প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় দুই মারমা কিশোরীকে হাসপাতাল থেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। মেরে ফেলবে মেয়ে দু’টিকে! মানুষ কথা বলছে না। যারা দুই চার লাইন লিখতে পারে, যারা লিখলে ক্ষমতাসীনরা একটু নড়ে চড়ে তারাও মনে করছে আর্মি যেহেতু জড়িত তাহলে সরকারও জড়িত, তাই ‘স্পিকটি নট’ হয়ে থাকাটাই নিরাপদ! একই কারণে আসলে গা সওয়া হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের কাছেও পাহাড়ের নির্যাতন।
মাঝে মাঝেই ফেসবুকের স্টাটাস আর ছবি হয়ে ভেসে উঠে ধর্ষণের শিকার মেয়েদের লাশ। অল্প কিছু শেয়ার হয়। তারপর নতুন ইস্যুর নিচে হারিয়ে যায় সংবাদটি। মূলধারার টিভি মিডিয়ায় জায়গা পায় না এই সব সংবাদ। পত্রিকায় যদিও জায়গা পায় সে খুব ভেতরের পাতায়। আলোড়ন তুলতে পারে না সেই ঘটনা। এই লেখাটি লিখতে লিখতেই নজরে এলো ডয়েচে ভেলে’র (ডিডাব্লিউ) একটি রিপোর্টে উল্লেখকৃত কাপেং ফাউণ্ডেশনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়েছে-
“২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে৷ তার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ১০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে৷ চলতি বছরের কেবল জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ১০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তার মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছিল সবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা আর তুমাচিং মারমাকে। এই নামগুলো ইন্টারনেটে বেশ আলোচিত হয়েছিলো।”
দেশে দেশে কালে কালে এথেনিক নির্মূলকরণে প্রথম এবং প্রধানতমভাবেই টার্গেট করা হয় নারীদেরকেই। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ধরে চলছে এই এথেনিক নিপীড়ন। পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বাঙালিদের পূর্বাসনের নামে চলছে এই নিপীড়ন। প্রথম থেকেই এখানেও এই নির্মূল প্রক্রিয়ায় চলছে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ এবং হত্যার ধারাবাহিক যজ্ঞ।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছিলো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর। যে নিপীড়ন বাঙালিদের ঠেলে দিয়েছিলো স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে তথা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে। মু্ক্তিযুদ্ধে চার লক্ষ্ নারীকে সেনাক্যাম্পেসহ সারা দেশে যত্রতত্র ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিলো পাক আর্মি। যদিও এই ধর্ষণ এবং হত্যাযজ্ঞকে ‘সম্ভ্রমহানী’ বলে একটি সহনীয শব্দে আমরা উল্লেখ করি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কালে যেমন পাকিস্তান আর্মির বিভৎসতার হাত থেকে এই দেশের নারীদের রক্ষা করা যায় নি। তদ্রূপ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই শুরু হওয়া পাহাড়ের মানুষের তথা নারীদের উপরও ধর্ষণ ও নিপীড়নও ক্রমাগত চলছে আজ অবধি। পাহাড়ে বিলাই ছড়ির ঘটনায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অতীতের সমস্ত লাম্পট্যের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। দেশের মিডিয়াওগুলোও পরিণত হয়েছে সরকারের তাবেদার মিডিয়ায়।
অবশ্য একটি মৃত রাষ্ট্রে কোনো মানুষই কথা বলতে পারে না। শুধু মাত্র একটি মৃতপ্রায় রাষ্ট্রেই মিডিয়া বাধ্য হয় সংবাদ ছাপানোর পরিবর্তে চেপে যেতে। প্রকাশের পরিবর্তে সংবাদ গিলে খেতে!
বিলাই ছড়ির ঘটনা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়াতে এতো লেখালেখি করেও সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের বিকার ঘটানো গেলো না! নির্বিকার এই একই সেনাবাহিনীইতো সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর মেরে ফেললো, মানুষ রাজপথে নেমেও সরকারের দমননীতির কাছে হেরে গেলো! কারণ এখানেও ধর্ষকের কুশীলব সেনাবাহিনী। তবে কি যে গুজব দেশের বাতাসে ভাসছে সেটাই সত্য! সেনাবাহিনীর হাতে হাসিনা সরকার পুতুল সরকার?
