একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আজ সভ্য হতে পারি নি। নিজেকে সভ্যতার খোলসে আবৃত করে বারবার শুধু অসভ্য প্রমান করে গেছি। কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটলে এমনটা করতে পারি তার হিসেব হয়তো কারো জানা নেই। মানুষকে মানুষ না ভেবে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। আজ আমাদের পরিচয় আর মানুষ নয় বরং হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন। এই জাতিগত বৈষম্যের কারণে প্রতিদিন কতশত নিরীহ মানুষ প্রাণ দিচ্ছে।
আর সাম্প্রদায়িক বিষ এমন এক মারাত্মক অসুখ যার কোনো টিকা কিংবা ঔষধ এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। এর শিকার হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। যে যেই দেশে সংখ্যালঘু সে সেই দেশেই কম বেশি নির্যাতীত। আমিও এর বাইরে নই। জন্মগতভাবে আমি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেছি। সেজন্যই ছোটবেলা থেকে পূজা পার্বণ কিংবা ধর্মীয় অন্যান্য সংস্কারগুলো মোটামুটি মেনে চলতাম। সেটা জেনে কিংবা না জেনে। তাই কোনো উৎসব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে বেশ আনন্দ পেতাম। বেশ একটা নির্মল ভাব আসতো মনজুড়ে। পূজা মানেই আনন্দ কিংবা নতুন নতুন জামাকাপড়ে নিজেকে সুসজ্জিত করার একটা বাহানা।
যতটা না ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম তারচেয়ে বরং লোকজনের মিলনমেলাকেই উপভোগ করতাম বেশি। তারপরে যখন একটু বড় হলাম আরও কত কি জানলাম শিখলাম। তবে আগের মতো সেই আমেজটা আর খুঁজে পাই না। কারণ আজকে আর সেইভাবে উৎসব হতে দেখি না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলো। সর্বত্রই একটা অস্থিরতা, ভয়, উৎকন্ঠা বিরাজমান।
আমাদের গ্রামটা বেহালার আকৃতির মতো তাই গ্রামের নামটাও বেহালা। সারা গ্রামটায় কয়েক হাজার হিন্দুর বসবাস। অবশ্য কালের পরিক্রমায় এই গ্রামে অন্য সম্প্রদায় এখন বসতি গড়েছে। কয়েক বছর আগেও এই গ্রামে শুধুমাত্র হিন্দুদের একছত্র আধিপত্য ছিলো। এখন আর সেটা নেই।
গ্রামগুলো এমন সাজানো গোছানো দেখলেই কেমন যেন শান্তি আসে। প্রায় প্রতিটা বাড়ির পিছন দিকটায় বড় খাল। আর খালের ঠিক অপরদিকেই মুসলমানদের বসতি। অনেক বছর ধরেই হিন্দু মুসলমান সহাবস্থান করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে চিত্রটা একটু ভিন্ন। যেমন আমাদের বাড়িতে বাৎসরিক কীর্ত্তন হয় নির্দিষ্ট একটা তিথিতে। আমার ছোটবেলা থেকেই এটা দেখেছি হতে পারে আমার জন্মের আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো। যাইহোক, আমাদের বাড়ি তথা গ্রামের অধিকাংশ লোকই মতুয়া ধর্মালম্বী। এই মতুয়ারা ঢোল কাঁসি বাজিয়ে বেশ উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্ত্তন করে। এই কীর্ত্তন শ্রুতিমধুর যেমন ঠিক তেমনি অনেকটাই শব্দদূষণ আর শরীরের পক্ষেও কিছুটা হলেও ক্ষতিকর।
বিশেষ করে কীর্ত্তনের পরেরদিন আর স্বাভাবিক ভাবেই কানে শুনতে অনেকেরই কষ্ট হতো। তারপরেও সাধারন মানুষের যেন ওতেই শান্তি। তারা সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনীর পরেও ঠিক রাতেই মন্দিরের বারান্দায় বসে একমনে কীর্ত্তন শুনতে আসতো। পরেরদিন সবাই পেটপুরে খিঁচুরি আর পায়েস খেতো কলাপাতায়। এই তিথীটার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো।
যদিও এই কীর্ত্তন যতটা বেশি মানুষের হৃদয়ে না ধর্মীয় চেতনা জাগাতো তার চেয়ে বেশি একট মিলনমেলা ছিলো আর সেটা কারো জন্য ক্ষতিকারক ছিলো না। কারণ এই উৎসবের যারা আয়োজক ছিলো তারা পারতপক্ষে গ্রামের খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষ। তাদের দ্বারা মানুষের উপকার বৈ অপকার হতো না। আরও একটি ব্যাপার এই কীর্ত্তন শুনতে শুধুমাত্র হিন্দুরাই আসতো না। অনেক মুসলমানরাও আসতো। তাদের সংগে আমাদের ধর্মীয় পার্থক্য থাকলে মনের কোনো জায়গায় যেন একটা অদৃশ্য মিল অনুভব করতাম।
