসাও হচ্ছে প্রভু এবং দাসীর মধ্যে প্রেম, সেটা কখনো সমানে সমানে বন্ধুত্ব হয় না।
(৫)
সচিব ভদ্রমহিলার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তাকে নিন্দা করার জন্যে নয়। তাঁর কথাটা সামনে পড়ে গেলো বলে সেটা দিয়ে আলোচনাটা শুরু হয়েছে। সৌদি আরবে আমাদের নারীদের উপর যে নির্যাতন হয়েছে সেটা মিথ্যা হতে যাবে কেনো? নারীরা সেখান থেকে ফিরে এসে গল্প বানাচ্ছে এটা তো একটা বাজে কথা আরকি। তাইলে এই সচিব মহোদয়া এইরকম বাজে কথা কেনো বলছেন? একটা তো আছে তাঁর চাকরীর জন্যে। কোনো না কোনোভাবে সরকারের উপর একটা দোষারোপের সুযোগ হয় সেরকম কোনো কথা তিনি মানবেন না।
আরেকটা কারণ হচ্ছে পুরুষবাদ। শারীরিকভাবে নারী হলেও তিনিও সম্ভবত শেষ বিচারে একজন পুরুষবাদীই। পুরুষবাদের তো কাজই হচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ যখনই আসে তখনই দোষটা নারীর উপর তুলে দেওয়া। তিনিও তাই করার চেষ্টা করছেন। এছাড়া আর কি কারণ হতে পারে এইসব হতভাগী নির্যাতিতা নারীদেরকে ঢালাও মিথ্যাবাদী বলে দেওয়ার।