আর্মিরা কিশোরীদ্বয়ের সাথে চাকমা রানী ইয়েন ইয়েনকেও অপহরণ করেছিলো মারমা কিশোরীদের সাথে। অপহরণের আগে রানীকে এবং একজন ভলেন্টিয়ার নারীকেও মারধর করা হয়েছে। আহত অবস্থায় রানী ইয়েন ইয়েন ফিরে এলেও কিশোরীদের কোনো খবর নেই বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ:
“আপনারা জানেন, গতকাল রাঙামাটি হাসপাতালে মারমা বোনদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং রাণী ইয়েন ইয়েনসহ বাকিদের মারধর করা হয়েছে। এর আগে হাসপাতালের সমস্ত লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়, শুধুমাত্র মহিলা ওয়ার্ড ছাড়া যেখানে ভিক্টিমদের সাথে অবস্থান করছিলেন রাণী ও ভলান্টিয়াররা।
লাইট অফ করে ১০-১২ জন মহিলা (মুখে কাপড় পেঁচানো) আর সাথে ৬-৭ জন পুরুষ ওয়ার্ডে প্রবেশ করে। এদের সকলের নেতৃত্বে ছিল রমেল চাকমার হত্যাকারী মেজর তানভীর। এসেই তারা ভলান্টিয়ারদের অন্য রুমে আটকে রাখে। রাণীর সাথে তখন ছিল মাত্র একজন ভলান্টিয়ার যে সেখান থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এরপর তারা সমন্বিতভাবে রাণী ও অন্য একজন ভলান্টিয়ারের উপর আক্রমণ করে। দুইজনকেই মাটিতে ফেলে পেটানো হয়। রাণীর মাথায় কিল-ঘুষি দিয়ে আঘাত করা হয় অনেকবার। লাথি মারা হয়েছে বেশ কয়েকটি। এরপর তাদের মারতে মারতে হাসপাতালের দোতলা থেকে নিচতলায় নিয়ে আসা হয়। ভলান্টিয়ার মেয়েটিকে সামনের দরজায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাণীকে পিছনের দরজার দিকে। নিয়ে যাওয়ার সময় রাণী ও অন্য ভলান্টিয়ারকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল তারা বারবার।
ওয়ার্ডের মধ্যে রাণীর ফোন ছিনতাই করার চেষ্টাও চলে। আর মেয়ে ভলান্টিয়ারটি সে ফোনটি নিয়ে ধস্তাধস্তি করে আর্মি-পুলিশের সাথে। ফলে তাকে সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয়।
মেয়ে ভলান্টিয়ারকে ভিক্টিমদের সাথে গাড়িতে তুলে নেয়ার প্রথমে চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে তারা। এ সুযোগে মেয়েটি সেখান থেকে পালিয়ে দোতলায় একটি স্টোররুমে নিয়ে আটকে রেখে নিজেকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে জানা গেছে যে, মেয়েটিকে খুঁজতে পুলিশ আর রাত ১১টার দিকে আর্মির একটি দল হাসপাতালে গিয়েছিল। তবে এর আগে মেয়েটি সেখান থেকে সরে পড়ে।
আর রাণীকে যখন পিছনের দরজা দিয়ে ঠেলে দেয়া হয় তখন অন্ধকারের সুযোগে তিনি দেয়াল টপকে হাসপাতালের পিছনের লেকের পাড়ে আশ্রয় নেন। আশ্রয় নেয়ার আগে তিনি হাসপাতালের মেইন গেইটের দিকে এগিয়ে যান এবং হাসপাতালের কম্পাউন্ডে সিলভার কালারের একটি মাইক্রোবাস (যেখানে করে মেয়েদের নেয়া হয়েছিল) এবং সে গাড়ির আগে পিছে আর্মির ভ্যান দেখতে পেয়েছিলেন। কাউকে তখন হাসপাতাল এরিয়ায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না তাই হাসপাতাল ছিলো একেবারে খাঁ খাঁ। সেখানে তিনি অনেকগুলো লাইট দেখতে পেয়েছিলেন। এরপর রাণী নিজেকে রক্ষার জন্য প্রায় ৩০-৩৫ মিনিট পরে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং সিএনজি দিয়ে রাজবাড়িতে চলে যান।”
কল্পনা চাকমা! ১৯৯৬ সালে এই রাঙামাটিরই বাঘাই ছড়িতে তার বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো সেনাবাহিনী। আর ফিরে পাওয়া যায় নি কল্পনা চাকমাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের হিল উইমেনস ফেডারেশনের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিলেন কল্পনা চাকমা। ২২ বছর হয়ে গেলো। আর কি ফিরে আসবে কল্পনা চাকমা!
