শামীম আজাদ

কবি, লেখক।

ঘরের সেনাপতি

বস্তু শাসিত, যন্ত্র শাসিত এ গূঢ় সমাজ’র বস্তু থেকে বস্তুর ছায়া আলাদা করতে গেলে সপ্রাণ বস্তুর অবয়বে ক্লান্ত পায়ে যে এসে দাঁড়ায়, সে নারী। দীর্ঘ দাঁড়িয়ে থাকে তৃষ্ণাতুর, রতি ক্লান্ত। তোষণে তোষণে পরিশ্রান্ত ওষ্ঠ। তার চোখের সন্নিকটে অপেক্ষা আছে শুপ্তি। কিন্তু তার প্রাণের সে হাহাকার জানার কারো অবকাশ নাই। তাই বায়ুসিদ্ধ এ জগতে সে আয়ত্ব করেছে এক জলের তনাই। প্রয়োজন ভেদে সে কখনো নদী কখনোবা নোঙর। আবার কখনো দেবী কিম্বা কূল ও করমচা গাছ। কিন্তু কদাচিৎ সে মানুষ।

 

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া সে নারী দেবী অথবা নদী হয়ে গেছে বলে তার আর ফেরার পথ থাকে না। কিন্তু  নারী ও নদীকে একাকার করা অথবা মা, ময়না বা মৃত্তিকার সঙ্গে তাকে যুথবদ্ধ করার ব্যাপারেও তার যে কথা তা শোনেনি কেউ। জঠরে ধরা শুদ্ধচার তাকে ভদ্র ও নতজানু করে রেখেছে বলে কোনোদিন সে উচ্চবাচ্য করতে পারেনি। তাতেই হয়েছে ভুল। মায়ায়, মন্ত্রে, রঙে রেখায়, উপমা রূপক ও উৎপ্রেক্ষায়।  একে বলবো না প্রেম। এ স্বার্থতন্ত্র। ভোগ চিন্তা। এ বাস্তবতা নয়। এ চাটুকারিতা। এ দূর্নীতির ও দমননীতির স্ট্রাটেজি। একই পৃথিবীর জলহাওয়ার  সামিয়ানার নিচে সুবিধাবাদী মানুষের দাগের দেয়াল।

কণ্টকিত এ আচরণ বিধিতে নারী তাই অত্মরক্ষার্থে চেতন অচেতনে নিজেই নিজের অবকাঠামো খুলে খুলে দেখে। তার হাড় ও কংকাল থেকে নিবিষ্ঠ পাঠ করে। সে কাঁটা গাঁথা জল মহালেই শ্যাওলা থেকেই আয়ত্ব করে আহার। পিছলে যাবার কৌশল। যেখানে আঘাত লেগেছে তা থেকে প্রত্যঙ্গ প্রত্যাহার করে বোতাম আটকে দিয়েছে। শিরিষের অচ্ছুত ঘর্ষনে তার বর্হিরাঙ্গ হয়ে গেছে মসৃণ সুন্দর। সে হয়ে গেছে পরম বিনয়ী ও ভদ্র এক আজব প্রাণী।

কী অদ্ভুত ভাবে সবার দূর্বলতাকে ক্ষমা করে নিজ পাতে অনিদ্রা টেনে সে স্থির বসে আছে। এ পরিস্থির সুফললোভীরা এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে এ ঘোর সংসারে তাকে দয়াবতী ও সর্বংসহার মুকুট দিয়ে ভুলিয়ে রাখছে। তার কাছ থেকে জোর করে ক্ষমা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ব্যবহার করছে যেন এক প্রাচীন আসবাব। গৃহকোনে পড়ে আছে অনড়। এভাবেই একদিন তার জীবণ চাঞ্চল্য ও নির্যাস নি:শেষ হবার পর সে বাড়ির গেস্ট রুমে পড়ে। রোয়া ওঠা, খোসা ছাড়া বস্তুমাত্র। আয়ের সূত্রও বন্ধ বলে দাঁত থাকেনা, আঁতও থাকেনা। তার উপর পরতে পরতে পড়তে থাকে ধুলো। এ দু:সময়ের দাবাগ্নির হাত থেকে বাঁচার জন্য এক কনা যে ভূসম্পত্তি ছিলো তাওতো বেহাত। এখন ধূলো ঝারবার লোক নেই।  হাতের দু’গাছা সাধনা লব্ধ সকল বস্তুর সঙ্গে তার তফাত এই যে, এ সপ্রাণ ‘বস্তুটির’ প্রতি বস্থবাদী এ সামাজের প্রত্যাচার। সে ঘটছে এমনকি সংবিধান উপেক্ষা করে, মানবতা উপেক্ষা করে। সমাজের শাসক নিজেরাই দাঁড়িয়ে আছে এর বিপরীতে। অদ্ভূত হলেও তাদের সে উপেক্ষা ও অপব্যবহার তাদের কাছে কখনোই নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে প্রতিয়মান হয়না। বিচিত্র!