কালের পরিক্রমায় আজ সব অতীত হয়ে গেছে। আগে কীর্ত্তন একদিন এক রাত্রি ছিলো এখন বাড়িয়ে দিগুণ হয়েছে কিন্তু চিত্রটা সম্পূর্ন ভিন্ন। এখন আর আগের মতন ঢোল কাঁসি বাজিয়ে ঠিকমত কীর্ত্তন করার অনুমতি নেই। নির্দিষ্ট কিছু সময় সময় মৌণতা অবলম্বন করতে হয়। যদিও অনেক বছর থেকেই এরকম নিয়ম মেনেই কীর্ত্তনের আয়োজন করতো এখন তার সংগে সংগে আরও অনেক নিয়ম জুড়ে দিয়েছেন মৌলবীরা।
যেমন আগে যারা দূর থেকে কীর্ত্তনের দল নিয়ে আসতেন তারা আমাদের বাড়ির প্রায় মাইলখানেক দূর থেকেই বাজাতে বাজাতে কিংবা নাচতে নাচতে আসতেন। এখানে বলে রাখা ভালো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কীর্ত্তনের জন্য দল আসতো। তাদের একটা বিশেষত্ব হলো ঢোল কাঁসির সাথে তালে তালে নাচ। এই নাচ না হলে কীর্ত্তনের আমেজ আসে না। এখন আর সেটা বাজানো যাবে না। মৌলবীরা বলে দিয়েছে এতে নাকি তাদের সমস্যা হয়। বছরের দু'টো দিন কিছু সময়ের জন্যও তারা কোনোরকম ছাড় দিতে রাজি নয়।
অথচ আমরা সারাবছর ধরেই অনেক কিছু সহ্য করি। কারণ প্রতিটা মানুষের নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আর আগের দিনে অন্য সম্প্রদায়ের যারা কীর্ত্তন শুনতে আসতেন তারা এখন অনেকেই আর আসেন না। এখন আসে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেরা ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের সাথে অশোভন আচরণ করতে। তবে কিছু মাঝবয়সীরাও এটা করেন। তাই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় আয়োজকদের।
আরও অনেক কিছুই আছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। তবে একটা বিষয় কিন্তু না বললেই নয় ওপাড়ের মুসলমানদেরকে কিন্তু কোনো নিয়ম বা ফতোয়া দেয়নি এপারের পুরোহিত কিংবা ঠাকুররা। হিন্দুদের যে কখনও অসুবিধা হয় নি তা কিন্তু নয়। যেমন ধরা যাক শীতকালীন ওয়াজের কথা। আমাদের বাড়ির সোজা পশ্চিম দিকটায় প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যানের বাড়ি। আরও বিষদভাবে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের এক রাজাকারে বাড়ি। যদিও উনি বেঁচে নেই। তার বাড়িতে প্রায়শই ওয়াজ হতো আর মাইকটা আমাদের দিকে তাক করানো ছিলো।
যেন তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো আমাদের বিরক্ত করা। তারা কতটুকু ধর্মীয় সওয়াব কামাতো সেটা না বুঝলেও হিন্দুদের যে বিরক্ত করতে সফল হতো সেটা অন্তত বুঝতে পারতাম। যদি তাই না হবে তাহলে তাদের গ্রামের দিকে মাইক তাক না করে কেনো অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের দিকে তাক করবে। সবটাই ছিলো উদ্দেশ্য প্রনোদিত। আর ওয়াজে যে পরিমাণ হিন্দুবিদ্বেষী বিষ উদগীরন করতো তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তবুও নিরীহ হিন্দুরা কিছুই বলতো না। হয়তোবা সংখ্যালঘু বলেই নীরবে সহ্য করাটা রপ্ত করতে পেরেছে। এটাই বাস্তব সব দেশেই সংখ্যালঘুরা কম বেশি নির্যাতীত। তবে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই পাল্টে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিনাশের এক মহোৎসব চলছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় মন্দির ভাংচুর, জোড় করে ধর্মান্তকরণ, সম্পত্তি দখল, খুন আরও কত কি। এর বিচারও হয় না ঠিকমতো। এর যদি সিকিভাগও বিচার হতো তাহলে হয়তো অনেক অপরাধীই আর অপরাধ করার সাহস পেতো না। বিচারের বাণী এখন নিভৃতে কাঁদে। এর প্রধান কারণ হতে পারে সামাজিক অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়কে ঠেকাতে হলে সঠিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতি ঘরে ঘরে।