ফিরে কি আসবে আর বিলাই ছড়ির মারমা কিশোরীদ্বয়? অপহরণের পর রাঙামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান কিশোরীদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। দেশে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে, ধর্ষণ, ইভটিজিং, শারিরীক ভাবে নির্যাতনের ক্ষেত্রে ভিকটিমের ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করার যাবে না। সেখানে একজন পুলিশ সুপার ভিকটিমের ছবি স্যোশাল মিডিয়ার প্রকাশ করে দিয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নে বলেন যে -এখনওতো এখনও তিনি নিশ্চিত নন কিশোরীদ্বয়কে ধর্ষণ করা হয়েছে কিনা। উফ কার হাতে আইন? ভাবা যায়? হ্যাঁ যায়, একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রেই ভাবা যায়।
দেশটিতে বইমেলার পাশাপাশি ধর্ষণের মেলো চলছে যেনো। ভালোবাসা দিবসেই উখিয়াতেই ইলা রানী চাকমা নামের এক স্কুল ছাত্রী প্রাইভেট পড়ে ফেরার সময় ৪/৫ জন দুর্বৃত্ত ধর্ষণের চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার চেষ্টা করার সময় সে আহত হয়। তার চিৎকারে তার বড় বোন সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা তাকেও আহত করে।
বাংলাদেশের অন্য নারীরা আপনারা নিরাপদে আছেন তো? থাকেন নিরাপদে, মুখে কুলুপ এঁটে! আশ্চর্য কোনো নারী সংগঠনও টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। শুধু সুলতানা কামালকে দেখলাম পাহাড়ের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে। ব্যাস তিনি ছাড়া আর যেন কোনো নারী নেই দেশে!
কোনো কোনো নারী লেখককে পাহাড়ের নিপীড়ন ও নারী ধর্ষণ বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করা হলে শুনতে হয়- এই ধর্ষণ রাজনৈতিক ধর্ষণ। এখানে প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। তাহলে কি আমরা শুধু রূপা ধর্ষণের মতো নির্বিষ লাভ জনক ইস্যুতেই প্রতিবাদী হবো!
আহহা, সত্যিতো! এখন বইমেলা চলছে দেশে। অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফের রমরমা সিজন! এখন কি করে পাহাড়ি কিশোরীদের জন্য এক লাইন লেখা যাবে! তারা আর সময় পেলো না অপহৃত হওয়ার? কি আর করার আছে? বরং ধিক্কার জানানো নিরাপদ সেই পাহাড়ি কিশোরীদেরকেই।
ফেব্রুয়ারি ছিলো দ্রোহের মাস! যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রক্তশপথের মাস! এই দ্রোহের আগুনকে উজ্জীবিত রাখতেই শুরু হয়েছিলো যে বইমেলা সেই মাসকে অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফের মাসে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের লেখকেরা মানুষকে ডেকে ডেকে বইমেলায় নিয়ে গিয়ে অটোগ্রাফ দিতে পারলেও ডেকে ডেকে রাজপথে নিয়ে গিয়ে একটা প্রতিবাদী প্লাকার্ড ধরিয়ে দিতে পারে না!
নিদেনপক্ষে গতকাল সেনাবাহিনীর দ্বারা দুই মার্মা কিশোরী অপহরণের দিনকে কালো দিন ধরে নিয়ে বইমেলাতে সবাইকে কালোব্যাজ পরার আহবানতো জানানো যেতো। (কিছুদিন আগেও অল্প কয়েকজন প্রতিবাদী মুখ আঁকা ছিলো চোখে, যাদের অন্তত রাজপথে দেখা যেতো প্রতিবাদ করতে। এখন তারাও ঠাঁই নিয়েছে শুধুই রাজপথের স্মৃতিতে) বা এইরকম কিছুতো করা যেতো যাতে শাসক বুঝতো যে দেশের মানুষ টিয়ারশেল, গরম পানি, পুলিশের লাঠির ভয়ে রাস্তায় নামতে না পারলেও, তাদের একেবারে মৃত্যুও ঘটে নি। অন্তত কোনোভাবে বোঝানো কি যেতো না?-
"রাষ্ট্র তোমার স্বেচ্ছাচার মানি না মানবো না।"
অন্তত কিছু একটা প্রতিবাদ হলে রাষ্ট্র বুঝতো -ধর্ষণের শিকার সব নারী চাকুরি চায় না, যুবলীগের পদ চায় না, চায় -সময় থাকতে থাকতেই রাষ্ট্র তার নারী লোলুপ সেনাবাহিনীকে সামলাক।