আরো বিচিত্র এক নারীর  কোন ভুলে বা স্খলনে পুরো নারীজাতিকে ফালি ফালি করে যাচ্ছে সমাজ- ঝুলিয়ে রাখছে তার লাশ। কিন্তু এককের সাফল্যে উড়ে আসছেনা কোনো পুষ্প বা পুরষ্কার। সূক্ষ্ণচালে ও জালে সেখানে বিভজনক পরিপুষ্ট হচ্ছে দিন দিন। নারী না উল্লেখ করলে তার অবদান নারীর জাতিগত অজর্নে যোগ হচ্ছে না ।

এক দেশে একই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে দু’ভাবে। দেশের সুবিধাদি কিম্বা সুযোগাদি সমগ্র নারীর কাছে পৌঁছবার আগে তার পুরুষের মনমানসিকতার ছাকনীতে যাচাই বাছাই হচ্ছে।  তারপর  কাকড় কিম্বা কষ রয়ে যাচ্ছে তার জন্য। আইন কানুন নীতি নিয়ম সবার জন্য সমান প্রযোজ্য হবার কথা থাকলেও দেশের অর্ধেক যে পুরুষ তারাই শাসন করছে বাকি অর্ধেককেরও বেশি মানুষকে। তাই রাজা করিছে তার সংসার-রাজ্য এমনকি রানীকেও শাসন। জনসমক্ষে সে রানী হলেও চারদেয়ালের ভেতরে জনতার চোখের বাইরে এই হত দরিদ্র বঞ্চিত ও ব্যাক্তিগত ভাবে ব্যর্থ পুরুষ তার নিজ নারী দমনের মাধ্যমেই কিছুটা হলেও বিজয়ের মুখ দেখে নিচ্ছে। অফিসে যে লোকটি অপদার্থ বলে উর্ধ্বতন অফিসারের শাসানি খাচ্ছে সে বাড়ি ফিরেই তার খাবারটি নিয়ে একটি ছুতোয় স্ত্রীকে কটূ কথা বলে সে শোধ নিচ্ছে। বর্হিবিশ্বের পরাজিত সৈনিক ঘরে এক দোদন্ড প্রতাপশালী সেনাপতি।

নারীর অধিকার কতটা রক্ষিত অথবা ব্যহত হচ্ছে তা যাচাই করা যায় দেশের নারী আধিকার নীতি, নারী আইন ও তার বাস্তবায়নের নিরিখে। তার বাস্তবায়নে সুবিধাভোগী পুরুষের ওপর সে বাস্তবায়ন এখনো মারাত্মকভাবে র্নিভরশীল। তারা নানান ভাবে আইনের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যহত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আর যারা পীড়িত বা নির্যাতিত হচ্ছেন তা একটা পর্যায় র্পযন্ত না পৌঁছা র্পযন্ত অনেক সময় জানেনও না যে তারা নির্যাতিত হচ্ছেন। কারণ এর আবার এমন সব স্তর ও রকম আছে যে প্রত্যেক পুরুষের ব্যাক্তিগত আশা আকাঙ্খা এবং র্ব্যথতা বেদনা ও ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রতিফলিত হচ্ছে।  আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী জানেনও না যে তারা নির্যাতনেরই শিকার হচ্ছেন।

নিউ ইর্য়ক স্টেটের ’ডমেস্টিক এ্যাবিউস এ্যান্ড ম্যান হু ব্যাটার’ এর প্রচার পত্র থেকে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতেও ভাবা যেতে পারে এমন কিছু শুধু সনাক্তি সূচক কিছু নির্যাতনের উল্লেখ করছি।

১.      আপনি কি একজন স্ত্রী, মা অথবা কর্মী হিসেবে বিরামহীন ভাবে    প্রতিনিয়ত আপনার পুরুষ (স্বামী, পিতা, সহকমী) দ্বারা সমালোচিত হচ্ছেন

২.     তিনি/ তাহারা অতিরিক্ত দেখাশোনার নামে আপনার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছেন আথবা ইর্ষা পরায়ণ

৩.     তিনি/ তাহারা আপনাকে/ আপনার সন্তানকে/ আপনার কোনো প্রিয় জিনিষকে আঘাত দেবার বা নষ্ট করবার হুমকি দিচ্ছেন

৪.     আপনাকে আপনার পরিবার পরিজন / বন্ধু বান্ধবকে দেখা থেকে বিরত রাখছেন

৫.     রেগে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বিনষ্ট করছেন

৬.    আপনাকে আপনার প্রাপ্য শুবিধাদি যেমন গাড়ী ব্যবহার/ ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টস এ অধিকার/ ক্রেডিট কার্ড ব্যহার থেকে বঞ্চিত রাখছেন/ আপনার ব্যয়ের কানাকড়ি হিসাব নিচ্ছেন

৭.     আপনাকে বা আপনার সন্তানকে ভয় ভীতি প্রর্দশন করছেন

৮.     আপনাকে শারীরিক ভাবে আঘাত, ধাক্কাধাক্কি, ঘুষি, চড় অথবা কামড়ে দিচ্ছেন

৯.     আপনি যখন যেখানে যেতে চাচ্ছেন তা দিচ্ছেন না

১০.   আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌন মিলনে বাধ্য করছেন

১১.    অন্যের সামনে আপনাকে ছোট করছেন

প্রিয় পাঠক আপনি যদি নারী হন এবং এর কোনো একটিতেও যদি আপনি হ্যাঁ বলে থাকেন তাহলেই কিন্তু বুঝতে হবে আপনি এ্যাবিউজড হচ্ছেন- হচ্ছেন র্নিযাতিত। যদি পুরুষ হন তাহলে আপনার কন্যা বা ভগ্নি’র (স্ত্রী’র কথা বলছিনা। কারণ সাধারণ পুরুষরা স্ত্রীর কথা মাথায় আনতেই পারেনা) কথা ভাবুন।

‘এ্যাবিউজ’ শব্দের অর্থ একেক দেশে একেক রকম। ক্ষমতার অপব্যহার করার মাধ্যমে কাউকে অর্মযাদা করাকে আমরা ইংরাজিতে এ্যাবিউজ বলতে পারি তবু এ্যাবিউজের সঠিক অর্থ উক্ত হয় না। নারীর প্রতি এই এ্যাবিউজ বা পীড়ন অথবা আক্রমন অর্থনৈতিক, মানসিক, যৌন, আবেগী, ও শারীরিক যে কোনো রকমেরই হতে পারে । আর আমাদের দেশে তা শুরু হয় কন্যা শিশুর শৈশব কাল থেকে। অথচ সে শিশু নারীর যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্ম নিলেও তখনো নারী হয়ে ওঠেনি।

প্রিয় পুরুষ পাঠক, সেনাপতির ভূমিকা নেবার আগে চোখ ধুয়ে নিন। সব সৈনিকের শক্তি সনাক্ত করতে পারবেন। সকলের ঘামই জমজম হয়ে যাবে। ’কদাচিৎ মানুষ’রা চিরকালের মানুষের অবয়ব পাবে। আপনি জিতে যাবেন। জিতবে আপনার ভুখন্ড ঘ্রাণে ভরে যাবে।

2608 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।